‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দু'টি যদি জোটে তবে একটিতে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী।’ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই বাক্য দুইটির গভীরতা ফুলপ্রেমীরা খুব সহজেই বুঝতে পারেন।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। তাই ঋতুভেদে এ দেশে দেখা মিলে অনেক রকম ফুলের। আর যদি বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা, তাহলে বলার অপেক্ষা রাখে না। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে তালমিলিয়ে নানা ফুলে সুরভিত থাকে এখানকার পরিবেশ।
শেষ বসন্তের তীব্র গরমে চারিদিকে নগরবাসীর হাঁসফাঁস অবস্থা। ঘর থেকে বের হওয়াই যেন দায়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সেজেছে নানা ফুলের সমাহারে। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনালি এবং জারুল ফুলের রঙিন উপস্থিতি ক্যাম্পাসে তৈরি করেছে এক স্বস্তির পরিবেশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকা যেমন কার্জন হল, মল চত্বর, কলাভবন, বটতলা, শ্যাডো, চারুকলা এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ও রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে ফুটে থাকা ফুলগুলো যেন প্রকৃতির এক অসাধারণ চিত্রকর্ম।
প্রকৃতির এ অপরূপ রূপে মুগ্ধ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি পুরনো শিক্ষার্থীরাও ছুটে আসছেন প্রকৃতির মাঝে তাদের স্মৃতি রোমন্থন করতে। লাল কৃষ্ণচূড়া, হলুদ সোনালি ফুল আর বেগুনি জারুলের সৌন্দর্য তারা প্রাণভরে উপভোগ করছেন।
ঈদের ছুটি শেষে যখন সবার মন শহরের যান্ত্রিক পরিবেশে ভারাক্রান্ত, তখন ক্যাম্পাসের এই ফুলের সমাহার একদম অন্যরকম অনুভূতি তৈরি করছে। যেন ফিরে যাওয়ার এক নতুন পৃথিবী, যেখানে প্রকৃতির অপূর্ব রূপে সমৃদ্ধ কৃষ্ণচূড়া, সোনালি ও জারুল ফুল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পুরাতন গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কারণ সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তবে প্রকৃতির সৌন্দর্য রক্ষা এবং ভবিষ্যতে আরো গাছের আচ্ছাদন তৈরি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে আরো বেশি বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মে নুসরাত তিশা বলেন, “প্রকৃতি যেন তার রং-তুলির আঁচড়ে আমাদের ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য্যকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। বর্তমান শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রকৃতির এ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও ছুটে আসছেন। লাল রঙের মনোরম কৃষ্ণচূড়া, হলুদ রঙের সোনালু এবং বেগুনি রঙের জারুল দেখে মন যেন একত্র হয়ে কবিতা লিখতে ইচ্ছা করে, যদিও আমি কবি নই।”
তিনি বলেন, “এই তাপদাহের মাঝেও প্রকৃতির দৃশ্য আমাদের চোখে শান্তির অনুভূতি সৃষ্টি করছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ফাঁকা জায়গায় বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা অপ্রত্যাশিত কিছু হবে না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আজগারুল ইসলাম বলেন, “রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার ফুলের সমাহারে নতুন রূপে সজ্জিত। বসন্ত ঋতুতে নানা রঙের ফুলে ভরে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক স্থান, যা ক্যাম্পাসকে একটি রঙিন ও প্রাণবন্ত আবহে পরিণত করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই ফুলগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ও শৈল্পিক পরিবেশের একটি পরিপূরক উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিনি বলেন, “শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখন ক্যাম্পাসে বসে পড়াশোনার পাশাপাশি এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। যা তাদের মানসিক প্রশান্তি ও সৃজনশীলতা সৃষ্টিতে অবদান রাখছে। একদিকে যেমন ফুলের এ সৌন্দর্য ক্যাম্পাসের পরিবেশকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলছে, তেমনি এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের প্রতি এক নতুন উদ্দীপনা ও আশার প্রতীক হয়ে উঠেছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবারি কালচারাল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, “ক্যাম্পাসকে নান্দনিক করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে যে গাছগুলো লাগানো হয়েছে সেগুলো বেশিরভাগই বিদেশি। দেশীয় নান্দনিক ফুল ও ফলের গাছ ছিল যৎসামান্য। সবুজায়নের কথা চিন্তা করে সেগুলো লাগানো হয়েছিল।”
তিনি বলেন, “নতুন প্রশাসন বৃহৎ পরিসরে ক্যাম্পাসে দেশীয় ফুল, ফল ও বন্যপ্রাণী সহায়ক গাছ রোপণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবারি কালচারের তত্ত্বাবধানে পুরো ক্যাম্পাস এলাকায় একটি শুমারি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে কোনটি বিদেশি গাছ, কোনটি অপ্রয়োজনীয়, এর গণনা চলছে। শুমারির ভিত্তিতে পরবর্তীতে নতুন করে দেশীয় ফুল, ফল ও নান্দনিক গাছ রোপণ করা হবে।”
তিনি আরো বলেন, “দেশের প্রধান তিনটি ঋতু (শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা) টার্গেট করে ফুল ও ফল গাছ রোপণের চিন্তাভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, মোকাররম ভবন, রেজিস্ট্রার ভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় দেশীয় ফুল, ফল ও বন্যপ্রাণী সহায়ক প্রায় ৪ হাজার গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। সেগুলো আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ক্যাম্পাসে সৌন্দর্যবর্ধন করবে। আমরা সঠিকভাবে গাছগুলোর পরিচর্যার মাধ্যমে ক্যাম্পাসকে আরো বেশি সবুজায়ন করতে সক্ষম হব।”