মতামত

চলচ্চিত্রের নারীরা ফিরে আসুক সম্মানের আসনে

রাহাত সাইফুল: চলচ্চিত্রে নারীদের ক্ষেত্র কেবল অভিনয়তেই সীমাবদ্ধ নয়। অভিনয়ের গন্ডি ছাড়িয়ে চলচ্চিত্রের অন্যান্য শাখাতেও বিস্তৃত হয়েছে নারী প্রতিভা। এমন প্রতিভাবান ঢাকাই চলচ্চিত্রেও কম নয়। অভিনয়ে গন্ডি পার হয়ে চলচ্চিত্রের ‘ক্যাপ্টেন অব দ্য শীপ’অর্থাৎ চলচ্চিত্র পরিচালনার দায়িত্বও নিয়েছেন আমাদের দেশের বেশ কয়েকজন নারী। চলচ্চিত্র পরিচালনার মতো দুঃসাধ্য কাজে হাত দিয়ে প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে ইতিহাস হয়ে আছেন রেবেকা। তিনি ১৯৭০ সালে ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ শিরোনামের সিনেমা নির্মাণ করেন। এর পরে জাহানারা ভূঁইয়া নির্মাণ করেন ‘সিঁদুর যাবে না মুছে’ শিরোনামের সিনেমা। এছাড়া রোজী আফসারী ‘আশা নিরাশা’, সুজাতা ‘অর্পন’ সুচন্ধা ‘হাজার বছর ধরে’ কবরী ‘আয়না’ শিরোনামের সিনেমা নির্মাণ করেন। বর্তমানে এ প্রজন্মের কয়েকজন নারী নির্মাতা সিনেমা নির্মাণ করছেন। এ তালিকায় রয়েছেন- নারগিস আক্তার, সামিয়া জামান, মৌসুমী, ক্যাথরিন মাসুদ, মেহের আফরোজ শাওন, রুবাইয়াত হোসেন, শাহনেওয়াজ কাকলী, রওশন আরা নিপা ও জেসমিন আক্তার নদী। চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম এবং প্রধান বিষয় ‘গল্প’ অথবা ‘কাহিনী’। এ ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছেন তারা।অবশ্য ঢাকার সিনেমার শুরু থেকেই অবদান রেখে চলেছেন নারী। ষাটের দশকে ঢাকার সিনেমায় প্রথম নারী কাহিনীকার হিসেবে কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন আত্মপ্রকাশ করেন। ফজলুল হক পরিচালিত ‘সান অব পাকিস্তান’ শিরোনামের সিনেমাটি গল্প লিখেছেন রাবেয়া খাতুন। এর মাধ্যমে তিনিই প্রথম নারী গল্পকারের খাতায় নাম লেখান। পরবর্তীতে তার লেখা কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে মৌসুমী পরিচালিত ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘মেঘের পরে মেঘ’ ও ‘ধ্রুবতারা’ এবং শাজাহান চৌধুরী পরিচালিত ‘মধুমতি’।  রাবেয়া খাতুনের সমসাময়িক আরেকজন কথাসাহিত্যিক রোমেনা আফাজ। ষাট দশকে ‘দস্যু বনহুর’ খ্যাত লেখিকা রোমেনা আফাজ সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘কাগজের নৌকা’ সিনেমার কাহিনী লিখেন। পরবর্তীতে তার কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত ‘মায়ার সংসার’ ও ‘মধুমিতা’, মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘মোমের আলো’ এবং সারথী পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’। আরেক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কাহিনী নিয়ে চাষী নজরুল ইসলাম ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, আখতারুজ্জামান ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ এবং নারগিস আক্তার ‘চার সতীনের ঘর’ নির্মাণ করেন। নাট্যকার গীতালী হাসানের কাহিনী নিয়ে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন ‘ও আমার ছেলে’। শুধু চলচ্চিত্র পরিচালনা ও গল্প লিখেই নয় প্রযোজনায়ও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন নারী। চিত্রনায়িকা  শাবানা, ববিতা, সুজাতা, সুচন্দা, সুচরিতা, রোজিনা, অনু ঘোষ, শাবনাজ, মৌসুমী, নারগিস আক্তার, ক্যাথরিন মাসুদ, তাপসী ঠাকুর, শবনম পারভিন, আলেয়া বেগম, পরীমনি, ববিসহ অনেকেই। সেই ষাটের দশক থেকে চলচ্চিত্রের গল্প লেখা তারপরে পরিচালনা, প্রযোজনা করলেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে চলচ্চিত্রে নারীরা সমান সুবিধে পাচ্ছে কি? নারী দিবস এলেই এমন প্রশ্ন মনে নাড়া দেয়। আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। চলচ্চিত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। যা দেখে দর্শক বিনোদিত হওয়ার পাশাপাশি সচেতন হওয়ার অবকাশ পান। এর মাধ্যমে মানুষ চাইলে জ্ঞানার্জনও করতে পারেন। আমরা মুখে বলি, নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা। যাকে বলি, সমাজের দর্পণ সেই চলচ্চিত্রেই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বৈষম্য লক্ষ করা যায়। ঢাকাই চলচ্চিত্রের অধিকাংশই নির্মিত হয় নায়ক কেন্দ্রীক। নায়িকাদের রাখা হয় নামেমাত্র এমন সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে অহরহ। ঢাকাই সিনেমার ইতিহাস থেকে দেখা মিলে নারী কেন্দ্রীর সিনেমাও সুপার হিট হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে ‘ম্যাডাম ফুলী’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘রানী কেন ডাকাত’, গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘মেয়েরাও মানুষ’, ‘অগ্নি’, ‘অগ্নি-২’। এসব সিনেমা নারী নির্ভর হলেও দর্শক প্রিয়তায় এতটুকুও ছেদ পরেনি। তারপরও নির্মাতারা নায়ককে কেন্দ্র করে সিনেমা নির্মাণ করছেন্। মাঝে মাঝে এমনটাও শোনা যায় নায়কের পছন্দ অনুযায়ী নায়িকা বাছাই করা হয়। যেখানে নায়িকাদের নায়ক পছন্দ করার বিষয়টি খুব বেশি থাকে না। এদিকে নায়কের পারিশ্রমিকের তুলনায় নায়িকার পারিশ্রমিক হয় অর্ধেক। যা খুবই দৃষ্টিকটু। অনেক সিনেমায় নায়িকাকে দেখেই সিনেমা হলে দর্শক ভিড় জমান তারপরও নায়িকার পারিশ্রমিক কম কেন? এছাড়াও শুটিং সেটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী শিল্পীদের পোহাতে হয় ভয়া্বহ বিড়ম্বনা। আবার সিনেমার সঙ্গে জড়িত নারীদের  বাঁকা চোখে দেখা হয়। সে হিসেবে বলা যায়, এখনও নারী তার সঠিক প্রাপ্য বুঝে পাচ্ছেন না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার কারণে সিনেমায় নারীদের জন্য সমস্যা রয়েই গেছে। অশ্লীলতার দায়ে কথা শুনতে হয় নায়িকাদেরই। অথচ সিনেমার পরিচালক কিংবা প্রযোজকই অধিক লাভের আশায় চাপ সৃষ্টি করে এসব করিয়ে থাকেন।এমনও ঘটেছে শুটিং সেটে পিস্তল ঠেকিয়ে অভিনেত্রীকে ছোট পোশাক পরিধান করতে বাধ্য করা হয়েছে। আবার কাটপিস বসিয়েও কোনো কোনো অভিনেত্রীর চরিত্রে কালিমা লেপন করা হয়েছে। ঢাকাই চলচ্চিত্রের নব্বই দশকের শেষের দিকে এমন ঘটেছে বেশি । সে সময় নোংরা চরিত্রে সমালোচনায় এসেছে নায়িকারাই।এদের বিপরীতে থাকা অভিনেতারা সে বিপদ থেকে মুক্ত। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুপারস্টার খ্যাতি নিয়ে এখনও অভিনয় করে যাচ্ছেন। এসব নোংড়া সিনেমার নির্মাতারাও এখনও সিনেমা নির্মাণ করে যাচ্ছেন। কেবল হারিয়ে গেছেন তাদের নায়িকারা। কেন এই অসমতা? বদনামের ভাগ কেন সবার সমান নয়? কবে সমতায় ফিরবে সিনেমার নারী? একশ্রেণির দর্শক আকৃষ্ট করতে সিনেমার পোস্টারে নায়িকার মুখ অশ্লীল কোন শরীরে সেটে দেওয়া হয়।  এসব পোস্টার একজন নারী অভিনেত্রীর সম্মানহানি ঘটায়। আবার সিনেমার গল্পে প্রায়শই নারীর শ্লীলতাহানি, ধর্ষণসহ নানাদৃশ্য জুড়ে দিয়েও অরুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হচ্ছে। এ ছাড়া নানা স্ক্যান্ডাল রটনা-ঘটনাতো রয়েছেই। যাতে কেবল নারীদেরই হেনস্থা হতে হচ্ছে পদে পদে।এসব বাজে সংস্কৃতির পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী। নারী-পুরুষ অসমতা দূর করে ঢাকাই সিনেমা এগিয়ে যাক। ক্যামেরাম্যান, সংগীত পরিচালক, চিত্র সম্পাদকসহ চলচ্চিত্রের অন্যান্য শাখাগুলোতেও প্রতিভাবান নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ুক। নারীদের সম্মানের জায়গাগুলো আরও বিস্তৃত হোক।বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণের স্পশে দশদিক হোক আলেকিত।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৭/রাহাত/শাহ মতিন টিপু