রাহাত সাইফুল : ঢাকাই সিনেমা ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পুনরায় ফিরে পাবে চলচ্চিত্রের সোনালী অধ্যায়। অনেকেই যখন এমন আশার বীজ বুনতে শুরু করেছেন, তখনই অচমকা আশনি সংকেত। সকল স্বপ্ন, সম্ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঢাকাই সিনেমা নকল সিনেমার নোংরা থাবায় আটকা পড়েছে। সিনেমার গল্প থেকে শুরু করে সংলাপ, দৃশ্য, মারামারি এমন কি পোস্টারেও নকলের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা, বিতর্কের ঝড় উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে গণমাধ্যমেও। সেই পালেই যেন হাওয়া দিতে চাইছেন জনপ্রিয় খ্যাতিমান তারকা নির্মাতা ও শিল্পীরাও। ঈদ এলেই হলমুখী হয় সিনেমাপ্রেমীরা। স্বাভাবিক কারণেই প্রতিবছর ঈদে বড় বাজেটের সিনেমা মুক্তি দেয়া হয়। কিছু অসাধু লোক সিনেমাপ্রেমী মানুষদের সরলতায় নকল সিনেমা মুক্তি দিয়ে প্রতারণা করে। প্রত্যেক বছর ঈদে নকল সিনেমা নিয়ে বিতর্কের মুখে পরেন নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। ২০১৪ সালে ঈদে শাকিব খানের নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথম মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘হিরো: দ্যা সুপারস্টার’। শাকিব খান প্রযোজিত এই সিনেমাটি তেলেগু ভাষার ‘রেবেল’ সিনেমার নকল। একই বছরের ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া শাকিব খান অভিনীত ‘হিটম্যান’ সিনেমাটিও ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া তামিল সিনেমা ‘ভিটাই’-এর কার্বন কপি। এটি পরিচালনা করেছেন ওয়াজেদ আলী সুমন। ২০১৫ সালে ঈদে ‘রাজা বাবু’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এটিও ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া তামিল সিনেমা ‘ডাম্মু’ থেকে নকল করা হয়েছে। এছাড়া ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’ সিনেমাটিও ১৯৫৪-এর আমেরিকান মুভি ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’র নকল, ‘রাজত্ব’ সিনেমা ২০০৬-এর তেলেগু ছবি ‘গাজাপাক্কিরি’ থেকে নেওয়া, ‘ডেয়ারিং লাভার’ ২০০৬ সালের তামিল ‘থিরভিলাইয়াডাল আরামবাম’ ও কলকাতার ‘ইডিয়ট’ ছবির নকল, ‘মায়ের মমতা’ স্টার জলসা চ্যানেলের সিরিয়াল ‘মা’র নকল, ‘ভালোবাসা এক্সপ্রেস’ ২০০৩ সালের তেলেগু ছবি ‘শিবামনি’ ও ২০১৩ সালের তেলেগু ছবি ‘মিরচি’র সংমিশ্রণ, ‘আই ডোন্ট কেয়ার’ ২০১২ সালের তেলেগু ছবি ‘রেবেল’সহ একাধিক ছবি হতে অনুপ্রাণিত হয়ে বানানো, ‘জানে না এ মন’ ২০০৬ সালের হিন্দি ‘গ্যাংস্টার’ থেকে নেয়া, ‘কঠিন প্রতিশোধ’ ২০১৩ সালের তেলেগু ‘মিরচি’র নকল, ‘ভালোবাসা এক্সপ্রেস’ ছবিটি নকল করা হয়েছে ২০১২ সালের তেলেগু ছবি ‘রেড দ্য কালার অব লাভ’ থেকে। এ ছবিটি হিন্দিতে ‘ডেঞ্জারাস খিলাড়ি’, মালায়াম ‘গাজাপাক্কিরি’ ও তামিল ভাষায় ‘সাহাসাস’ নামে আগেই নির্মাণ হয়েছে। ‘জান কোরবান’ নকল করা হয়েছে কলকাতার ‘আই লাভ ইউ’ থেকে। দেশের খ্যাতিমান নির্মাতাদের এসব সিনেমার প্রধান অভিনেতা দেশসেরা চিত্রনায়ক শাকিব খান। শাকিব খান যেন নকল সিনেমার গোলক ধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছেন। এছাড়াও এই তালিকা থেকে বাদ পরেনি এখনকার অন্যান্য শিল্পীরাও। মালেক আফসারি পরিচালিত ‘অন্তর জ্বালা’ সিনেমাটি তামিল ভাষার ‘ভেইল’ সিনেমার নকল, ‘হানিমুন’ ২০১২ সালের তেলেগু ছবি ‘রাচা’সহ একাধিক ছবির নকল, ‘অদৃশ্য শত্রু’ ১৯৯৩ সালের হিন্দি ছবি ‘বাজিগর’ ও ২০০৮ সালের হিন্দি ‘কিডন্যাপ’ থেকে অনুপ্রাণিত, ‘অল্প অল্প প্রেমের গল্প’ ২০১১ সালের তেলেগু ‘আলা মোদালাইন্দি’র হুবহু নকল, ‘অগ্নি’ সিনেমা ২০১১-এর আমেরিকান মুভি কলোম্বিয়ানার আদলে নির্মিত, ‘কিস্তিমাত’ ২০১২ সালের তেলেগু ‘গাব্বার সিং’ থেকে তৈরি, ‘স্বপ্ন যে তুই’ ২০০৮ সালের হিন্দি ‘জানে তু ইয়া জানে না’ থেকে, ‘প্রেম করব তোমার সাথে ১৯৯৪ সালের হিন্দি ‘দিলওয়ালে’ এবং ২০১৩ সালের তেলেগু ছবি ‘নায়ক’র নকল। ‘ব্ল্যাকমেইল’ হিন্দি ‘গুণ্ডে’ ছবির নকল। ‘আজব প্রেম’ তামিল ‘আরিয়া টু’ ছবির হুবহু নকল। যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘আশিকী’ করেছেন নুসরাত ফারিয়া। এ সিনেমাটিও তেলেগু ভাষার চলচ্চিত্র ‘ইশক’ এর নকল। এর আগেও ঢাকায় ‘ইশক’ সিনেমার নকল করে ‘লাভ স্টেশন’ শিরোনামের একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়েছিল। ‘ওয়ার্নিং’ সিনেমাটিও ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া তামিল ছবি ‘রামানা’ এবং ২০০১ সালের ছবি ‘সিটিজেন’-এর নকল।
বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে তামিল, তেলেগু, হিন্দি সিনেমার নকল করে সিনেমা নির্মাণ করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশ হচ্ছে। এছাড়া চলচ্চিত্র অঙ্গনসহ দর্শকদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে পরিচালক, শিল্পীসহ কলাকুশলীদের। কিন্তু এ নিয়ে পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পীদের যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই। তারা নিয়মিত নকল সিনেমা নির্মাণ করে দর্শকদের ধোকা দিয়ে যাচ্ছেন। এই নকলের মতো ভয়াল থাবা থেকে দেশির চলচ্চিত্রের মুক্তি না মিললে ঢাকাই সিনেমার বাজারে বড় ধরণের ধ্বসের আশঙ্কা থেকেই যায়। আসছে ঈদে শাকিব খানের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তি পাচ্ছে তার প্রযোজিত দ্বিতীয় সিনেমা ‘পাসওর্য়াড’। মালেক আফসারী পরিচালিত এ সিনেমায় শাকিব খান অভিনয় করেছেন। এই সিনেমাটি নিয়েও এরই মধ্যে নকলের গুঞ্জন উঠেছে। যদিও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। এবারের ঈদেও ঢাকাই সিনেমা নকলের থাবায় না পরে এমন প্রত্যাশা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের। ঢাকাই চলচ্চিত্র নির্মাণ ও মুক্তির সংখ্যা দিন দিন কমছে। অশ্লীলতার কারণে দীর্ঘদিন হলবিমুখ ছিলো দর্শক। আর এখন নকলের কারণে তারা চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। চলচ্চিত্রের এই নকলের ভয়াবহতা এতটাই যে বছরের প্রায় ৯০ ভাগ সিনেমা নকলের অভিযোগে অভিযুক্ত। মেধাশূন্যরাই নকলের মত গর্হিত কাজ করেন। কিছু অসাধু লোক পরিশ্রম না করে রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হতে নকলের আশ্রয় নিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্র ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। চলচ্চিত্রের এই অবস্থায় সেন্সর বোর্ড আরো সর্তক হলে হয়তো মৌলিক গল্পের সিনেমা নির্মাণ সংখ্যা বাড়বে। আবার হলমুখী হবেন সিনেমাপিপাসু মানুষ। ফিরে আসবে সেই চলচ্চিত্রের সোনালী অধ্যায়। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মে ২০১৯/রাহাত/তারা