হুমায়ূনকে প্রথম দেখি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ শুটিংয়ের সময়। ঢাকা থেকে যেদিন টিম চট্টগ্রাম গেল, সরয়ার ভাই সবাইকে ডেকে হুমায়ূনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ও এখন থেকে আমাদের সাথে কাজ করবে। সবার সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হলেও, মারজুক ভাইকে দেখলে হুমায়ূন কেন জানি ভয় পেত! মারজুক ভাই হাঁক ছাড়লে হুমায়ূনকে খুঁজে পাওয়া যেত না। চট্টগ্রামের শুটিং শেষ করে যখন টিম ঢাকা ফিরে এলো তত দিনে জীবনের সঙ্গে হুমায়ূনের বেশ ভাব জমে গেছে।আমরা কারণটা খুঁজে বের করলাম। আমাদের মধ্যে জীবন একটু ছোটখাটো তাই হুমায়ূন তাকে নিরাপদ ভাবলো। দেখি প্রায় দিনই দুজন মিলে ছবির হাট, আজিজ মার্কেট— সমানে আড্ডা দিচ্ছে। একদিন জীবন জানাল, হুমায়ূন এখন আর ‘কবীর’ নাই, সে এখন থেকে ‘সাধু’। জীবনের কথায় দেখলাম হুমায়ূনের হাসিখুশি মুখ। সেই থেকেই আমাদের হুমায়ূন কবীর, হুমায়ূন সাধু হয়ে উঠল। আমরা সংক্ষেপে তাকে ‘সাধু’ ডাকতাম।
অসম্ভব মেধাবী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আমাদের সাধু। টিমে জয়েন করাতে আমরাও তার উপর কাজ চাপিয়ে নিজেদের সিনিয়র এডি হওয়ার ভাব নিতাম। সে কিন্তু হাসিখুশি মনে সব মেনে নিল। কীভাবে কীভাবে জানি সাধু আমাদের মধ্যমণি হয়ে উঠল। আমরা যখন এক একটা আইডিয়া শেয়ার করতাম, সাধু ঠিক আমাদের নকল করত। আমি কীভাবে বলি, জীবন কীভাবে বলে, তেজো ভাই কীভাবে বলে, মারজুক ভাই সকালে কিভাবে পেঁপে সিদ্ধ খায়— অভিনয় করে দেখাত। সাধু খুব তাড়াতাড়ি আমাদের একজন হয়ে উঠেছিল। আমার তৃতীয় কাজ ‘নিশুতি অধিবেশন’ যখন করতে যাই তখন আমার চিফ এডি ছিল সাধু। এখন ভাবলে অবাক হই, কি ভয়ঙ্কর পরিশ্রম করে সাধু তার দায়িত্ব পালন করেছিল। আমরা সব সময় সাধুর আইডিয়া, সাধুর গল্প শোনার জন্যে অপেক্ষা করতাম।
ছবিয়াল রি-ইউনিয়নের সময় যখন ‘চিকন পিনের চার্জার’-এর গল্প শোনাল। মনে আছে সরয়ার ভাই ‘অসাধারণ’ বলে সাধুকে জড়িয়ে ধরেছিল। সাধুর একটা লেখা পড়ে একদিন তাকে গভীর রাতে ফোন দিয়েছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, যত কিছু করিস লেখালেখি ছাড়িস না। তার প্রথম বই ‘ননাই’ যখন বের হলো, তখন সে খুব খুশি ছিল। এখনো সেই দিনগুলোর স্মৃতি ঝলঝল করছে। ‘পুতুলের সংসার’ নাটকের লোকেশন দেখতে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি, নবীরসহ আরো কয়েকজন। এর মধ্যে একটা মাইক্রো বাস এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। দেখি দরজা খুলে নামছে সাধু। হাসিমুখে আমাদের জানাল ‘চিকন পিনের চার্জার’র একটা সিকোয়েন্স হবে কিন্তু লোকেশন খুঁজে পাচ্ছি না। এই কথা বলে সাধুর মুখে হাসি। একটু পর রাশেদ জামান নেমে আসতেই সাধু গম্ভীর হয়ে গেল। রাশেদ ভাই ওকে তাড়া দিতেই বলল, গেলাম গা। সাধু চলে গেল। সাধু যে কোনো জায়গায় যে কোনো মুহূর্তে পানির মতো মিশে যেতে পারত। অপরিচিত কাউকে যে কোনো সময় আপন করে নিতে পারত, বন্ধু বানিয়ে ফেলত। এটা সাধুর একটা বড় গুণ!
গত কয়েকদিন ধরে সাধু মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম সাধুর জন্য এসব কোনো বিষয় না, যে কোনো মুহূর্তে রুম থেকে বের হয়ে ডাক দিবে— এই সুজাইন্না। মোবাইলে সাধুর একটা ছবি দেখাচ্ছিল আশফাক। ইন্ডিয়া যাওয়ার জন্য সাধু বসে বসে অর্ডার দিয়ে কাপড় গুচ্ছাছিল। হাসিমুখের একটা ছবি, আমার কাছে সাধু ঠিক এই রকম—, সব সময় হাসিমুখ প্রাণোচ্ছল। যার সামনে মন খারাপরা দৌড়ে পালায়।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র একটা কথা লিখেছিলেন, ‘যারা লিখিতে জানে না, অর্থাৎ যাহাদের লেখার পরখ হয় নাই, তাহারা যত বড়ই লোক হোক, না জানিয়া তাহাদের দীর্ঘলেখা ছাপিবার অনেক দুঃখ। ইহারা মনে করে সব কথাই বুঝি বলা চাই। যা দেখে, যা শুনে যা হয়, মনে করে সমস্তই লোককে দেখানো শোনানো দরকার। কিন্তু দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সে টের পায়, না তা নয়, অনেক বলিবার লোভ সংবরণ করিতে হয়। বলার চেয়ে না বলা অনেক শক্ত। অনেক আত্মসংযম, অনেক লোভ দমন করিলে, তবেই সত্যিকারের বলা হয়ে ওঠে।’
সাধুর কাজ দেখলে, লেখা পড়লে আমার এই কথাটিই বারবার মনে হয়। সাধু লোভটাকে খুব শক্ত হাতে দমন করেছিল।
লেখক: চিত্রনির্মাতা ঢাকা/মারুফ/তারা