আমার ধারণা চাপে পরে আমরা আজকাল অনেক বেশি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছি। আগে কাউকে কোনো সেমিনার, কনফারেন্স বা ওয়ার্কশপে বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ জানাতে হলে আয়োজকরা দশবার চিন্তা করতেন। আজকাল চোখ বন্ধ করে ই-মেইল পাঠিয়ে দেন! আমাদের আমন্ত্রণ জানালেও আগে নানাভাবে ছুতো খুঁজে বের করতাম যেন যেতে না হয়— আজকাল সেটাও করা যায় না। যারা আয়োজক তাদেরও অনেক সুবিধা, হলঘর ভাড়া করতে হয় না, হোটেল খুঁজতে হয় না, লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে হয় না, প্রধান অতিথির পেছনে ঘুরতে হয় না। কয়দিন আগে সেরকম একটি অনুষ্ঠানে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের প্রধানকে যখন শুভেচ্ছা বক্তব্য দেওয়ার কথা বলা হলো, আমি স্পষ্ট দেখলাম তিনি বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছেন। একটা বালিশ বুকে চেপে ধরে উঠে বসলেন, ল্যাপটপের ক্যামেরার সামনে মুখটা এনে কিছুক্ষণ ভালোভাবে কথা বলে হাই তুলে আবার শুয়ে পড়লেন! আমি যখন বক্তব্য দিচ্ছি তখন আমি খুব দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলাম, আমার কথা কী আদৌ কেউ শুনছে নাকি আমি একা একা নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছি? (ভাগ্যিস বক্তব্যের শেষে প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থা ছিল, অনেক প্রশ্ন দেখে বুঝতে পেরেছিলাম কেউ কেউ নিশ্চয়ই কথা শুনেছেন!)
আজকাল শুধু যে দেশ-বিদেশে ‘শর্টকাট’ সেমিনার, কনফারেন্স হচ্ছে তা নয়, আমরাও দেশ-বিদেশের খবর অনেক বেশি রাখছি। করোনার খবরই বেশি, এমনকি যখন রাজনীতির খবর নিই সেটাও ঘুরেফিরে হয়ে যায় করোনা নিয়ে রাজনীতি! অনেক দেশে মাস্ক পরা এবং না-পরা এখন হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচয়। বিষয়টা যেহেতু প্যানডেমিক তাই শুধু একটা দেশ ভাইরাস মুক্ত হয়ে গেলে হবে না, পৃথিবীর সবাই মিলে একসাথে সবাই মিলে ভাইরাস মুক্ত হতে হবে।
এতদিন শুধু নিজের দেশ নিয়ে দেশের মানুষের সমালোচনা শুনে এসেছি, এই দেশের মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি মানে না, মাস্ক পরে না, অকারণে এখানে-সেখানে ভিড় জমায়, ইত্যাদি ইত্যাদি! এখন দেখছি এটা শুধু আমাদের দেশের নয়, অন্য দেশেরও সমস্যা। জার্মানির বার্লিন শহরে হাজার হাজার মানুষ আমাদের দেশের বৈশাখী মিছিলের মতো রাস্তায় বের হয়ে চিৎকার করছে, তারা মাস্ক পরবে না, নিয়ম নীতি মানবে না! আমেরিকা রীতিমত বিপজ্জনক! এই দেশে সবার কাছে অস্ত্র, যারা মাস্ক পরে নেই তাদেরকে মাস্ক পরার কথা বললে রেগেমেগে গুলি করে দেয়। করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যুর দিকে তারা পৃথিবীর এক নম্বর। সুইডেনের বুড়ো মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে নিশ্চয়ই সেই দেশের অর্থনীতির উপর খুব চাপ পড়ছিল তাই এই ধাক্কায় তারা দেশের সব বয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলে ঝাড়া হাত-পা হয়ে গেছে।
ভিয়েতনামকে দেখে আমরা সবসময়ই মুগ্ধ হই, এবারেও তারা যেভাবে দেশকে ভাইরাসমুক্ত রেখেছিল সেটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে শেষ রক্ষা হলো না। এখন তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেদিন দেখলাম তারা আস্ত একটা শহরের সব মানুষকে করোনার জন্য টেস্ট করবে। রাশিয়া অক্টোবর মাস থেকে তাদের দেশের মানুষকে করোনার জন্য টিকা দিতে শুরু করবে, মনে হচ্ছে সবার আগে। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের নাক সিটকানো এবং সমালোচনা শুরু হয়েছে, তারা বলছে তাদের আগে কেউ নেই, তাদের থেকে ভালো টিকা কারো নেই! (রাশিয়া বলছে তারা সবার আগে টিকা দেবে ডাক্তার এবং শিক্ষকদের। ডাক্তারদের ব্যাপারটা আমরা বুঝি কিন্তু শিক্ষকদের গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছে! সত্যিই তো, একটা সমাজে শিক্ষক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আর কে আছে?)
পৃথিবীর অন্যান্যদের মাঝে যারা টিকা বানাচ্ছে তাদের মধ্যে একটা কোম্পানি খোলাখুলি ঘোষণা দিয়েছে টিকা বিক্রি করে তাদের টাকা বানানোর মতলব আছে! পোলিও রোগের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন জোনাস সাল্ক, তাঁকে তাঁর আবিষ্কারটি পেটেন্ট করার জন্য সবাই পীড়াপীড়ি করেছিল, তিনি রাজি হননি, বলেছিলেন, সবকিছু পেটেন্ট করা যায় না। সূর্যকে কেউ পেটেন্ট করতে পারবে? অস্ট্রেলিয়া এতদিন ভালোই ছিল, এখন ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য ভিক্টোরিয়া রাজ্যে তারা মিলিটারি নামাচ্ছে। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক মনে হয় ব্রাজিলের অবস্থা, সেখানকার প্রেসিডেন্টের একগুয়েমির কারণে কোনো স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেখানে টিকতে পারে না, শেষবার যখন খোঁজ নিয়েছি তখন কোনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীই ছিল না। সেখানে দিনে প্রায় একহাজার মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছে।
যাই হোক, পৃথিবী এখন একটা বিচিত্র সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। শত বছরেও পৃথিবীর এরকম অভিজ্ঞতা হয়নি। অভিজ্ঞতা বিষয়টি খারাপ নয়, কিন্তু এই অভিজ্ঞতা না হলেও মনে হয় চলতো!
ক’দিন আগে আমাদের বাংলাদেশ নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেখতে পেয়েছি। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির কাছে নয়শ এন্টিবডি কিট পাঠানো হয়েছে, এটা দিয়ে একজনের শরীরে করোনার এন্টিবডি আছে কি নেই বের করা যাবে। যদি এন্টিবডি থাকে তাহলে ধরে নেওয়া যায় তার ইতোমধ্যেই করোনার সংক্রমণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি তাদের এই কিটগুলো দিয়ে তাদের পরিচালিত হাসপাতালে স্বাস্থ্য কর্মী এবং সাধারণ কর্মীদের পরীক্ষা করেছে। ফলাফল আমার জানামতে বাংলাদেশের প্রথমবার প্রকাশিত এরকম একটি তথ্য। যারা স্বাস্থ্যকর্মী তাদের ভেতর শতকরা ২৫ জনের এর মাঝে করোনার সংক্রমণ হয়ে গেছে, যারা সাধারণ কর্মী তাদের মাঝে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। যার অর্থ গড়ে এখানে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষের এর মাঝে করোনা হয়ে গেছে। (কলকাতা শহরে এর সংখ্যা হচ্ছে ১৭ শতাংশ। মুম্বাইয়ের বস্তিতে প্রায় ৬০ শতাংশ!)
যদি আরো বেশি করে আরো বিভিন্ন এলাকায় আরও অনেক মানুষকে এভাবে পরীক্ষা করা যেত তাহলে সংখ্যাটি আরো নিশ্চিতভাবে বলা যেত। কিন্তু আমরা মোটামুটি অনুমান করতে পারি, এই এলাকায় প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের নিশ্চয়ই করোনা হয়ে গেছে। যার অর্থ বাইরে আমরা যাদেরকে ঘোরাঘুরি করতে দেখি নিশ্চয়ই তাদের ভেতরে একটা অংশ আসলে করোনায় সংক্রমিত, তাদের দর্শনীয় কোনো উপসর্গ নেই, তাই আমরা তাদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারি না; তারা নিজেরাও হয়তো জানে না। কিন্তু হয়তো সবার অগোচরে তারা অন্যদের কম বেশি সংক্রমিত করে যাচ্ছে! আমি অন্তত দুই জনের কথা জানি যারা পুরোপুরি সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেও করোনায় সংক্রমিত হয়েছে এবং যথেষ্ট ভোগান্তির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
কলকাতায় শুধু যে এন্টিবডি টেস্ট হচ্ছে তা নয়, সেখানে এন্টিজেন টেস্টও শুরু করা হচ্ছে, যেটা করে দ্রুত কোভিড সংক্রমণ বের করা যায়, যদিও এই পদ্ধতিটা অনেক কম নির্ভরযোগ্য। কিন্তু অনেক দ্রুত, অনেক কম খরচে, অনেক বেশি টেস্ট করা যায় বলে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এটা খুবই কার্যকরী। বিশেষজ্ঞরা বলে যাচ্ছেন এন্টিজেন টেস্ট করে যাদের করোনা আক্রান্ত পাওয়া যাবে তাদের যদি কিছুদিন ঘরে থাকতে বলা হয় তাহলেই রোগ অনেক নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
আমি আমাদের কমনসেন্স দিয়ে বুঝতে পারি একটা সমস্যা সম্পর্কে যত বেশি খুঁটিনাটি জানা যায় সমস্যাটা ততো ভালোভাবে সমাধান করা যায়। তাহলে কেন আমরা আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনি না? কেন আমরা ব্যাপকভাবে এন্টিবডি টেস্ট শুরু করি না? কেন আমরা এন্টিজেন টেস্টও শুরু করি না? সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের দেশের গণস্বাস্থ্য থেকে এই দুটি টেস্টেরই কিট তৈরি করা হয়েছে। এই সুযোগটি কেন আমরা গ্রহণ করছি না? যদি সত্যিই কর্মকর্তাদের দেশের প্রযুক্তির উপর বিশ্বাস না থাকে তাহলে কিটগুলো বাইরে থেকে আমদানি করলে কী হয়? সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যাটাকে বোঝা! সমস্যা বোঝার জন্য প্রয়োজন হলো তথ্য এবং তথ্য। কেন সেই তথ্য আমরা সংগ্রহ করি না? আমরা সমস্যাটা বুঝতে চাই না? সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে চাই?
খবরে দেখেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। একসময় পরিচিত কাউকে কারোনায় আক্রান্ত হতে দেখতাম না। এখন প্রায়ই দেখছি। আশা করছি, অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন, তাদের জন্য রইলো অনেক শুভকামনা।
০৫ আগস্ট ২০২০