বিকেলে নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সরোয়ার ও আমাকে বঙ্গভবনে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। কিন্তু আমরা না গিয়ে অফিসে থেকে যাই। খবর পাই, বঙ্গবন্ধুর সরকারের মন্ত্রীদের বেশির ভাগই নতুন মন্ত্রিসভায় শপথ নিয়েছেন। খন্দকার মোশতাক তাদের মন্ত্রী করে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেয়েছে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তিত হয়নি, কেবল পরিবর্তিত হয়েছে ব্যক্তির।
আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আচরণে। বাকশাল গঠনের পরপরই ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ মওলানা ভাসানীর সাদর আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টাঙ্গাইলের কাগমারী সফরে গিয়েছিলেন। এই সফরে আমিও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। কাগমারীতে লক্ষাধিক মানুষের এক জনসভায় মওলানা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান এবং দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, তিনি মুজিবের নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন যেভাবে সমর্থন করেছিলেন, সেভাবেই তার দ্বিতীয় বিপ্লবকেও সমর্থন করে যাবেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর পা স্পর্শ করে সালাম করেছিলেন, আর মওলানা ভাসানী পিতৃস্নেহে বঙ্গবন্ধুকে আশীর্বাদ করেছিলেন। এ দৃশ্য আমি কৌতূহল নিয়ে দেখেছি। সেই মওলানা ভাসানী মাত্র পঁচ মাস পর তার অতীত রাজনীতির মতো আবারও ডিগবাজি খেলেন। তার পুত্রতুল্য মুজিবকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের অভিনন্দন জানাতে তার বিবেকে এতটুকুও বাধল না! তা-ও এমন সময় ঘৃণিত ঘাতকদের অভিনন্দন জানালেন, যখন শেখ মুজিবুর রহমানের পবিত্র দেহের রক্ত শুকায়নি এবং তাকে সমাহিত পর্যন্ত করা হয়নি। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, যে স্বার্থান্বেষী মহলের মন্ত্রণায় মওলানা ভাসানী এই জঘন্য কাজটি করেছিলেন, তারা পরে তার পাশে থাকেনি। এমনকি তার মৃত্যুবার্ষিকীতেও তাদের দেখা যায় না।
১৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আমাকে ফোন করে জানান যে জরুরি কথা আছে। সরোয়ার ও আমাকে বঙ্গভবনে যেতে হবে। আমরা বঙ্গভবনে গিয়ে দেখি খালেদ মোশাররফ ভীষণ ব্যস্ত। তিনি নিজ উদ্যোগে এক জরুরি ‘অপারেশন রুম’ স্থাপন করেছেন। সেখানে আমাদের সীমান্ত এলাকা থেকে বিদ্যুৎবেগে তথ্য আসছে- ভারতীয়রা কোথায় কোথায় সেনাসমাবেশ ঘটাচ্ছে আর ট্যাংকবহর মোতায়েন করছে ইত্যাদি। তার ও অন্য কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা দেখে মনে হলো, ভারত যেকোনো সময় বাংলাদেশ আক্রমণ করতে পারে এবং তারা সেই আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যবস্থা করছেন। আমরা বেশ কিছুক্ষণ খালেদ মোশাররফের নতুন অপারেশন কক্ষে থাকলাম। কিন্তু ভারত সীমান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোনো তৎপরতা বা নির্দেশ দেখলাম না। ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমাদের কেন ডেকেছেন, সে সম্পর্কে কিছু বললেন না। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে অন্য কাজে বেশি ব্যস্ততা দেখালেন। তবে আমরা ঠিকই বুঝতে পারলাম যে, ভারত বাংলাদেশ আক্রমণের তৎপরতা দেখাচ্ছে, এই মর্মে আমাদের তিনি ধোঁকা দিতে চাচ্ছেন। আমরা সামরিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হলেও সাধারণ জ্ঞানহীন তো নই। নয় মাস যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের, হাজার লেখাপড়া করেও যা অর্জন করা যায় না।
বঙ্গভবনে দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর খুনিরা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে ভীষণ ব্যস্ত। তাদের মধ্যে একটা উৎসব ভাব। আমীন আহম্মেদ চৌধুরীকে দেখা গেল তিনি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি বনে গেছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ মতিন বীর প্রতীককে দেখা গেল বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে। জিয়াউর রহমান, বিডিআর-প্রধান খলিলুর রহমান, পুলিশ-প্রধান এ কে নুরুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার মসহরুল হক একটা কক্ষে কথাবার্তা বলছিলেন। এমন সময় জিয়াউর রহমান আমার কাছে এসে জানতে চান, তোফায়েল আহমেদ আমাদের ওখানে আছেন কিনা? তার এ কথায় আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। অবশ্য সেটা কেটে যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। আমি উত্তর দেওয়ার আগেই তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে, রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয় থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে নেবেন। এ কথায় আমি কিছুটা আশ্বস্ত হই। তাকে বলি, তোফায়েল আহমেদ আমাদের এখানে আছেন। পরে রাত ১০টায় ঢাকার সিটি এসপি আবদুল সালামকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। তিনি তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে যান। কিন্তু তোফায়েল আহমেদকে কোথায় নিয়ে যাবেন, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না। এ ব্যাপারে তাকে কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। তাই তিনি তোফায়েল আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে না নিয়ে বাসায় রেখে আসেন। এটা আমি পরে জানতে পারি। ক’দিন পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা তাকে বাসা থেকে আটক করে। তাকে নির্যাতনও করে তারা। পুলিশ হেফাজতে থাকলে হত্যাকারীরা এটা হয়তো করতে পারত না।
এদিকে আমাদের কেন বঙ্গভবনে যেতে বলা হয়েছে, তা বুঝতে পারছি না। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর আমরা ফিরে আসতে চাইলে খালেদ মোশাররফ আমাদের বললেন, দেশে সামরিক আইন জারি হতে পারে। সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। এ জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিডিআর এবং রক্ষীবাহিনীর সদস্যদেরও প্রয়োজন হবে। আমরা দুজনই খালেদ মোশাররফকে বলি, আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান লন্ডন থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারব না।
সরোয়ার ও আমি রাতে সিদ্ধান্ত নিই, আমরা বাড়ি যাব না, অফিসেই থাকব। পরদিন আমরা রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার খন্দকার নাজমুল হকের সঙ্গে কথা বলি। বুঝতে চেষ্টা করি আমরা সেদিকে গেলে সহযোগিতা পাওয়া যাবে কিনা।
নাজমুল হুদা যেসব কথা বললেন তা খুব আশাব্যঞ্জক ছিল না। এমতাবস্থায় আমরা এ এন এম নূরুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লন্ডনে ফোন করার চেষ্টা করেও লাইন পাওয়া গেল না। পরে জানতে পারি, তখন বিদেশের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। এদিকে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর পেয়ে সাভারে রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে দুজন রক্ষী সদস্য আত্মহত্যা করেন। যে দুজন সদস্য আত্মহত্যা করেন তাদের নাম এখন আমার মনে নেই। অন্যদের মধ্যেও গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। কয়েকজন রক্ষী আবার প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে পালিয়ে যান। এ পরিস্থিতিতে আমাদের ৪ নম্বর ব্যাটালিয়নকে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৈরি রাখা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য সীমিত অস্ত্র-গোলাবারুদ যা ছিল তা ইস্যু করা হয়। এ খবর সেনাসদরে পৌঁছালে তারা ধারণা করেন রক্ষীবাহিনী হয়তো সশস্ত্র প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান যে তারা শুনেছেন, সাভারে রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাই তিনি রক্ষী সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে সাভার যেতে চান। আমি তাকে জানাই, রক্ষীবাহিনী প্রতিটি ক্যাম্পেই উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে আমাদের আদেশ ছাড়া কোনো ক্যাম্পেই কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। কারণ, আমাদের কমান্ড ও কন্ট্রোল অটুট আছে, তার পরও মইনুল হোসেন চৌধুরী সাভার যেতে চান। আমি তাকে বলি, আপনি যেতে পারেন কিন্তু সঙ্গে কোনো সেনা নিয়ে যাবেন না। সেনা দেখলে রক্ষী সদস্যরা অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়বে। আমিও আপনার সঙ্গে যাব, তাহলে আপনার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে না।
পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৭ আগস্ট সকালবেলা মইনুল হোসেন চৌধুরী আমাদের প্রধান কার্যালয়ে আসেন। সেখান থেকে আমরা একত্রে সাভার যাই। তিনি লিডার ও রক্ষীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটান। এ সময় তিনি সবার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তিনি দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন। সব রক্ষীকে সামরিক বাহিনীতে নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন এবং অর্জিত স্বাধীনতা যাতে বিপন্ন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেন। তারপর আমরা একসঙ্গে ঢাকায় চলে আসি। সাভারে মইনুল হোসেন চৌধুরী ভালো ভালো কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার তার আসল উদ্দেশ্য কী ছিল সেটা স্পষ্ট ছিল না। পরে তিনি আমাকে বলেছেন, সেনাপ্রধান ও উপপ্রধানের নির্দেশে তিনি সাভার গিয়েছিলেন।
এদিকে তখন ভারতের নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এম এ মঞ্জুর (মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর)। তিনি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরপরই কদিনের জন্য ঢাকা আসেন। কার আদেশে, কীভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন তা ছিল অনেকটা রহস্যাবৃত। তবে তাকে প্রায় সময়ই জিয়াউর রহমানের আশপাশে দেখা যেত। রক্ষীবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেছিলেন। আমাদের সঙ্গে কথা হয় মূলত রক্ষীবাহিনীকে এক রাখা এবং গোটা বাহিনীকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে। শেষ পর্যন্ত আমরা তার কথায় রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে একমত হই।
খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা গ্রহণ এবং মন্ত্রিসভা গঠন করেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেপ্তার করতে থাকেন। ২৩ আগস্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এম মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে যারা তাঁকে সমর্থন করতে এবং তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকার করেন, তাদের বন্দী করেন। অনেকে আত্মগোপন করে ছিলেন। নেতাদের গ্রেপ্তারের ফলে দেশে এক ভয়ঙ্কর ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকার ভাব দেখে মনে হয়েছে, ৩০ লাথ মানুষের রক্ত গড়া বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি চলছে উল্টো পথে। অনেকের ধারণা হয়, বাংলাদেশই হয়ে গেল পাক বাংলা। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে যে পাকিস্তানের বহুল আলোচিত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর এজেন্ট লুকিয়ে ছিল, তা-ও স্পষ্ট হয়। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ৪ আগস্ট থেকেই তার বাড়িতে নজরবন্দী দেখা গেল।
তখন আমাদের একটাই চিন্তা, কী করে এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা তখনও সর্বদা প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের সমর্থন দরকার সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে। এর মধ্যে আভাস পাওয়া গেল, খালেদ মোশাররফ ওপরে ওপরে যতই ঘৃণিত ঘাতক আর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক গংয়ের পক্ষে থাকুন না কেন, আসলে তিনি সুযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে না পারায় হয়তো বিবেকের দংশনে ভুগছেন। সুযোগ পেলে তিনিও ব্যবস্থা নেবেন এ বিশ্বাস আমাদের ছিল। ঠিক এই বিশ্বাস থেকে দিন কয়েক পর একদিন আমরা তাকে আমাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আমন্ত্রণ জানাই। ২৪ আগস্ট সকালবেলা কে এম সফিউল্লাহ সাভারে আসেন এবং রক্ষীদের সমাবেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি রক্ষী সদস্যদের সতর্ক ও শান্ত থাকতে বলেন। সেদিন আমরা, বিশেষত সরোয়ার ও আমি, আকারে ইঙ্গিতে তাকে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, প্রয়াজনে তার পাশে আমরা থাকব। কে এম সফিউল্লাহ এটা অনুধাবন করেছিলেন কিনা, আমি জানি না। এ নিয়ে সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলার পর্যায়ে আমরা ছিলাম না। প্রকৃতপক্ষে বাহিনীর শৃঙ্খলা অনুযায়ী আমাদের মতো স্তরের কর্মকর্তাদের সরাসরি সেনাপ্রধানসহ উচ্চপদস্থ কারও সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলার সুযোগ ছিল না। তবে শুরু থেকে সরোয়ার ও আমি রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে তখনকার সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদস্থ অনেকের সঙ্গে আমাদের চেনাজানা হয়। কারও কারও সঙ্গে, বিশেষত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু সেটা সীমাবদ্ধ ছিল ব্যক্তিগত কার্যাবলির মধ্যেই।
যা হোক, আমাদের এই প্রচেষ্টাও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। কারণ, ওই দিন সন্ধ্যাবেলা বেতার ও টেলিভিশনে ঘোষণা প্রচার করা হলো যে, কে এম সফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীর প্রধানের পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। তার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। ১৫ আগস্ট থেকে আমরা গভীরভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলাম। ঘোষণা শুনে আমরা বুঝতে পারলাম, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের পছন্দ অনুযায়ী জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধানের পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খন্দকার মোশতাক ভালো করেই জানত, জিয়াউর রহমান অনেক উচ্চাভিলাষী। তাকে নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে সহজ হবে না। সে জন্য তার পরামর্শে জিয়ার বিরোধী এম এ জি ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এবং তাদের দুজনের সঙ্গে সংযোগ মাধ্যম হিসেবে পাকিস্তান-প্রত্যাগত উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা খলিলুর রহমানকে (তিনি জিয়ার চেয়ে অনেক সিনিয়র ছিলেন) চিফ অব দ্য ডিফেন্স স্টাফ নিযোগ করা হয়। তারা দুজনই আবার খালেদ মোশাররফকে পছন্দ করতেন। এ জন্য খালেদ মোশাররফকে সিজিএস পদেই রাখা হয়। যদিও অনেকে ধারণা করেছিলেন, খালেদকে অপসারণ করে মেজর জেনারেল জিয়ার পছন্দমতো এম এ মঞ্জুরকে সিজিএস করা হবে। তা না হওয়ায় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হয়েও পুরোপুরি ক্ষমতাবান হতে পারেননি। অন্যদিকে খন্দকার মোশতাক আর এম এ জি ওসমানীর হয়তো ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান করার ইচ্ছা ছিল। (চলবে)
লেখক: মুক্তিযুদ্ধকালীন কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান ছিলেন। পরবর্তী সময়ে রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আরো পড়ুন :
**রক্ষিবাহিনীর ভাষ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড (২য় পর্ব)
**রক্ষিবাহিনীর ভাষ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড