মতামত

পদ্মা সেতু নিয়ে অপপ্রচারকারীদেরও জাতি মনে রাখবে

রাজনীতিতে কুটচাল নতুন কিছু নয়। মিথ্যার ফুলঝুরি তৈরি করে মানুষের মনে প্রতিপক্ষের জন্য বিদ্বেষ তৈরি করাও পুরনো কৌশল। কিন্তু এই বিদ্বেষ তৈরি করতে গিয়ে যদি সরাসরি দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটে তাহলে মানুষ সেই মিথ্যাকে সহজভাবে নেয় না। যারা এভাবে অপপ্রচারে মেতে ওঠে তারা এক সময় জনগণের হাসির পাত্রে পরিণত হয়। এবং এর কারণ দেশবাসীর অজানা থাকে না।

‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে’- এভাবেই দেশের জনগণকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। অপপ্রচার আর মিথ্যাচার করে পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে অবস্থান, ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কারা এগুলো করেছেন পাঠকমাত্র তা জানেন। উল্লেখিত কথাগুলো দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং সাবেক বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার। তিনি ছাত্রদলের এক আলোচনা সভায় এমন মন্তব্য করে ব্যক্তি চিন্তা-দর্শন শুধু নয়, দেশের প্রতি তিনি কতটুকু দায়বদ্ধ, কী ধরনের স্বপ্ন লালন করেন- এটিও তুলে ধরেছেন।

একটি সরকারের নানা রকম কাজের ব্যর্থতা, রাষ্ট্রযন্ত্রের অদক্ষতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সরকারের এমপি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ আমলাদের দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা যায়। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা কিংবা ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসের ঊর্ধ্বে উঠে সার্বজনীনভাবে এগিয়ে যাওয়ার, বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ায় তিনিও স্বপ্ন-সাহস দেখাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে একজন দায়িত্ববানের জায়গায় থেকে তিনি দেশের বিরুদ্ধে, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেদিন। ভাবতে অবাক লাগে, একদিন তিনি দেশ শাসন করেছেন। যেই শাসন ক্ষমতা হারালেন দেশের উন্নয়নে সমালোচনামুখর হয়ে উঠলেন!

এখানে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব অর্থনীতির গবেষকরা জানেন, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অর্থনীতি বদলে যাবে। আরও বিস্তারিত বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যদিও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজটি কঠিনই ছিল না, মিথ্যাচার-অপপ্রচারের অদৃশ্য ষড়যন্ত্রও এর সঙ্গে জড়িত ছিল।

আমাদের মনে রাখা উচিত, একসময় আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নদীমাতৃক। মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের পর সড়ক যোগাযোগের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। আর সেসময় বড় ধরনের বাধাও ছিল এসব নদ-নদী। যে কোনো সড়ক তৈরি করতে হলে আমাদের ছোট-বড় খাল, বিল আর নদী নিয়ে পরিকল্পনা করতে হতো। নদীর নানাবিধ সমস্যার সমাধান করতে হতো। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধনের আগে উত্তরাঞ্চলের মানুষ কখনও ভাবতে পারেননি তারা সকালে রওনা দিয়ে দুপুরে ঢাকায় কাজ শেষ করে সেদিনই বাড়ি ফিরতে পারবেন।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সেতু। এর মাধ্যমে লৌহজং, মুন্সিগঞ্জের সঙ্গে শরিয়তপুর ও মাদারীপুরকে যুক্ত করা হয়েছে। যে কারণে এই সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের মেলবন্ধন হবে, এক অনন্য সংযোগ ঘটবে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেতু না হলেও, এটি সবচেয়ে আলোচিত সেতু। দেশের সকল গণমাধ্যমের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়াতেও ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্প্যান বসানোর আগে-পরের সংবাদ প্রচার, প্রকাশ ও সম্প্রচার করা হয়েছে। ৪২টি খুঁটির উপর ৪১টি স্প্যান বসানোর পর পদ্মার দুই পাড়ের মানুষই শুধু নয়, স্বাধীনতাকামী বাঙালির স্বপ্নগুলো যুক্ত হয়েছে। অথচ এই স্বপ্নকে তুচ্ছজ্ঞান করে বক্তব্য দিয়েছেন খালেদা জিয়া। সবচেয়ে দুঃখজনক, স্বাধীনতাবিরোধী মহলের সঙ্গে এদেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ, সুশীলসমাজখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিরাও তাদের নোংরা ষড়যন্ত্রের মুখোশ লুকিয়ে রাখতে পারেননি। তারা জোর করে তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ চাপিয়ে দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চেয়েছিলেন। দেশের উন্নয়নের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে দেশের জয়যাত্রা রুখতে চেয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন ‘আমাদের অর্থনীতি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চাপ নিতে পারবে না।’

২০১২ সালের জুলাই মাসের ১০ তারিখ এ দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিন নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়ে সর্বপ্রথম কথা বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘নিজ অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।’ এর পরের বছর ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ঘোষণার মাধ্যমেই দেশবাসী নিশ্চিত হয়ে যায়, ষড়যন্ত্রের শিকার দাতাদের রীতিমত চ্যালেঞ্জ করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং কাজের উদ্বোধনের পর সেদিন জনসভায় বিশ্বব্যাংকের টালবাহানা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনে। আমি বলি, দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে। কারণ তখনও টাকা ছাড় হয়নি। আজ পর্যন্ত তারা প্রমাণ করতে পারে নাই যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে।’ শেখ হাসিনা আরো বলেছিলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি, আমরা তা দেখাব। আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি।’

বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে এসে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যা বলেছেন, করে দেখিয়েছেন। তিনি সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছেন, মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। স্বাধীনতাবিরোধী ব্যতিত, একটি দেশে নানান মত ও পথ থাকবে, আলোচনা-সমালোচাও থাকবে, রাজনৈতিক ভিন্নতা, আদর্শ আর দৃষ্টিভঙ্গীও থাকবে। আবার প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও নেতার পরিকল্পনাও ব্যতিক্রম হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের স্বার্থে, দেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে বিভেদ থাকবে কেন? কেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি-মিথ্যাচার আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হবে? কেন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে অপপ্রচারের আশ্রয় নিতে হবে?

একটি দেশ তখনই উন্নয়নের সঙ্গে বহির্বিশ্বে তার আত্মমর্যাদা নিয়ে এগিয়ে চলে, যখন সেদেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে দেশের জনগণ সম্পৃক্ত থাকে। পদ্মাসেতুর সঙ্গে এদেশের মানুষের স্বপ্ন, আবেগ জড়িত। সেই আবেগ নিয়ে যারা মিথ্যাচার করেছিলেন তাদের মুখোশ আজ খুলে গেছে। তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আজ জাতির সামনে স্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং আর ভয় কি- দেশের এই জয়যাত্রা রুধিবে সাধ্য কার? 

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)