মতামত

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান, চীন ও ভারতের ভূমিকা   

মিয়ানমারে সেনাবাহিনী একটি শান্তিপূর্ণ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুনরায় দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে দেশটির একসময়ের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিসহ প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট এবং তাদের দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের।

সু চি, যিনি প্রায় দুই দশকের গৃহবন্দিত্ব শেষে ২০১০ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন, তার ১০ বছর কাটতে না কাটতেই আবারও বন্দি হলেন! রাজনীতিতে সু চি’র জীবন বৈপরীত্যে ভরা। ‘এশিয়ার ম্যান্ডেলা’খ্যাত তার যে ইমেজ একসময় ছিল সেটা আর এখন নেই। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে তার দল এনএলডি ক্ষমতায় এলে শুরু হয় তার সমালোচিত হওয়ার অধ্যায়। তিনি প্রত্যাশার উল্টো কাজ করেছেন ক্ষমতার মেয়াদজুড়ে। মানবাধিকার রক্ষার অক্লান্ত সৈনিক এবং গণতন্ত্রপন্থি ছিলেন বলে যে সু চি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন ক্ষমতায় গিয়ে তাকেই আবার দেখা গিয়েছিল বর্মি সেনার সমর্থক হিসেবে মানবতাবিরোধী কাজে সমর্থন দিতে।

অং সান সু চি’র নির্বাচিত সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে ক্ষমতা নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। শঙ্কার কারণ হলো, এবারের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চি’র রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সম্ভবত ইতি টানা হয়ে গেল! বর্তমান বয়স এবং নানা শারীরিক জটিলতা হিসেবে নিলে এটাই বাস্তবতা। কারণ,  সহসাই সেনাবাহিনী  ক্ষমতা ছাড়বে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা সু চিকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না।

যে সু চি সম্পর্কে বলা হচ্ছিল, সেনাবাহিনীর নীতি গ্রহণ করে ক্ষমতায় আছে তারাই কেন তাকে সরিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নিলো? এর কারণ হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর চাওয়াকে প্রাধান্য না দিয়ে ভোটারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটের বাইরে রাখা হয়েছিল সু চি’র প্রেসক্রিপশন মেনে। তদুপরি, জাতীয় ও রাজ্য পর্যায়ে যেখানে সু চি’র দল এনএলডি’র প্রভাব কম সেখানে ভোটের ব্যবস্থা করা হয়নি। এসবের পাশাপাশি নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকেও নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়। এসবের ইক্যুয়েশনে সু চি’র নেতৃত্বাধীন দল এনএলডি গত নির্বাচনের চেয়েও এবার বেশি জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। মিয়ানমারজুড়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলোতে যেখানে ভোট হয় ১ হাজার ১৭১টি আসনে, সেখানে এবার ভোট হয়েছিল ১ হাজার ১১৭ আসনে। তাতে সু চি’র দল একাই পেয়েছে ৯২০ আসন, যা গতবারের চেয়েও ৬৬টি বেশি। অন্যদিকে সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির আসন সংখ্যা গতবারের চাইতেও কমে যায়। তারা মাত্র ৭১টি আসন পায়, যা গতবারের চেয়ে ৪৬টি কম। ফলে ভোটের পর থেকে সেনাবাহিনী নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রতারণার অভিযোগে ফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে।

তাছাড়া  ভোটের পর সেনাবাহিনী সু চি’র সঙ্গে দর-কষাকষি করছিল সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য। কেননা, এমন একটি শঙ্কাও ছিল যে, জেনারেল হ্লাইং অবসরে গেলে তিনি ও অন্যান্য জেনারেলদের রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে সু চি সরকার আর আগের মতো  সুরক্ষা নাও দিতে পারে। অন্যদিকে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থাকলে আন্তর্জাতিক আদালতে তারা সহায়তা পাবেন। ২০১৪ সালে সংশোধিত ডিফেন্স সার্ভিসেস অ্যাক্ট অনুযায়ী, বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় আগামী জুলাই মাসেই অবসরে যাওয়ার কথা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের। এর আগেই সেনাবাহিনী জেনারেল হ্লাইংকে  প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল৷ তবে সু চি’র নেতৃত্বাধীন এনএলডি এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। অন্যদিকে মিয়ানমারের সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরেই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এগুলো নিয়েও সু চি সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছিল। সব দ্বন্দ্বের যোগফলের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে এই অভ্যুত্থান।

তাছাড়া এই অভ্যুত্থানের পেছনে দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত এবং চীনের মদদও বড় ভূমিকা রেখেছে বলে প্রতীয়মান হয়। পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনায় নিলে এটা পরিষ্কার যে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী চীন এবং ভারতের নীরব সম্মতিতেই ক্ষমতার দখল নিতে এগিয়ে গেছে। সু চি’র আটককে ‘মন্ত্রিসভার বড় ধরনের রদবদল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে প্রতিবেশী চীনের মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো। পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে নিন্দা প্রস্তাবও ভেটো দিয়ে আটকে দিয়েছে চীন। তাদের আপত্তির কারণে যৌথ বিবৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গেও দেশটির সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে নিবিড় হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যে বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ভারতকে সহযোগিতা করেছে। তাছাড়া মাত্রই কিছুদিন আগে ভারতের সেনাপ্রধান মিয়ানমার সফর করে এই সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার অঙ্গীকার করেছেন। তাই ভারতও মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে কার্যত তেমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না। মূলত এ কারণেই, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার দখল নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা দেশ একত্রে একটি বিবৃতি দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে 'গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি মেনে চলা’র আহ্বান জানালেও ভারত ও চীন ওই বিবৃতিতে সই করা থেকে বিরত ছিল।

তদুপরি, এই সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা সু চি’র জন্যও একটি বড় শিক্ষা হয়ে থাকলো। কারণ, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করলে তখন অনেকেই ভেবেছিল দোষ সামরিক বাহিনীর, সু চি’র নয়। তবে আসল সত্যিটা ছিল, রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা ও দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো জঘন্য অপকর্মে সু চি সমর্থন দিয়েছিলেন। এমনকি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের শুনানিতে রাখাইন প্রদেশে ঘটে যাওয়া প্রকৃত ঘটনা স্বীকার করার জন্য আটজন নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী সু চিকে আহ্বান জানালেও, সু চি সে আহ্বান অগ্রাহ্য করেন।

সু চি’র ঘনিষ্ঠরাও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে- তিনি ধর্ষণ, হত্যা এবং সম্ভাব্য গণহত্যা রুখতে কোনো পদক্ষেপ নেননি এবং সামরিক বাহিনীর প্রতি নিন্দাজ্ঞাপন করেননি কিংবা তাদের নৃশংসতার মাত্রা স্বীকার করেননি। তদুপরি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকার বারবার অবগত করলেও এ নিয়ে টালবাহানা করে গেছে সু চি সরকার। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় থাকাকালীন ৭০ ও ৯০-এর দশকে  বড় আকারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হলেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ শরণার্থীর নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সু চি কোনো পদক্ষেপই নেননি।

এখন আবারও সামরিক বাহিনী ক্ষমতার দখল নিয়েছে। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে দেশটিতে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানের কী হবে তা ভাবনার বিষয়। নতুন করে সামরিক অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, যে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়েছে, সেই বাহিনীর সদস্যরাই তো রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। ফলে অনুমান করা যায়, রোহিঙ্গা সঙ্কট আরও তীব্র হতে পারে। অন্যদিকে, এই সামরিক অভ্যুত্থানে যেহেতু চীন-ভারত উভয়েরই নীরব সায় রয়েছে ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে অন্তত চীন-ভারত কারও কাছ থেকে তেমন কোনো কার্যকর সহযোগিতা বাংলাদেশ পাবে না। কারণ, নতুন সরকার অবস্থা বুঝতে আরও সময় নিতে পারে। এ কারণে, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।

আজ থেকে ১০ বছর আগেও বন্দি ছিলেন সু চি। এখন আবার বন্দি হলেন। তবে তখনকার প্রেক্ষাপট এখনকার চেয়ে ভিন্ন। আন্তর্জাতিকভাবে তার যে ‘ডেমোক্র্যাটিক আইকনিক ইমেজ’ ছিল সেটাও এখন নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির মোহে পতিত হয়ে ধর্ষণ, গণহত্যা দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো জঘন্য অপকর্মে সায় দিয়ে সু চি কেবল নিজের ইমেজ নষ্ট করেননি, বাংলাদেশের জন্যও অত্যন্ত খারাপ বার্তা বয়ে এনেছেন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আলোচনা বিলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে সংঘাতের জেরে আরও রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এই অভ্যুত্থানের কারণে।    

 

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক