চার দশক বা তারও একটু আগে-পরে, অনেকেরই স্কুল পালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই পালানো ক্লাশ ফাঁকি দেওয়ার জন্য না; সেই পালানোর পেছনে ছিল টিকা-ভীতি। তখন স্কুলে স্কুলে স্বাস্থ্যকর্মীরা আসতেন দলবেঁধে। সেই দলে যতদূর মনে পড়ে তিন-চারজন থাকতেন। সাদা এপ্রোনও পরতেন কেউ কেউ। হঠাৎ করে তারা স্কুলে এসে উপস্থিত হতেন। তারপর ক্লাশ রুমে ঢুকে একে একে সব শিশুকে টিকা দিতেন।
নানা ব্যাধি থেকে মানুষকে সুস্থ রাখতে এই টিকা দেওয়া হতো। অনেক শিশু ভয় পেতো, চিৎকার চেঁচামেচি করতো! তা দেখে অন্যদের মধ্যেও ভয় ছড়িয়ে পড়তো। আর সেই ভয়েই টিকা দেওযার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা স্কুলে এসেছে শুনলেই ভীতুরা ঝেড়ে দৌড়! মফস্বল শহরের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই ছিল টিনের বেড়া। জানালায় গ্রীল বা রডের বালাই ছিল না। খোলা জানালা দিয়ে চট করে সটকে পরা যেতো। কিন্তু পালিয়েও লাভ হতো না বিশেষ। স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়িও যেতেন। প্রতি বাড়িতে গিয়ে টিকাপাবার যোগ্য সবাইকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিতেন। তবে বাড়িতে সুবিধা-অসুবিধা যাই বলি না কেন, পালিয়ে যাবার সুযোগ হতো না। বাবা-মা জোর করে ধরে রাখতেন, যেন শিশুটি পালিয়ে না যায়। টিকা দেওয়ার সেই সুফল মিলতে শুরু করেছে। যেসব রোগের জন্য টিকা দেওয়া হতো, তার অধিকাংশই পুরো নির্মূল না হলেও, প্রায় বিদায় নিয়েছে। সরকারিভাবে শিশুদের ছয়টি মারাত্মক রোগ থেকে বাঁচতে টিকা দেওয়ার কর্মসূচি তো এখন উৎসবের আমেজেই পালন হয় দেশে। প্রতি বছর প্রচারমাধ্যমে তো বটেই স্থানীয়ভাবেও প্রতিটি এলাকায় টিকাদানের তারিখ, সময় ও স্থান জানিয়ে মাইকিং করা হয়। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিনই টিকা দেওয়া কার্যক্রম চালু রয়েছে। জন্মের পর থেকে শিশুদের যেসব টিকা দেওয়া জরুরি, সেগুলো প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ায় আমাদের শিশু মৃত্যুর হারও কমেছে। টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের সফলতা অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ।
অথচ সেই আমরাই এখন, একটি টিকার বিষয়ে অসীম আগ্রহের পরও যথাযথভাবে সাড়া দেইনি। এ বড় বিস্ময়ের, এ বড় বেদনার খবর। দুই হাজার আঠারো সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে দেখা দেয় করোনাভাইরাস। কভিড-১৯ নামে পরিচিত ভাইরাসটি খুব দ্রুত প্রাণঘাতী ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত হয়। দেশে দেশে সতর্কবার্তা জারির মধ্যেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানো ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগ পর্যন্তই ছিল আতঙ্ক। ইতোমধ্যে বিশ্বে করোনা রোগীর সংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়েছে। স্বজন হারানোর সংখ্যাও কম নয়। নানারকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে মৃতের সংখ্যা বাইশ লাখ ছাড়িয়েছে।
বেদনাদায়ক এই সংখ্যাটিও ভীতিকর! সেই ভীতি কাটিয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ফেরার পথে টনিক হয়ে এসেছে করোনার টিকা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন তাদের জনসাধারণের জন্য টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরাও উন্মুখ হয়ে ছিলাম। এর মধ্যে শঙ্কা ছিল, টিকা সাধারণের কাছ পর্যন্ত আসবে কিনা, সব দেশ পাবে কিনা? যেসব প্রতিষ্ঠান টিকা আবিষ্কার করেছে, তাদের অনেকের সঙ্গেই প্রাথমিক পর্যায়ের ধনী দেশগুলো চুক্তি সম্পাদন করে। ফলে আমাদের মতো অনেক দেশই শঙ্কায় ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে টিকা প্রাপ্তির বিষয়ে। তবে সব শঙ্কা, সব উৎকণ্ঠা পেছনে ফেলে বর্তমান সরকার আমাদের জন্যও টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করে। প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ নেতৃত্বে প্রাথমিক পর্যায়ে টিকা পাওয়া দেশগুলোর তালিকায় আমাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়েছে। এ আমাদের জন্য আনন্দের। বর্তমান সরকারের সফলতায় এটি আরও একটি উজ্জ্বল পালক।
সরকার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে। দেশে পৌঁছে গেছে ৫০ লাখ ডোজ। এর বাইরে ভারত আমাদের উপহার হিসেবে দিয়েছে ২০ লাখ ডোজ। ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন করার পর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশ এখনও টিকা পায়নি, কবে পাবে তার নিশ্চয়তা নেই। এমন সংকটময় মুহূর্তে বিশ্বের সবাই যেখানে টিকা নিতে আগ্রহী, উন্মুখ, সেখানে টিকা নেবার জন্য আমাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া কেন গতি পায়নি, স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন ওঠে।
টিকা নিয়ে শুরু থেকেই নানামুখী কথা; যার বড় অংশই ছিল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশল। সেই অপপ্রচার, টিকা সম্পর্কে ছড়ানো গুজবই প্রথমত সাধারণ মানুষকে নিরুৎসাহীত করেছে টিকা নেবার নিবন্ধন থেকে। এর সঙ্গে টিকাদান ব্যবস্থাপনাতেও কিছু ত্রুটি থাকা অসম্ভব না। অ্যাপসের মাধ্যমে টিকা নেওয়ার নিবন্ধন চলছে। শহরাঞ্চলের মানুষ, যাদের হাতের নাগালে ইন্টারনেট, তাদের জন্য অ্যাপসে নিবন্ধন সহজ হলেও, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ততোটা নয়। আগের তুলনায় ইন্টারনেট অনেক সহজলভ্য হলেও অনেকেরই অ্যাপস ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নেই। সেই সঙ্গে নানান ভীতি তো রয়েছেই।
এছাড়া সরকারের সফলতা ম্লান করতে টিকা সম্পর্কে যেসব নেতিবাচক প্রচারণা এবং গুজব রাজনৈতিকভাবে ছড়ানো হয়েছে, তার কু-প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। এ কারণে শহরাঞ্চলের মানুষের মধ্যেও টিকা নিয়ে এখনও যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি হয়নি। অথচ এই করোনাকালেও শিশুদের হাম ও রুবেলা থেকে রক্ষা করতে দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে করোনাসৃষ্ট মহামারিকাল অতিক্রম করতে করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হওযার টিকা নিতে মানুষ অনাগ্রহী- একথা মেনে নেওয়া কষ্টের।
সরকার যে দৃঢ়তা নিয়ে করোনাকালীন সংকট মোকাবিলা করেছে, তা উদাহরণ। এ অবস্থায় মানুষকে সুস্থ রাখতে টিকাদান কর্মসূচিও সফল করতে হবে। নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় গতি আনতে হবে। সেই গতি আনার পথে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার পাশাপাশি ইতিবাচক প্রচারণা জোরদার করতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে সরকার যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের প্রচারণা চালিয়েছে, সেভাবেই করোনার টিকা নিতে উৎসাহ দিতে এগিয়ে আসতে হবে। এবং টিকাদান ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকলে, তাও দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক