১৯৭১-এর মার্চের মতো বিপুল ঘটনাবহুল, চরম উত্তেজনাপূর্ণ, আকাশসমান স্বপ্ন ও সংঘাতময় পরিস্থিতি, যার ধারাবাহিকতায় নজিরবিহীন গণহত্যা এবং স্বাধীনতার শাশ্বত ঘোষণা- বাঙালির ৫ হাজার বছরের লিখিত-অলিখিত ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি, ভবিষ্যতে ঘটারও কোনো কারণ নেই। আমাদের প্রজন্ম সৌভাগ্য- বাঙালির সেই সুবর্ণ ইতিহাস আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, ঘটনার কেন্দ্রে বিচরণ করেছি এবং বাঙালির সর্বোচ্চ আনন্দ-বেদনার অভিজ্ঞান আজও বহন করছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে।
বাঙালি জাতির দীর্ঘ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন ও অহঙ্কার ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং এই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছে স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইতিহাস সৃষ্টিকারী অনন্যসাধারণ ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বটে, তবে ৭ মার্চের ভাষণেই তিনি স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পাশাপাশি কীভাবে স্বাধীনতার যুদ্ধ করতে হবে তার রণকৌশলও ঘোষণা করেছিলেন।
সেদিন ঢাকার রমনার বিশাল মাঠে (যা এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যে দশ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়েছিল তাদের অধিকাংশ কালের পরিক্রমায় ’৭১-এর পরবর্তী ৫০ বছরে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। আমরা বিরল সংখ্যক ৭ মার্চ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী প্রত্যক্ষ করার জন্য বেঁচে আছি, যে সৌভাগ্য আজকের বাংলাদেশে অল্প কিছু মানুষই দাবি করতে পারে।
’৭১-এ আমরা সদ্য যৌবনে পদার্পণ করেছি। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা স্নাতক সম্মানের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। খণ্ডকালীন কাজ করি কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘রহস্য’ পত্রিকায় সহযোগী সম্পাদক হিসেবে। সে বছর ফেব্রুয়ারি আমাদের এক বছরের সিনিয়র বেবী মওদুদের সম্পাদনায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বের করেছিলাম ‘রানার’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা, যার লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার দাবিকে জনপ্রিয় করা। বেবী মওদুদ ছিলেন শেখ হাসিনার সহপাঠী, পরে সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে ’৭০-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়ের পরই এটা অবধারিত হয়ে গিয়েছিল- পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা এবং তাদের দোসর পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো কখনও বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।
’৭১-এর জানুয়ারি থেকেই শুরু হলো ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা। বঙ্গবন্ধু অবশ্য জানতেন নির্বাচনে তিনি যত বেশি ভোট পান না কেন পাকিস্তানিরা কখনও তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার গোপন পরিকল্পনা নির্বাচনের আগেই তিনি চূড়ান্ত করেছিলেন, যা তার দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও বিস্তারিত জানতেন না, জানতেন ছাত্র লীগের ভেতর যে নিউক্লিয়াস তিনি তৈরি করেছিলেন, যেটি পরিচিত ছিল ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘বিএলএফ’ নামে- তার নেতারা।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছিল। পাকিস্তান এগিয়ে যাচ্ছিল অনিবার্য ভাঙনের দিকে আর বাঙালি অপেক্ষা করছিল- বঙ্গবন্ধু কবে স্বাধীনতার ডাক দেবেন। ’৭০-এর নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মার্চের ১ তারিখ দুপুরে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণা করলেন তখন পূর্বাণী হোটেলে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের পরিষদ দলের সভা চলছিল।
এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে জড়ো হয়েছিল কলাভবনের বটতলায়। ডাকসুর নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করলেন বেলা ৩টায় তারা পল্টন ময়দানে সমাবেশ করবেন, যার পাশে পূর্বাণী হোটেলে অবস্থান করছিলেন বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। কয়েক ঘণ্টার ভেতর ঢাকার স্বাভাবিক চেহারা পাল্টে গেল। অফিস, আদালত, কল-কারখানা, সরকারি দফতর সব ফেলে বিক্ষুব্ধ মানুষ মিছিলের পর মিছিল নিয়ে পূর্বাণী হোটেল আর পল্টন ময়দানে জড়ো হলো। পূর্বাণী হোটেলের চারপাশের রাস্তায়ও মিছিলকারীরা অবস্থান গ্রহণ করল। বঙ্গবন্ধু পূর্বাণী হোটেল থেকেই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ২ মার্চ ঢাকা শহরে এবং ৩ মার্চ সারা দেশে ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়ে বললেন, ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় তিনি আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা ঘোষণা করবেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গেল যা অব্যাহত ছিল ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে নজিরবিহীন গণহত্যাযজ্ঞ আরম্ভের আগে পর্যন্ত। এই দিনই বঙ্গবন্ধু ছাত্র নেতৃবৃন্দকে তার ৩২ নম্বরের বাড়িতে ডেকে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করার নির্দেশ দেন।
৭ মার্চ রেসকোর্সের বিশাল ময়দানে সকাল ১০টা থেকেই জনসমাগম আরম্ভ হয়েছিল। দুপুর ২টা নাগাদ গোটা ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত করেছিল। আমি আর আমার বন্ধু শফী চৌধুরী হারুণ (যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সদ্যপ্রয়াত) একসঙ্গে টিএসসির কাছে মাঠের এক প্রান্তে বসে সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ শুনেছি।
রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা তখন প্রায় ষোল লাখ। শুধু ঢাকার ছাত্র-জনতা নয়, ঢাকার পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চল থেকে শ্রমিকরা এসেছিল ডামি হাতুড়ি শাবল নিয়ে, কৃষকরা এসেছিল লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে, নৌকার মাঝিরা এসেছিল বৈঠা ও লগি নিয়ে। অনেকে এসেছিল তীর ধনুক আর কাঠের বন্দুক নিয়ে। রমনার ময়দানের চতুর্দিকের রাস্তায় মানুষের মাথা ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সবার কণ্ঠে একই শ্লোগান ‘জয় বাংলা’। এ ছাড়া শ্লোগান ছিল- ‘তোমার দেশ আমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি। সব মিছিলে বাংলাদেশের পতাকা- গাঢ় সবুজ জমিনে লাল সূর্যের মাঝখানে বাংলাদেশের সোনালি মানচিত্র। এই মানচিত্র খচিত পতাকা মার্চের ২ তারিখেই ছাত্রনেতারা উত্তোলন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে, যা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সর্বত্র দৃশ্যমান ছিল।
বঙ্গবন্ধু সেদিন বেশ কিছুটা দেরিতে মঞ্চে উঠেছিলেন। তার আগে আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা মঞ্চ থেকে মুহুর্মুহু শ্লোগান দিচ্ছিলেন, যার জবাব দিচ্ছিল উপস্থিত জনতা। শ্লোগানে শ্লোগানে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল রমনার বিশাল ময়দান। সেই সময়ে মনে হয়েছে রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থলের এই বিশাল মুক্ত প্রান্তরে চির দুঃখিনী বাংলার হৃদস্পন্দন ধ্বনিত হচ্ছে। মঞ্চে বঙ্গবন্ধু নয়, বাংলাদেশের বঞ্চিত, বেদনাহত বিক্ষুব্ধ হৃদয় কথা বলছে।
বাগ্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভূয়সী প্রশংসা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশী সাংবাদিকরা সব সময় করেছেন। বৃটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং সহ শত শত বিদেশী সাংবাদিক সেদিন বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী ভাষণ শোনার জন্য রমনার রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। আমার প্রামাণ্যচিত্র ‘ক্রাই ফর জাস্টিস’-এ এক সাক্ষাৎকারে সাইমন বলেছেন, তিনি তখন বাংলা কিছুই বুঝতেন না। ভিয়েতনাম থেকে ঢাকা এসেছেন, কারণ বিশ্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম জেনে গিয়েছে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একটি শব্দ বুঝতে না পারলেও তাঁর যাদুকরী বাচনভঙ্গী এবং উপস্থিত দর্শকদের উপর তার সম্মোহনী প্রভাব লক্ষ্য করে সাইমন বার বার রোমাঞ্চিত হচ্ছিলেন। একই কথা পরে ইস্তাম্বুলে আমাকে বলেছেন তুরস্কের মানবাধিকার নেত্রী ভাসফিয়ে জামান। প্রবীণ বাঙালি কূটনীতিক আরশাদুজ্জামানের সহধর্মিণী মাদাম ভাসফিয়ে মঞ্চের ঠিক সামনে বসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছেন। একটা ভাষণ কীভাবে গোটা দেশের মানুষকে জীবনবাজি রেখে মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারে সেই ভাষণ সমাবেশে উপস্থিত থেকে শোনার সৌভাগ্য তার হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে কামাল আতাতুর্কের ভক্ত মাদাম ভাসফিয়ে এই ভাষণ শোনার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়ে গিয়েছেন। আমার প্রামাণ্যচিত্রে তিনি বলেছেন, তুরস্কের জাতির পিতা মোস্তফা কামালের চেয়ে বঙ্গবন্ধুকে তিনি বড় নেতা মনে করেন। কারণ কামাল আতাতুর্ক আধুনিক তুরস্কের জনক, রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক আগে থেকেই ছিল। কামাল আতাতুর্ক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়ে ইতিহাসের পাশাপাশি ভূগোলও সৃষ্টি করেছেন। এ হচ্ছে তুরস্কের এক মানবাধিকার নেত্রীর বক্তব্য, যে তুরস্ক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিল।
আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে আবছা দেখা যাচ্ছিল। ছবিতেও দেখা যাবে দূর থেকে ধারণ করা দৃশ্যে গোটা মাঠ ধুলি ধুসরিত ছিল। কাছে থেকে ক্লোজ আপে যখন বঙ্গবন্ধুর মুখের অভিব্যক্তি, দীর্ঘ অবয়ব, উত্তোলিত হাত ধারণা করা হয়েছে- সেখানে শরীরের ভাষায়ও দেখা যাবে বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য তাঁর নিদারুণ মর্মবেদনা, পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রকারী ও নির্যাতনকারী শাসকচক্রের প্রতি তাঁর বিশাল ক্রোধ এবং আসন্ন মহাসংগ্রামের প্রস্তুতি ও দিক নির্দেশনা প্রকাশ ও প্রদানের সময় কী গভীর আবেগ তিনি ধারণ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুধু নয়, স্বাধীনতার পাশাপাশি জাতির সার্বিক মুক্তির বিষয়টি শেষের বাক্যে যেভাবে মূর্ত হয়েছে সেটি সমগ্র ভাষণেরই নির্যাস- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জনগণের সার্বিক মুক্তির প্রথম ও প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ও সার্বিক মুক্তির বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিল বলেই ’৭১-এর যুদ্ধকে আমরা নিছক স্বাধীনতার যুদ্ধ না বলে মুক্তিযুদ্ধ বলি।
বাংলার সংক্ষুব্ধ মানুষের হৃদয়ে ধারণ করা প্রতিটি প্রত্যয় ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা না করে, যা করেছিলেন ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে নৃশংসতম গণহত্যা আরম্ভের অব্যবহিত পরে, ইংরেজি দিনপঞ্জী অনুযায়ী তখন ২৬ মার্চ আরম্ভ হয়েছে। সে সময়ে আমাদের বয়সী তরুণদের ভেতর অনেকেরই ক্ষোভ ছিল, হতাশাও ছিল- বঙ্গবন্ধু কেন সরাসরি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বা নিউক্লিয়াসের কোনো কোনো নেতাও চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু যেন ৭ মার্চেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর ওপর এ ধরনের চাপের কথা বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস প্রমাণ করেছে- ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কী গভীর দুরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি যদি সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন পাকিস্তান এটাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড হিসেবে প্রতীয়মান করতে পারত এবং যে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ’৭১-এ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে সমর্থন ও সহানুভূতি অর্জন করেছিল তা দুরূহ হতো।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শেষে আগত মানুষদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আন্তবাহিনী জন সংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক তার ‘উইটনেস টু সারেণ্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘বক্তৃতার শেষ দিকে তিনি জনতাকে শান্ত এবং অহিংস থাকার উপদেশ দিলেন। যে জনতা সাগরের ঢেউয়ের মতো প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে রেসকোর্সে ভেঙে পড়েছিল- ভাটার টান ধরা জোয়ারের মতো তারা ঘরে ফিরে চলল। তাদেরকে ধর্মীয় কোনো জনসমাবেশ তথা মসজিদ কিংবা গির্জা থেকে ফিরে আসা জনতার ঢলের মতোই দেখাচ্ছিল এবং ফিরে আসছে তারা সন্তুষ্টচিত্তে ঐশীবাণী বুকে ধরে।’
ভাষণ শোনার পরই রেসকোর্স ময়দান থেকে আমি আর হারুণ সেগুন বাগিচায় কাজী আনোয়ার হোসেনের রহস্য পত্রিকার অফিসে গিয়েছিলাম। আগে থেকেই সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরী, শিল্পী হাশেম খান, লেখক শেখ আবদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন- তুমুল আলোচনা চলছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন পত্রিকাটির প্রকাশক সম্পাদক হলেও সম্পাদনার যাবতীয় কাজ আমাকেই করতে হতো। মার্চ সংখ্যা বেরোবার কথা ১০ তারিখে। রহস্য পত্রিকায় সেবার নির্ধারিত প্রচ্ছদ কাহিনী ছিল শিল্পে রহস্যময়তা পরাবাস্তববাদ। লিখেছিলেন শিল্পী, সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরী। প্রচ্ছদের ছবি নির্বাচন করা হয়েছে ফরাসী শিল্পী সালভাদর দালির একটি পরাবাস্তববাদী পেইন্টিং।
আমি বললাম, পত্রিকার প্রচ্ছদ কাহিনী পরিবর্তন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আজকের ভাষণের ওপর প্রচ্ছদ হবে। আনোয়ার ভাই বললেন, তা কি করে সম্ভব? প্রচ্ছদ ছাপা হয়ে গিয়েছে। ওটা বাতিল করতে হলে অনেক টাকা গচ্চা দিতে হবে। তাছাড়া এত অল্প সময়ে নতুন প্রচ্ছদ ছাপা সম্ভবও নয়। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।
শিল্পী হাশেম খান ‘রহস্য’ পত্রিকার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করতেন। তিনি আমাদের দু’জনকে নিরস্ত করে বঙ্গবন্ধুর মতো আপাতদৃষ্টিতে মধ্যপন্থা গ্রহণ করলেন। বললেন, প্রচ্ছদ আগেরটা থাক। আমি বঙ্গবন্ধুর একটা স্কেচ করে ‘এবারের সংগ্রাম....’ লিখে দেব। ওটা আলাদা ছাপা হয়ে প্রচ্ছদের ঠিক পরের পাতায় পেস্ট করে দেব, যাতে প্রচ্ছদ উল্টালেই ওটা চোখে পড়ে। শাহরিয়ার ওটার ওপর সম্পাদকীয় লিখতে পারে।
সেবার ‘রহস্য’ পত্রিকার মতো রাজনীতিবর্জিত পত্রিকাও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে এভাবে ধারণ করেছিল। এরপর আমাদের সাপ্তাহিক ‘রানার’-এ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের প্রতিকৃতি কীভাবে স্থান করে নিয়েছিল সে এক দীর্ঘ কাহিনী। এই ভাষণটির মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি থেকে সকল দলের নেতা এবং কার্যত বাংলাদেশের অঘোষিত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সারা দেশে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা