সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত গণমাধ্যমের সামনে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য রেখেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে অবস্থান করে সেই দেশকেই চোখ রাঙিয়ে তিনি বলেছেন- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের জোট ‘কোয়াড’-এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘যথেষ্ট খারাপ’ করবে।
অন্য অনেকের মতো তার এই বক্তব্যে আমিও অবাক হয়েছি। কারণ, আগ্রাসী কূটনীতি বিশ্বজুড়ে আলোচিত হলেও সেই আগ্রাসী কূটনীতিতেও ‘শিষ্টাচার’ বলতে একটা কথা আছে। এভাবে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া দেখানো যায় না। তাছাড়া একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে কী যুক্ত করবে, কী বাদ দেবে সেটা একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। এসব চিন্তা করেই মন্তব্য করা উচিত ছিল চীনের রাষ্ট্রদূতের।
২. বঙ্গোপসাগরের ব্লু ইকোনমি জোন এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভূতাত্ত্বিক আধিপত্য থাকায় বাংলাদেশ সবসময়ই সকল হিসাব-নিকাশে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কোয়াড জোটের নব উত্থান এই অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরো অর্থবহ করে তুলেছে। অন্যদিকে, ভারতের সাথে সীমানা থাকায় ও বঙ্গপোসাগরের সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। আর সুবিধা লুফে নিতে বাংলাদেশের প্রতি চীনের আগ্রহ দিনে দিনে বেড়েছে বহুগুণ। যেহেতু চীন ও ভারত ঐতিহাসিককাল থেকেই চির প্রতিদ্বন্দ্বী, সেহেতু ভারতের উপর চাপ বজায় রাখতে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কৌশলগত সুবিধা কোনোভাবেই হাত ছাড়া করতে চাইছে না চীন। দেশটি বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চায়। আর ঠিক এ কারণেই কোয়াডে বাংলাদেশ যোগদানের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নিলেও সংশয়ের জায়গা থেকে চীন এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
চীন সমুদ্রসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে দক্ষিণ চীন সাগর এবং সেখানকার কয়েকটি দ্বীপ দখলের চেষ্টা করছে। যার জন্য ঐ অঞ্চলের প্রায় ২০টি দেশের সঙ্গে তার যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সাগর এবং সাগরতলের সম্পদ সব দেশের সম্পদ হওয়ায় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই চীনের এই আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। চীনের এই আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি মোকাবিলা করার জন্য অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত জোট ‘কোয়াড’ সক্রিয় হয়ে উঠেছে সম্প্রতি। এই কারণে জোট হিসাবে কোয়াডের উত্থানকে চীন নিজের জন্য হুমকি মনে করছে।
তবে বাংলাদেশের ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। এ কারণে বাংলাদেশ যেমন চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তেমনই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস)- এর সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ বাংলাদেশের বিদেশনীতির মূল ভিত্তি। জন্ম লগ্ন থেকে এই পর্যন্ত বাংলাদেশ নিরপেক্ষতার এই নীতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। গতমাসে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহির ঢাকা সফরে কোয়াড নিয়ে চীনের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন পরিষ্কারভাবে বলেছেন, দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপাদান থাকলে বাংলাদেশ তাতে যুক্ত হলেও কোনো উদ্যোগে নিরাপত্তার বিষয়টি থাকলে তাতে যুক্ত হবে না। তবে এটাও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশকে এখন পর্যন্ত কেউ কোয়াডে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়নি কিংবা বাংলাদেশও কখনো কোয়াডে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেনি। এমনকি সম্প্রতি কোয়াড সম্প্রসারণের বিষয়ে যেসব লেখালেখি আর সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে সম্ভাব্য দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই।
ট্রাম্পের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে কিছুদিন আগেও কোয়াড একটি সামরিক জোট হিসেবে বিবেচিত হলেও নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শপথের পরে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। কোয়াডের এখন প্রধান উদ্দেশ্য ইন্দো প্যসিফিক অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো কার্যকরী করে তুলতে এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, অবাধ বাণিজ্য ও নৌ চলাচলসহ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নানামুখী সহযোগিতার ক্ষেত্র গড়ে তোলা। তবে কোয়াড এখন সামরিক বা নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো জোট হিসেবে বিবেচিত না হলেও চীন এটাকে নিজের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবেই দেখছে। তাছাড়া কোয়াড সামিটে বা কোথাও কোনো বিবৃতিতে চীনের নাম উল্লেখ করা হয়নি, এমনকি কোয়াড থেকে সম্প্রতি টার্গেট করে চীনের বিরোধিতাও করা হচ্ছে না।
গত মার্চে অনুষ্ঠিত হওয়া কোয়াডের অনলাইন সামিটের মূল উদ্দেশ্য থেকেও সেটা প্রতীয়মান হয়েছে। করোনাকালে এর প্রধান লক্ষ্যটি হচ্ছে, ২০২২ সালের মধ্যে এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলে করোনাভাইরাসের ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখা। আর এই টিকার ডোজ সরবরাহের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হবে। তবে অর্থনৈতিকভাবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা চীন টিকা রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে জোরেশোরে মাঠে নেমে নেমেছে। তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে কোয়াড জোটই এখন সবচেয়ে বড় বাধা।
৩. চীনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ এখন মুখে মুখে। সম্প্রতি লি-মেং ইয়ান নামে চীনের একজন শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট ‘সার্স করোনাভাইরাস’ নিয়ে চীনের বেশকিছু গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করেছেন। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, চীনের সামরিক বিজ্ঞানীরা ২০১৫ সাল থেকেই এই ভাইরাসকে 'জৈব অস্ত্র' হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। বিশ্বব্যাপী ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়া সেই চীনই এখন করোনার টিকাকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এই রাজনীতিতে করোনার টিকার বিনিময়ে চীন বাংলাদেশকে তার প্রেসক্রিপশন অনুসারে চলতে বাধ্য করতে চাইছে। কারণ, কিছুদিন আগে তারা বাংলাদেশকে করোনার টিকা নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত করলেও এখন বলছে ডিসেম্বরের আগে টিকা বিক্রি করতে পারবে না। এটাও কি চীনের সেই ভূ-রাজনীতির অংশ? তারা কি টিকার বিনিময়ে কোনো কিছুতে বাংলাদেশকে বাধ্য করতে চাইছে? তবে চীনের দেয়া উপহারের ৫ লাখ টিকা ঢাকায় পৌঁছেছে।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ নিয়ে চীনের আগ্রহের কেন্দ্র আসলে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, ব্যবসায়ীক লাভ আর ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের সমীকরণ। চীন নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব রাখতে চায়। এই কারণে চীন বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত প্রকল্পের জন্য ঋণ গ্রহণে ব্যাপকভাবে প্রলুব্ধ করেছে। তবে চীনের এসব ঋণের সুদ সময়মতো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে দেশটি নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালায়। ‘সিএফজিডি’ নামে একটি গবেষণা সংস্থার বিশ্লেষণ মতে, আটটি দেশ শিগগিরই চীনের এই ধরণের ঋণ ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছে। দেশগুলো হলো- জিবুতি, কিরগিজস্তান, লাওস, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, মন্টিনিগ্রো, পাকিস্তান ও তাজিকিস্তান। এই ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা আরও এগিয়ে। দেশটি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর উন্নয়নে চীনের ঋণ গ্রহণের সময় বুঝতে পারেনি কত ভয়ংকর ফাঁদে পা দিয়েছে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ২০১৫ সালে তারা বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য চীনকে ইজারা দিতে বাধ্য হয়। ঠিক এইভাবে পাকিস্তানও তাদের একটি বন্দর ৪০ বছরের জন্য চীনকে লিজ দিতে বাধ্য হয়েছে।
৪. চীন আসলে কখনো কারও বন্ধু হতে পারে না। ইতিহাস তাই বলে। বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ানো রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখতেও ভূমিকা রাখছে চীন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যখন পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন বারবার দেশটিকে সাপোর্ট দিয়ে গেছে চীন। এমনকি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিষয়টিতে সবসময়ই জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের বিরোধী চীন। মিয়ানমার যেহেতু চীনের প্রেসক্রিপশনে চলে তাই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের অদৃশ্য চাবি চীনের হাতেই। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই নিয়ে যে পদক্ষেপই নিতে চেষ্টা করুক না কেন, তাতে সবসময়ই বাঁধ সাধে স্থায়ী সদস্য চীন। গোটা বিশ্ব যেখানে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে চীন স্বীকারই করে না রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন ভারতীয় সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করেছিল বাংলাদেশকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়া ভারতের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে। চীন চেয়েছিল পাকিস্তানের জয়লাভ ত্বরান্বিত করতে। কিন্তু তখন তারা সেটা পারেনি, কারণ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন সীমানায় কয়েক হাজার সেনা পাঠিয়ে চীনকে রুখে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে চীনের তৈরি যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেই পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। সেইসময় পাকিস্তানকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে চীন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পরেও চীন নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে বঙ্গবন্ধু লাহোরে ওআইসির সম্মেলনে যোগ দেন। তারপরই মূলত চীন ভেটো তুলে নেয়। তবে বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাবস্থায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি চীন। তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাত্র ১৬ দিনের মাথায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় দেশটি।
বাংলাদেশ সব সময় আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়গুলো সামনে রেখে এগিয়েছে। কখনো কোনো সামরিক কিংবা প্রতিরক্ষা জোটে যোগ দেয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে কোয়াডকে ঘিরে চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে কেবল আগ বাড়িয়ে বলা কথার কথা বলে মনে হচ্ছে না। দেশটি যে নতুন কোন ভূ-রাজনৈতিক খেলা নিয়ে ময়দানে দ্রুতই হাজির হচ্ছে- বর্তমান অবস্থানের প্রেক্ষিতে সেটাকে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এমতবস্থায় সবার সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা বাংলাদেশকে ইতিহাস বিচার করে, নিজের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখেই ভবিষ্যতের পথরেখা তৈরি করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আরো পড়ুন: কোয়াড নিয়ে চীন এত উদ্বিগ্ন কেন?