মতামত

এখনই পাল্টান, নইলে কুড়াল নিজের পায়েই পড়বে

পরীমনি এতো রাতে কী করতে ক্লাবে গিয়েছিলেন, কার সঙ্গে গেলেন, কেন গেলেন, পরীমনি কী পোশাক পরে ছিলেন, পরীমনি কি মাতাল ছিলেন?- ইত্যাদি প্রশ্ন এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। বলাবাহুল্য প্রশ্নগুলো ক্লিশে, বহুল ব্যবহারে অতিসাধারণ।

আদতে এই প্রশ্নগুলো আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াবে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কেউ বলবে, কেউ বলবে না। কেউ কেউ প্রচলিত দেখার অর্থোডক্স দৃষ্টি অস্বীকারও করতে পারবে না, নিজের প্রগতির ফাঁপা ভাবমূর্তি ফুঁস করে উড়ে যাবার ভয়ে উচ্চারণও করবে না।  প্রশ্নগুলো অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে প্রশ্নগুলো অস্বাভাবিকও নয়। সত্যি তো, আমাদের কয়টা মেয়ে রাত বারোটায় ঘরের বাইরে যায়, ক্লাবে যায়?

এই ক্লাবে যাওয়া, একটা মেয়ের রাত বারোটায় ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া আমাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না। আপনার আমার মেয়েরা তো যায় না। পরীমনি গিয়েছে...? কাজেই সে তাঁর প্রাপ্যটাই পেয়েছে। অবাক হওয়ার কি আছে!

কিন্তু আমরা যারা ‘পরীমনি’ নামটি জানি, তারা তো এটিও জানি যে তিনি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। তিনি গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের সুপ্রতিষ্ঠিত নারী। তাঁর সমাজ বাস্তবতা আর আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ বাস্তবতা এক নয়। প্রচলিত সিস্টেম মানা আমাদের সামাজিক পরিমণ্ডলে বিবাহযোগ্যা পাত্রী আর কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার সংকটের সঙ্গে তাঁর সংকটের তুলনা করা অবান্তর। মুক্ত দৃষ্টিতে আমাদের অনেকের কাছে তো ‘বিবাহযোগ্যা’ কিংবা ‘কন্যাদায়গ্রস্ত’ টার্ম দুটিই পরিতাজ্য। তবু রক্ষণশীলদের দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে তাদের মতামত মেনে নিয়েও যদি বলি, তারা কি জানেন না- তাদের ঘরের মেয়ের জীবনাচরণ আর পরীমনির জীবনাচরণ এক নয়? তবু তারা এই প্রশ্নটি কেন তুলছেন?

তুলছেন, অপরাধীর অপরাধ লঘু করার অপচেষ্টায় এবং নারীকে অধিকতর বন্দীত্বে ছুঁড়ে ফেলার হীন উদ্দেশ্যে। অর্থনৈতিক প্রয়োজন যদি আমাদের সামনে বড় হয়ে না দাঁড়াতো, তবে এই ক্রম অধঃপতিত সমাজ কয়টি মেয়েকে ঘর থেকে বের হতে দিতো, বিষয়টি নিয়ে আমি সত্যিকার অর্থে সন্দিহান। সন্দিহান, কেননা  লক্ষ্যহীন শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গীগত দিক থেকে আমাদের ক্রমেই একটি পশ্চাৎপদ আদর্শিক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। আজ আপনি কিংবা আমি যে কিনা পরীমনির ক্লাবে যাওয়ার স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসাবে দেখছি, আমাদেরই সচেতনতা কিংবা অচেতনতায় তা অচিরেই মালালার মতো বিদ্যালয়ে যাওয়াটাও অপরাধ হিসাবে দেখতে শিখবো।

আমরা সবই জানি, ঠিক যে কারণে নটি বিনোদিনীকে জমিদাররা তুলে নিয়ে যেতে চাইতো, তাঁর বাড়ির সামনে লাঠিয়াল বাহিনীর পাহারা বসিয়ে রাখতে হতো, আজ দুইশ বছর পরও পরীমনিকে ঠিক এভাবেই ‘সহজলভ্য’ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে, শুধু চলচ্চিত্রাভিনেত্রী হওয়ার কারণে। একটি মেয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে, রাত বারোটায় বাড়ির বাইরে যায়, কাজেই তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে- এ আর এমন কি!

সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণের বক্তব্যে আমি তাই খুব অবাক হইনি। নিজ দৃষ্টিসীমার ভেতরে থাকা একটা কূয়ো ছাড়া বাইরের পৃথিবী যাদের কাছে অচেনা অজানা, তাদের কাছে কিই-বা প্রত্যাশা থাকতে পারে? এরা মূর্খ কূপমণ্ডূক। এদের নিয়ে আশা-হতাশার কিছু নেই। কিন্তু যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেই, রাতে ক্লাবে গিয়ে পরীমনি বিশাল অপরাধ করেছেন, মদ খেয়ে মাতলামি করা তাঁর নিত্য নৈমিত্তিক (ইউটিউবে দেখবেন সাক্ষী প্রমাণের অভাব নেই)। এতে কি এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে ক্লাবে যাওয়ার ‘অপরাধে’ বা ‘রাত ১২টায়’ বাইরে যাওয়ার অপরাধে তাঁর আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার নেই? যদি পরীমনি নিজে মিথ্যা অভিযোগও নিয়ে যায়, তবু কি তাঁর অভিযোগ নিতে দিনের পর দিন ঘুরানো যায়?

হতাশা সেখানে, যেখানে একজন পরীমনি, একজন সুপ্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী, তাঁকে থানার দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে মামলার জন্য। থানা মামলা নেয় না। একজন সেলিব্রেটি নারীর তাঁর উপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চেয়ে পদে পদে হোঁচট খেয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোলা চিঠি লিখতে হয়, তখন অন্য দশটি সাধারণের মেয়ের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

দুয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করি, বিষয়টির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয় আবার অসম্পর্কিতও বলা যায় না।  ঢাকা থেকে ফিরছিলাম বাসে করে। ছেলের বমির প্রবণতা আছে। জানালা অর্ধেক খোলা রেখে আমার কাঁধে মাথা দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়েছে সে। হঠাৎ পেছন থেকে এক লোক আমার ছেলের মাথায় জোরে ঠুয়া মেরে বলল, এই পোলা জানালা বন্ধ কর, জানালা বন্ধ কর, ঠাণ্ডা লাগছে! 

ছেলে ধড়ফড়িয়ে ঘুম ভেঙে কাঁপতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতা বুঝতে না পেরে উদভ্রান্তের মতো তাকায় আর জিজ্ঞেস করে- কী হয়েছে মা, কী হয়েছে?  চরম খারাপ হয়ে গেলো আমার মেজাজ। আমি ক্ষেপে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এই ঘুমন্ত ছেলেটার মাথায় ঠুয়া দিলেন কেন? আপনার অসুবিধা হলে, আমাকে বললেই হতো, আমি জানালা বন্ধ করে দিতাম। লোকটি উত্তর দেওয়ার আগে সঙ্গে থাকা দুজন পারে তো গায়ে হাত তুলে তেড়ে এলো আমার দিকে- ‘তুই বেডি মানুষ, তরে আবার কীতা কইতাম’।

এই ছিল তাদের মুখের ভাষা। আমার ছেলের বয়স ১০/১১। তাকে মাথায় ঠুয়া দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে বলতে হবে, কারণ সে ছেলে। আমাকে বলা যাবে না, কারণ আমি মেয়ে। অর্থাৎ আমাকে বলা না বলায় কিছুই যায় আসে না। পরে তারা আঞ্চলিক স্বরে বলতেই থাকে- বেডি মাইনষের পাওয়ার দেখছোনি! এবং এই আক্রমণ এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী দলীয় নেত্রীর লৈঙ্গিক অবস্থান পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। চুপ করে গেলাম, ভাবলাম তাঁরাই যখন নারী হিসাবে ছাড় পান না, আমি কোন ছার! মানুষের ভাষা তার সামাজিক, পারিবারিক শিক্ষারই পরিচয় বহন করে। আমি অবাক হইনি তাদের ব্যবহারে। বরং অবাক হয়েছি বাসভর্তি মানুষের ব্যবহারে। তাদের মাঝে সোকল্ড ভদ্রলোকও ছিলেন কয়েকজন, আমার পরিচিতও। কিন্তু একজনও আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলেন নি। কেউ বলেন নি, আমাকে এভাবে গালি দেওয়াটা অন্যায় হচ্ছে। সবাই নির্বিকার বসে ছিলেন। আমাদের পুরো সমাজটা এমন একটা পাবলিক বাস।

কয়েকদিন আগে দ্বিতীয় দফা লকডাউনের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের। এক নারী ডাক্তারকে পরিচয়পত্রের জন্য গাড়ি আটকিয়ে হেনস্থা করা হলো। অনেকেই তখন বলেছেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, আইডি কার্ড দেখালেই তো হতো ইত্যাদি। নানামুখী আলোচনা হয়েছে,  শুনেছি। কিন্তু যে কথাটি বলা হয়নি তা হলো- নারী ডাক্তারের জায়গায় পুরুষ ডাক্তার হলেই কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের ব্যবহার সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি। 

আমাকে ‘নারীবাদী’ বলে গালি দিন আর যাই করুন,(ইদানিং ন্যায়সঙ্গত অধিকারের কথা বললে শব্দটিকে গালি হিসাবেই শুনতে অভ্যস্ত হয়েছি কিনা) আমি একথা বলছি অভিজ্ঞতা থেকে। আমি নারী হিসেবে প্রতিদিন এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই। অফিসের বড়কর্তা থেকে রিকশাচালক। একবার আমার এক প্রিন্সিপাল, আমাকে বলেছেন, আপনি মেয়ে মানুষ কোথায় ভালো ফল পাওয়া যায়- কীভাবে জানবেন? এই শহরে আমার পঞ্চাশ বছর, তিনি এসেছেন কয়েক মাস। তার স্বরে ছিল তাচ্ছিল্য।

রিকশা ভাড়া ঠিক না করে একা উঠলে সর্বদা রিকশাচালক ভাড়ার চেয়ে দশ/পনেরো টাকা ভাড়া বেশি চাইবেই। এবং এ নিয়ে তীব্র অপমানের স্বরে তর্কজুড়ে দেবেই। তার অন্তর্নিহিত ভাবনা, এ মেয়ে মানুষ কী করবে, দশ টাকা বেশি দেবেই। দিতে বাধ্য। ঠিক তখন ত্রাণকর্তার মতো কোনো পুরুষ এসে পাশে দাঁড়ালেই দেখবেন রিকশাচালকের স্বর পাল্টে গেছে। এসব প্রতিনিয়ত ঘটা পরীক্ষিত এবং সত্য অভিজ্ঞতা। নারীকে হেয় ভাবা, দুর্বল ভাবা, তাকে যথেচ্ছ অপমান করার বাসনায় ভেতরে ভেতরে সবাই সমান, কালো আর ধলো বাইরে কেবল।

পরীমনি যখন তাঁর উপর সংঘটিত অন্যায় নিয়ে অসহায়ের মতো বিচার চাইছেন, ঠিক তখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দস্তুর মতো রেজুলেশন নিয়ে অপমানজনক একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।  নারী কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অর্নারে যোগ দিতে পারবেন না। কী ভীষণ অবমূল্যায়ন, কী ভীষণ অপমান!

হায় নারী, সকল মেধা, যোগ্যতা প্রতিভা সত্ত্বেও দিনশেষে তুমি নারী। যে যাই বলুক শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত, উচ্চপদ থেকে নিম্নপদ। তোমাকে লৈঙ্গিক পরিচয়ের বাইরে ভাবা খুব কঠিন।  দায়িত্বের প্রতিটি পদে শুধু নারী হওয়ার কারণে তোমাকে ডিঙাতে হবে বিচিত্র প্রতিবন্ধকতা। সব তুচ্ছ করে যতো বড়ো অবস্থানেই তুমি পৌঁছাও না কেন, সমাজে নারী হওয়ার মাশুল তোমাকে গুণতেই হবে কোনো না কোনোভাবে।

আমাদের বেশির ভাগ নারী এই চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্যকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেন। বরং বেঁচে গেলো ভেবে গা বাঁচানোর সুযোগও নেন কেউ কেউ। মুশকিল হয় এই পরীমনির মতো ‘বেয়াড়া’ কেউ রুখে দাঁড়ালে। তাঁকে হজম করতে না পারার অস্বস্তিতে সমাজ হাসফাস করে। বলাবাহুল্য এই পরীমনিরা যুগে যুগে রুখে দাঁড়িয়েছে বলেই চার দেয়ালে বন্দি নারীরা আজ রাজপথে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখাতে পেরেছে। পরীমনিকে স্যালুট। মুনিয়ার মতো আত্মহননের পথে না গিয়ে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন। আজ তাঁর কান্না, তাঁর অসহায় আইনের আশ্রয় প্রার্থনাই কিন্তু আমার আপনার আগামী মেয়েদের রুখে দাঁড়াবার ভিত্তি আর রক্ষাকবচ হয়ে উঠবে।

পরীমনি প্রসঙ্গে কেন্দ্রীভূত করি বক্তব্য। যে সমাজে উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদস্থ নারীকে দস্তুরমতো রাষ্ট্রীয় রেজুলেশন করে গার্ড অব অর্নারের মতো মহতী কাজে নিষিদ্ধের ঘোষণা আসতে পারে, সেখানে পরীমনি ‘সামান্য চলচ্চিত্রকর্মী’! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৯০ হাজার ফলোয়ার, সেলিব্রেটি ইমেজ, তাঁকে একনজর দেখার জন্য উপচে পরা ভিড় সত্ত্বেও সামাজিক শ্রদ্ধার জায়গায় তাঁর অবস্থান তলানীতে। দেশের শিক্ষা তদজাত সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ কোনোভাবেই একজন অভিনেত্রী নারীকে শ্রদ্ধার আসন দেয় না। চলচ্চিত্রে ভিলেন কর্তৃক আক্রান্ত নায়িকাকে পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র তুচ্ছ করে এগিয়ে আসা নায়করা কেউ বাস্তবের নায়িকাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। বরং হা হা কিংবা অ্যাংরি রিঅ্যাক্টের প্রতিযোগিতা চলছে তাঁর টাইমলাইনে। এই প্রতিবাদী হিরোর চরিত্র নির্মাণ করা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের প্রাথমিক নীরবতার সাপঘুম শেষে বক্তব্য শুনেছেন? না শুনলে একটু শুনিয়ে রাখি- তাদের একজন বলেছেন, পরীমনি এসব প্রায়ই করে। অতএব...।

আসলে এই কূপমণ্ডূক দৃষ্টিভঙ্গী একদিনে অর্জিত নয়, দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এই অভ্যাসের দাস নারী কিংবা পুরুষ নির্বিশেষে নারীর সেই অবস্থানকেই স্বতঃসিদ্ধ মনে করেন, যে অবস্থানের বিরুদ্ধে শতবছর আগে বেগম রোকেয়া যুদ্ধ করে গেছেন, আর তারো আগে রাজা রামমোহন আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরা করে গেছেন, কিন্তু এই উপমহাদেশে আমরা রয়ে গেছি যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই।

যে দেশে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, চলচ্চিত্র শিল্প ধুঁকতে ধুঁকতে কোনোমতে বেঁচে আছে, সেখানে একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর কী আর সম্মান থাকতে পারে, যেখানে পুরো শিল্পকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদাহীন করে রাখা হয়েছে। এভাবে একটি শিল্পমাধ্যমকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্তি ও সম্পর্কহীন, সাংস্কৃতিক বোধহীন প্রজন্মের পর প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। একদিকে উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে না-শিখছে নারীকে সম্মান করতে, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বোধের অভাবে না-জানছে সম্মান কী করে জানাতে হয়। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নব্বই পার্সেন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠের অজুহাত।

ফলে আমাদের নারী এবং পুরুষ উভয়ের মনস্তত্ব এমন হয়েছে- নারী মানেই সে হবে পুতুপুতু, নির্বাক পুতুলের মতো। তাঁর আবার ব্যক্তিগত মত, ইচ্ছা-অনিচ্ছা কী! সে কেন বড় গলায় কথা বলবে!  সে কেন প্রতিবাদ করবে! আর যদি সে হয় মিডিয়া জগতের কেউ, তাঁর অবস্থা হয়, ‘গরিবের বউ সবার ভাবী’র মতো। তাঁর আবার মতামত কি! অভিযোগ কিসের?

এদেশের অধিকাংশ মানুষ, নারী এবং পুরুষ উভয়ের মনস্তত্ব পুরুষতান্ত্রিক। এই মনস্তত্বের বৈপরীত্য এই যে, তারা পুরুষের বেলায় যা অনায়াসে মেনে নেয়, নারীর বেলায় তাতেই আঁৎকে ওঠে। নারী মিডিয়াকর্মী! সে এবার পঞ্চায়েত সম্পদ। তাঁর কোনো মানবিক ব্যক্তি ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকতেই পারে না। তাঁর টিকে থাকা এবং বেঁচে থাকা নির্ভর করে ক্ষমতাশালীর ইচ্ছায়। এখানে বরং তাঁকে নির্জীব জড় পদার্থের সাথে তুলনা করা যায়।

রাত-বিরাতে ক্লাব খোলা থাকবে। পুরুষ অবাধে যাবে। তাদের বহুগামিতা স্বাভাবিক। কিন্তু নারী কেন যাবে! যে পুরুষ যাবে সে বিত্তশালী, ক্ষমতাশালী, যে নারী যাবে- সে কী? সে বেশ্যা, পতিতা, নষ্টা। এক যাত্রায় ফল ভিন্ন। এটা সামাজিক মাইন্ডসেট। অতএব সেই নষ্টা, ভ্রষ্টা নারীকে শারীরিক মানসিক হেনস্থা, নির্যাতন, চড়, থাপ্পড়, খুন করাও জায়েজ। আর অশ্লীল মৌখিক গালাগালির কথা তো বলাবাহুল্য।

অতঃপর সেই নারী চুপচাপ হজম করে ঘরে বসে থাকবে, নতুবা মুনিয়ার মতো ফ্যানে ঝুলে পড়বে। পরীমনির মতো যে দু’চারজন প্রতিবাদী হবে, শুরু হবে তাঁর চরিত্র নিয়ে টানাটানি। যেনো এই নির্যাতন, এই ধর্ষণের চেষ্টা, হত্যার চেষ্টার চেয়ে বড় অপরাধ এই মেয়ের- সে গেলো কেন? সে চরিত্রহীন, অতএব তাঁর সঙ্গে এমন ঘটাই তো স্বাভাবিক। ফলত সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে অপরাধীর শাস্তি চাইবার দাবিটি ক্ষীন হয়ে নারীর আচরণ এবং চারিত্রিক মুখোরোচক আলোচনা মুখ্য হয়ে ওঠে।

দীর্ঘ চর্চায় এই ব্যবস্থা নারীর জন্য চরিত্র হননের নানাবিধ গালির সন্নিবেশ ঘটিয়েছে অভিধানে। আর পুরুষের জন্য কী জানেন? বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।  জানেন ভদ্দরনোকেরা? এই এগিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে কত পশ্চাৎপদ, কূপমণ্ডূক আপনি? যদি পরীমনির পাশে না দাঁড়ান, যদি দৃষ্টিভঙ্গী এবং বস্তাপঁচা ধারণাগুলো না-বদলান তা আপনার জন্যই বুমেরাং হবে। বিপদ চলচ্চিত্র অভিনেত্রী থেকে আপনার ঘরের কর্মজীবী মেয়েটির দিকে ধেয়ে আসতে সময় নেবে না।

সময়ের চাকা পেছনের দিকে যায় না। আপনার আমার মেয়ে, আমাদের মা-চাচীর মতো ঘরে পঞ্চব্যঞ্জন রান্নায় জীবনকে সীমায়িত করবে না। সময়ের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলাতে না পারলে আপনার সামগ্রিক অগ্রগতির গাড়ি ব্রেক ফেইল করে দুর্ঘটনায় পতিত হবে। 

লেখক: নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক

আরো পড়ুন:

পরীমনিকে আমার অভিবাদন : ম্যারিনা নাসরীন

পরীমনি থেকে প্রান্তিক নারী: নিরাপদ কে? : শান্তা মারিয়া