বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও আওয়ামী লীগ অভিন্ন নাম। পাকিস্তান শাসনামলে এই দলের কর্মীরা সরকারের রোষানলে পরে নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখে দলের জন্য কাজ করেছেন। এই দলের কর্মীরা স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। নির্যাতনের মুখে দলের নেতারা সারা দেশ ঘুরে সংগঠিত করেছেন কর্মী ও জনগণকে। এই কাজটি সহজ ছিল না। স্বাধীনতার পর দেশ গড়ার সংগ্রাম এবং সামরিক ও অসামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তান আমলে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী অভিযাত্রাকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা আঞ্চলিক বৈষম্য ও জাতিগত নিপীড়নের মাধ্যমে বাংলার জনগণকে শোষণ করে। নবগঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য থেকে পাকিস্তান সরকার দূরে সরে যায়। যারা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারাও দল ও সরকার থেকে দূরবর্তী। অথচ এই কর্মীরাই পাকিস্তান আন্দোলনে অগ্রভাগে ছিলেন। এই কর্মীরাই বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের কথা ভাবেন। একই সময়ে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়ী হন দলের কর্মী শামসুল হক। যার ফলে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল কর্মীদের ঐক্য গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি রাজনৈতিক কর্মীদের একাংশ গঠন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে কর্মী সম্মেলন আয়োজিত হয়। মুসলিম লীগ ও সরকারের সম্মেলন ব্যর্থ করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ৩০০ কর্মী যোগ দেয়।
অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসেবে পথচলার শুরুতেই বাধা পেয়েছে কিন্তু দমে যায়নি। কোনো স্থান না পেয়ে একজন ব্যক্তির বাড়িতে দলের কর্মীরা প্রথম সম্মেলন করেছে। রাজনৈতিক নেতা আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। এই সভায় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, খয়রাত হোসেন, বেগম আনোয়ারা খাতুন আলী আহমেদ খান প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ গঠন সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে রচনা করেন:
‘...সকলেই একমত হয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী [মুসলিম] লীগ।’ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে, ‘নিরাপত্তা বন্দি’।’ [শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ১১৯-১২১]
আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকদের জানা প্রয়োজন এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার পরপরই তা মুসলিম লীগের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগ ধর্মীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে গঠিত দল ছিল না। তারপরও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে এই দলটির বিকশিত হওয়ার মূল কারণ বাঙালির অধিকার আদায়ে আপসহীন ভূমিকা। ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে আওয়ামী মুসলিম লীগের গভীর যোগ ছিল, তাই দলের প্রথম মেনিফেস্টোতে লেখা হয়েছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে হবে। একই সময়ে দেশজুড়ে খাদ্যঘাটতি, দেশত্যাগী হিন্দুদের সম্পদ স্থানান্তর ও মুসলিম লীগ নেতাদের লুটপাটের ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। গণদাবি আদায়ে রাজপথে থাকার ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। নবগঠিত দলের যুগ্ম সম্পাদক অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার মানুষ ছিলেন, তাই দলের নামে ‘মুসলিম’ শব্দ থাকা বিষয়ে তিনি রচনা করেন:
‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম সময় এখনও আসে নাই। তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন।’ [শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ১২১]
তাঁর এই ভাবনা থেকেই বোঝা যায় একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ জন্মলগ্নে যে কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে সেটিও সে সময়ের বিবেচনায় অগ্রসর ছিল। যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা; পাট, চা, ব্যাংক বীমা, বিদ্যুৎ খনিজ সম্পদসহ প্রাথমিক শিল্প জাতীয়করণ; কুটিরশিল্পের উন্নয়নে সাহায্য এবং প্রশাসনের ব্যয় হ্রাস। যার কারণে পাকিস্তানের শাসকচক্র এই নতুন দলের উত্থানকে ভালোভাবে দেখেনি। ভাষা-আন্দোলনে দলের নেতা কর্মীরা সক্রিয় অংশ নেয়। ১৯৫১ সালের আদমশুমারির সময় দলের কর্মীরা গণনাকারীদের সম্মুখে জনগণ যেন উর্দু ভাষায় নিজেদের জ্ঞানের কথা স্বীকার না করে সেজন্য প্রচারনা চালায়। [শ্যামলী ঘোষ, ২০০৭ :৭] ভাষা-আন্দোলনে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ ও নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগ এবং ভাষা-আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ মূখ্য ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ভাষা-আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দিদের অন্যতম। তিনি ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ আটক হন।
প্রতিষ্ঠার ৪ বছর পর আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের জুলাইতে পুরান ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে সম্মেলনের আয়োজন করে। উল্লেখ্য, দল প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ সম্মেলেনের আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনকে ব্যর্থ করার জন্য সরকার নানা কৌশল করে। ইয়ার মোহাম্মদ খানের কারণে তারা অধিবেশন বন্ধ করতে পারেনি, কেননা তিনি ছিলেন ঢাকার প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। কাউন্সিলারদের জন্য কোনো হোটেল ভাড়া পাওয়া যায়নি তাই সদরঘাটে নৌকা ভাড়া করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। [শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ২৩৭] এই অধিবেশনে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান সাংগঠনিক প্রতিবেদনে বলেন, “শোষক আর শোষিতের সংঘাত ভঙ্গুর ধ্বংসোন্মুখ সমাজকে ধ্বংসের হাত হইতে উদ্ধার করিবার জন্য শোষণের অস্ত্রগুলির উপর আক্রমণই আমাদের প্রথম কাজ।” [হারুন-অর-রশিদ, ২০১৬ : ৩৯৫]
এ থেকে উপলব্ধি করা যায় এক সংগ্রামী চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগ পথ চলেছে। একই সঙ্গে শোষিত জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দলটি ভূমিকা পালন করছে। এই সম্মেলনে দলের নামকরণে অসাম্প্রদায়িক ভাবনার সূত্রপাত করা হলেও তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। ১৯৫৩ সালের নভেম্বরে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ বিশেষ সম্মেলনের আয়োজন করে। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই সম্মেলন ময়মনসিংহে আয়োজিত হয়। সম্মেলনে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয় দলটি, একই সঙ্গে ৪২ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। এই ইশতেহারে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা এবং ২১শে ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণার কথা জানানো হয়। একই সঙ্গে পূর্ববঙ্গকে দেশরক্ষার ব্যাপারে আত্মনির্ভরশীল করা এবং বাংলাদেশে সামরিক কলেজ ও অস্ত্র কারখানা স্থাপনের দাবি জানানো হয়। দাবিসমূহ থেকেই উপলব্ধি করা যায়, আওয়ামী মুসলিম লীগ বাঙালির অধিকারের পথে হাটছিল। আওয়ামী লীগ শক্তিশালী দল হওয়া সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। ২১ দফার ভিত্তিতে গঠিত যুক্তফ্রন্ট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৬৪ ভাগ ভোট পেয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্র যুক্তফ্রন্টকে ক্ষমতায় থাকতে দিতে চায়নি। তাই কাগজকল ও পাটকলে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা লাগানো হয়। পাকিস্তানিনী শাসকচক্রের ষড়যন্ত্র এবং ফ্রন্টের মধ্যে অনৈক্যর কারণে যুক্তফ্রন্ট আর ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। নানা সংকটের মুখে পাকিস্তানে সামরিক শক্তির রাজনীতিতে প্রবেশ শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে টানা দুই বছর দুই মাস তের দিন আটক রাখা হয়। একই সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন শুরু করে ক্ষমতাসীনরা। দলের দেড় হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। এই নির্যাতন নিপীড়নের মধ্যেও জনগণের দাবি আদায়ের জন্য দল সংগঠিত হয়। ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে যে সিদ্ধান্তটি উল্লেখের দাবি রাখে তা হলো আওয়ামী মুসলিম লীগের অসাম্প্রদায়িকীকরণ, দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি চলে যায়। এই সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “বস্তুত আওয়ামী লীগ দলকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অবারিত করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হব।” [ সাধারণ সম্পাদকের বার্ষিক প্রতিবেদন ১৯৫৫]
আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে (ছবি: সংগৃহীত)
দলের সভাপতি আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিষয়টি ভোটে দেন; ৫ জন কাউন্সিলার ছাড়া বাকিরা দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার পক্ষে ভোট দেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের দল হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। এদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চা ও লালনে আওয়ামী লীগ সর্বদাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এই সম্মেলনে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে পাটচাষীদের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার দাবি উত্থাপিত হয়। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চাও বিশেষ বৈশিষ্ট্য, আওয়ামী লীগের সম্মেলন থেকে জানা যায় সকল সিদ্ধান্ত কাউন্সিলারদের মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে দলের আয়-ব্যয় বিবরণীও ১৯৫৫ সালের সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়।
আওয়ামী লীগকে বিশ্লেষণ করতে হবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোয় দাঁড়িয়ে। কেননা দলের প্রতিষ্ঠাকালে মুসলিম লীগ ও সমমনা দলের পক্ষ থেকে একে মূল্যায়ন করা হয়েছে, ‘কমিউনিস্ট’, ‘ভারতের চর’, ‘যুক্ত বাংলার সমর্থক’, ‘পাকিস্তানের শত্রু’ হিসেবে। আওয়ামী লীগ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম বিরোধী দল। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী দল গঠন করা সহজ ছিল না। দ্বিজাতিতত্ত্বের আবরণে দেশে ধর্মীয় উম্মাদনা বা উগ্রবাদ তখন পর্যন্ত প্রবল ছিল। সেখানে একটি দল অসাম্প্রদায়িক চিন্তনের বিকাশ ঘটাচ্ছে।
ভারতের অন্তর্ভুক্ত জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের একটি মসজিদে সংরক্ষিত মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর মাথার কথিত কেশকে কেন্দ্র করে ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৪ সালের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথমে হিন্দু ও মুসলমান, পরে বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই দাঙ্গায় হত্যার পাশাপাশি বিহারি সন্ত্রাসীরা মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের ছাত্রী হোস্টেলে আক্রমণ চালিয়ে মেয়েদের শ্লীলতাহানি করে। এই দাঙ্গা প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ভূমিকা রাখেন। তিনি সর্বস্তরের নাগরিকদের নিয়ে গঠিত ‘দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি’র অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ প্রচারপত্র লক্ষ লক্ষ কপি ছাপিয়ে তা সারাদেশে বিলির ব্যবস্থা করেন। বিষয়টি আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে যে সে সময়ে সামরিক শাসন চলছে। তিনি ও তাঁর দলের নেতাকর্মীরা জেল জুলুমের ভয় পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আইয়ুব সরকার এই প্রচারপত্র প্রকাশ ও বিলির জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি মামলায় অভিযুক্ত করে। ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইয়ুব খান পাকিস্তানের উভয় অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট লাভ করলেও আওয়ামী লীগের প্রচার প্রচারনার কারণে, পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে অনেক কম ভোট পান। অপরদিকে, ফাতেমা জিন্নাহ পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় দ্বিগুণ ভোট লাভ করেন। উল্লেখ্য, এই নির্বাচনে ভোটার ছিল মৌলিক গণতন্ত্রীরা।
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ বাঙালিকে স্বায়ত্তশাসনের দিকে ধাবিত করে। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের পক্ষে ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৬৬ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফাকে দলের কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা। উল্লেখ্য এই সম্মেলনে উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটি পরিবেশন করা হয়। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার প্রচার শুরু করেন। এই প্রচারকালে তিনি ৩ মাসে মোট ৮ বার গ্রেপ্তার হন।
নারায়ণগঞ্জের জনসভায় যোগদান করে ঢাকায় ফেরার পর ১৯৬৬ সালের ৮ মে রাতে নিজ বাসভবন থেকে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং প্রায় তিন বছর কারারুদ্ধ থাকেন। এ অবস্থায় রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে আগরতলা মামলায় তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। দলের অসংখ্য নেতা-কর্মী আটক হয়। কিন্তু দল দমে যায়নি। সারা দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা প্রিয় নেতাকে জেল থেকে মুক্ত করে।
৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জনসমর্থন পেয়ে বিজয়ী হয়। কিন্তু ক্ষমতা পায় না বাঙালিরা। আবার আন্দোলনের প্রস্তুতি, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। দেশের মানুষকে জানিয়ে দেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১-এর মার্চে বাংলাদেশে একই সঙ্গে দুটো সরকার চলমান ছিল, একদিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনগণের সরকার আর অন্যদিকে পাকিস্তান সরকার। ২৩শে মার্চ, সেনানিবাস ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি। এ থেকে অনুমান করা যায় দল হিসেবে কতটা জনসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগ। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। এই মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক প্রক্রিয়াও দলটির পক্ষ থেকে পরিচালিত হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়। নয়মাসের লড়াই শেষে ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি বিজয়ী হয়।
১৯৪৯ সালে যে স্বপ্ন থেকে পথ চলেছিল আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর সেই স্বপ্নের প্রথম ধাপের বাস্তবায়ন করে। এই দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মনে রাখা দরকার যে একটি সংগ্রামী পথ পেরিয়ে দলটি অগ্রসর হয়েছে। এই পথচলায় দেশের সাধারন মানুষ সব সময় এই দলের পাশে ছিল। তাই সাধারণ মানুষের কল্যাণে কর্মসূচি প্রনয়ন এবং বিপদে তাদের পাশে থাকাই হবে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর দায়। আজ বিশ্বজুড়ে যে মহামারি পরিস্থিতি তাতে রাজনৈতিক দল হিসেবে এই দলের কর্মীদের অনেক দায়িত্ব আছে। আমাদের আশা সরকারের পাশাপাশি তারাও নিজ সম্পদ, শ্রম ও মেধা দিয়ে বৈশ্বিক মহামারিতে জনগণের পাশে থাকবেন। তাহলে যে প্রত্যাশা থেকে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ সংগ্রামী যাত্রা শুরু করেছিল সে যাত্রা অব্যাহত থাকবে।
সহায়ক গ্রন্থ শেখ মুজিবুর রহমান (২০১২), অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, ঢাকা শ্যামলী ঘোষ (২০০৭), আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-১৯৭১, অনুবাদ হাবীব-উল-আলম, ইউপিএল, ঢাকা হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
লেখক: নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়