রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে শতাব্দিতে জন্মগ্রহণ করেন সেই শতাব্দি ছিলো মানবসভ্যতার সবচেয়ে অন্ধকার সময়। সেই সময়ে পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মমত প্রচলিত ছিল। সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী তার বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ নবীয়ে রহমতে এসব ধর্ম ও সভ্যতার বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছেন, সবগুলো ধর্ম ও সভ্যতা জুলুম, নিপীড়ন ও জোরজবরদস্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছিল। ধর্মের নামে এমন সব আচরণ হতো যা মানবীয় বুদ্ধিমত্তার উপযোগী ছিলো না। সামাজিক সম্পর্কগুলো প্রায় বন্য সম্পর্কে পরিণত হয়েছিলো।
পড়ুন: আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী
এমন এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার সময়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম এবং তার নবুওয়াত গোটা পৃথিবীর জন্যই এক অনাবিল আনন্দ বয়ে এনেছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগের পৃথিবী আর পরের পৃথিবী রাত-দিনের মতো আলাদা। ফলে তার জন্ম মানবতা ও সভ্যতার জন্য এক চিরন্তন আনন্দের উৎস।
১২ বরিউল আওয়াল আমাদেরকে সেই আনন্দঘন ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় বলে মুসলিমরা এই দিনে উৎফুল্ল হয়, আনন্দিত হয়। এই আনন্দ গোলামী থেকে মুক্তির আনন্দ, ধ্বংস থেকে বাঁচার আনন্দ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে রবিউল আওয়ালে জন্ম নিয়েছেন তার থেকে আজকের পৃথিবী ইংরেজি হিসেবে সাড়ে এক হাজার ৪০০ বছর দূরে সরে এসেছে। ফলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে জাহিলিয়্যাহ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলেন মানুষ আবারো সেই জাহিলিয়্যাতে ফিরে যাচ্ছে। সভ্যতা আবারো তাঁর আগের অন্ধকারে ফিরে যাচ্ছে। মানুষের মাঝে লোভ-লালসা প্রধান্য পাচ্ছে। অর্থের জন্য মানুষ সব ধরণের নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিচ্ছে। পরিবার প্রথা ভেঙে যাচ্ছে, সামাজিকভাবে হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়ছে। স্বার্থের জন্য মানুষ মানুষকে নির্মমভাবে ঠকাচ্ছে, হত্যা করছে।
১. ফলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই জন্ম তারিখ যেনো কেবলই আনন্দ আর উৎসবে পরিণত না হয়ে বরং আজকের দিনের প্রতিজ্ঞা হোক যে, আমি আমার জীবনকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক সাজাবো।
২. বিশ্বব্যাপী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অপমান করার একটি সক্রিয় প্রচেষ্ঠা বিদ্যমান। আবার মুসলমানদের মাঝেও সিরাত চর্চার প্রচলন দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। আজকের এই দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক যে, আমরা আগামী দুইমাসে অন্তত একটি সিরাত গ্রন্থ পুরোপুরি অধ্যায়ন করবো।
৩. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পূর্ণ জীবনই অনুসরণীয়। আজকে আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, আজ থেকে অন্তত পাঁচটি সুন্নাহ আমি পালন করবো।
পড়ুন: কোরআনের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)
৪. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে কোন মানুষকে শারীরিক ও মানসিককষ্ট দেননি। আজকে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, আজ থেকে আমি কাউকে কখনো কোনো ধরনের কষ্ট দিব না।
৫. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জেনে রেখ! কোনো মুসলিম যদি অমুসলিম নাগরিকের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করে, তার কোনো অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোনো জিনিস বা সহায়-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়; তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমি তাদের বিপক্ষে অমুসলিমদের পক্ষে অবস্থান করব।’ (আবু দাউদ)। আজকে আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, আমি কখনোই কোন অমুসলিমের সাথে কোন ধরনের খারাপ আচরণ করবো না।
৬. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো মিথ্যা কথা বলেন নাই। আজকে আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, আমি আর কখনো মিথ্যা কথা বলবো না।
৭. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের মুহূর্তেও আমানতের কথা ভুলে যাননি। তিনি কাফেরদের আমানত পৌঁছে দিতে হজরত আলী (রা.) কে মক্কায় রেখে গিয়েছেন। আজকের এই দিনে আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, আজ থেকে আমরা কোন ধরনের আমানতের খেয়ানত করবো না। রাষ্ট্রীয় আমানত, ব্যবসায়িক আমনতসহ কোনো ধরনের আমানতের খেয়ানত করবো না।
৮. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমা চুরি করলেও আমি তার হাত কেটে দেব।’ (বুখারি : ৩২৮৮)। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তিনি এতটাই কঠোর ছিলেন। আজকের দিনে আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার করবো।
৯.রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি যা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ ’। (সুনান বাইহাকী, হাদীস নং ২০৩৩৬)। আজকের দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক যে, আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করবো এবং কুরআন ও সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণ করবো।
১০. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনার পথে হিজরতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে মুখ ফেরালেন জন্মভূমি মক্কার দিকে। যাত্রাপথে তিনি বার বার ফিরে তাকাচ্ছিলেন মক্কার দিকে। জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় তাঁর চোখ থেকেও ঝরছে অশ্রু। মক্কার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন আর বললেন- ‘হে মক্কা! তুমি আমার কাছে সমস্ত স্থান থেকে অধিক প্রিয়, আমি মক্কাকেই ভালোবাসি। আমার মন মানছে না। কিন্তু তোমার লোকেরা আমাকে এখানে থাকতে দিল না, সব কিছুর মালিক তুমি। মক্কার মানুষদের ঈমানের আলোয় উজ্জ্বল কর। ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত কর।’ (মুসনাদ আহমদ ও তিরমিজি)। এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেশপ্রেমের মাত্রা বোঝা যায়। আজকের দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক যে, আমরা আমাদের জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশের স্বার্থ রক্ষা ও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবো।
ঈদে মিলাদুন্নবীর এই দিনে যদি আমরা এই প্রতিজ্ঞাগুলো করতে পারি এবং সেই মতো আমল করতে পারি তাহলেই এইদিন আমাদের জন্য সাফল্যের কারণ হবে। আর যদি আমরা কিছু মিলাদ পড়লাম, মাহফিল শুনলাম কিন্তু নিজেকে বদলাতে কোন পদক্ষেপ নিলাম না তাহলে এই দিন আমার জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনলো না।
আল্লাহ তায়ালা এইদিনকে আমাদের আমল পরিবর্তনের উপলক্ষ বানিয়ে দিন। রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসয় তার অনুসরণে জীবনকে বদলে দেওয়ার সুযোগ দিন। আমিন।
লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ