ক্রিকেটে এটা রেওয়াজ। ৫০ পুরো করলে ব্যাটসম্যানের সেই কৃতিত্বে গ্যালারির দর্শকরা হাততালি দেন। হাফ সেঞ্চুরির স্বীকৃতির সেই আনন্দে ব্যাটসম্যানও ব্যাট তুলে অভিবাদনের জবাব দেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ আজ হাফ সেঞ্চুরির সেই আনন্দে হাত তুলেছে। মুষ্টিবদ্ধ সেই হাতের প্রতিজ্ঞা জানাচ্ছে, এখনই সন্তোষের কিছু নেই। করে দেখানোর আরও অনেক কিছু আছে। হাফ সেঞ্চুরি তো হলো, এবার সেঞ্চুরিটা করি!
- সেঞ্চুরি, কীসের? সাফল্যের সেঞ্চুরি। স্বীকৃতির আনন্দে মন্থিত হওয়ার সেঞ্চুরি। লড়ে জেতার মধ্যে যে আনন্দ আছে, আত্মোৎসর্গের মধ্যে যে বুক ফোলানো গর্ব আছে; বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকার দিকে যতবার তাকাই, সেই আনন্দ ছুঁয়ে যায় অলিন্দের প্রতিটি শিরায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি অর্জন অমর কাব্য।
পঞ্চাশ বছর আগে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দেশ স্বাধীনের জেদ নিয়ে লড়েছিলেন বলেই আজ আমরা নিজ দেশে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। বলতে পারছি- ‘বাংলাদেশ আমার দেশ’।
১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’; অমর সেই আহ্বানে মুক্তিকামী জনতা রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানের স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে। মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতার শপথ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা।
বিশ্বকে মুগ্ধ-বিস্মিত করে বাংলাদেশ নয় মাসের সেই কঠিন সংগ্রামে জয়ী হয়। নিজ পতাকা, নিজ মাটির জন্য যে ত্যাগ তিতিক্ষা ও আত্মোৎসর্গের অনুপম উদাহরণ তৈরি করেছে আমাদের স্বাধীনতাকামী জনতা-তা বিশ্বে বিরল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই স্বাধীন বাংলাদেশের আজ সুবর্ণজয়ন্তী। অভিনন্দন তোমাকে।
পঞ্চাশে পৌঁছানোর আনন্দে আনন্দিত বাংলাদেশ। বিজয়ের এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। সার্বিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সূচকের উত্তরণে বাংলাদেশ গোটা বিশ্বে অনন্য উদাহরণ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধ জিতেছিল। এখন এই পঞ্চাশে জিততে চলেছে আরেক লড়াই ‘অর্থনৈতিক উন্নতি’।
পেছনের এই সময়ে বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই উন্নয়ন করেছে। তবে চোখে পড়ার মতো সবচেয়ে বড় উন্নয়নের সূচক হলো মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। তলাবিহীন ঝুড়ির উদাহরণ টেনে একসময় যারা উপহাস করতেন, আজ তারাই বাংলাদেশের উন্নয়নের কারিশমায় মুগ্ধ।
সত্তরের দশকে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো, এখন ২০২১ সালে সেই হার মাত্র ২০.৫! ক্ষুধা-দারিদ্র্যে ক্লিষ্ট এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা প্রভৃতি কারণে পঞ্চাশ বছর আগে যে দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৭ বছর, সেই দেশের মানুষের গড় আয়ু আজ প্রায় ৭২.৩ বছর।
একসময় কাপড়ের অভাবে থাকা বাংলাদেশ এখন তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের তৃতীয় স্থানে আছে। লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। চমকপ্রদ সাফল্য দেখিয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায়। দেশের শতকরা ৯৪ ভাগ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা দেশ আমরা। ধান উৎপাদনে বিশ্বে অবস্থান চতুর্থ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
বৈদেশিক বিনিয়োগের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান এখন বাংলাদেশ। রেমিট্যান্স আয় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী করছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নেও স্বপ্নের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কারিশমা দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোরেল এখন আর দূরের কোন স্বপ্ন নয়। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু ১’ স্যাটেলাইট স্থাপন করেছে। আইটি সেক্টরে উন্নতি ঈর্ষণীয়।
বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমায় নিজেদের কর্তৃত্ব-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। জঙ্গিবাদের জড়-জট উপড়ে দেওয়ায়ও দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ এখন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩তম বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ফি বছর উন্নয়নের নতুন শিখরে উঠছে দেশ।
এক সময়ে এ অঞ্চলে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল। কিন্তু সেখান থেকে ক্রমশ বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে দেশের অর্থনীতি। বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে কৃষি খাতে। করোনার দুঃসময়ে আমাদের রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার বেড়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও বেড়েছে।
গত এক দশকে অর্থনীতিতে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকায় তাদের পক্ষে আর্থিক লেনদেন বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু ডিজিটাল ফাইন্যান্স তাদের আর্থিক লেনদেনের চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে।
১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিলো মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে সময় জিডিপির আকার ছিলো ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার। দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ। পঞ্চাশ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে রপ্তানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসেবে যা ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপি আকার ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেড়েছে ৩৬৯ গুণ। পরিমাণে যা প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ, অর্থাৎ ২ হাজার ৬৪ ডলার। দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ২০.৫ শতাংশ।
স্বাধীনতা লাভের পর যে দেশটি ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ; সেখানে এখন ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই দেশটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি।
শিক্ষা খাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। আশির দশকে বাংলাদেশে স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২৯.২৬ ভাগ। পঞ্চাশ বছরে সেটা এখন শতকরা ৭৫.৬০ ভাগ। তুলনামূলক চিত্রটা জানাচ্ছে বর্তমানে পাকিস্তানে স্বাক্ষরতার হার শতকরা ৫৯.১৩ ভাগ। মুদ্রা বিনিময় হারের আজকের হিসাব জানাচ্ছে, বাংলাদেশের ১ টাকা সমান পাকিস্তানের ২.৮ রুপি! যে পাকিস্তানকে যুদ্ধে হারিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে।
এসব রেখচিত্রই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের গর্বের কাহিনি। পঞ্চাশের সাফল্য গাঁথা। অভিবাদন আমার দেশ।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিংবিডি