মতামত

মাতৃভাষার শক্তি কাজে লাগাতে আমরা ব্যর্থ 

প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতিগঠনের একটি শক্তিশালী উপাদান প্রয়োজন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা ভাষা। ভাষাই পূর্ব বাংলার জনগণকে প্রথম সাংস্কৃতিক জাতিসত্তার দিকে ধাবিত করে। যার চূড়ান্ত পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ।

ভাষা বাংলাদেশীদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। ভূখণ্ড যত ছোট হোক, ১৮ কোটি মানুষের একটি দেশ একই ভাষায় কথা বলে, বলতে গেলে ৯৯ শতাংশ মানুষ সে ভাষা বোঝে, এমন সৌভাগ্য পৃথিবীর কম জনবহুল রাষ্ট্রের হয়েছে। ফলে কখনো রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়নি। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতকে দেখলে বোঝা যায় সেদিক থেকে কত সুবিধেয় আছি আমরা। কিন্তু এই সুবিধা স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। একটি ভাষাকে অবলম্বন করে জাতিকে শিক্ষিত ও কর্মক্ষম করে তোলার যে সরল পথ ছিল, কেন জানি সেদিকে আমরা গেলাম না। আমরা ধরেই নিয়েছি বাংলা ভাষা উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হতে পারে না। বৈশ্বিক যোগাযোগের তো নয়ই। তাই গত ৫০ বছর ধরে তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক ভাষা’ শেখানোর জন্য আমরা বিপুল বিনিয়োগ করেছি। তা অবশ্য পর্বতে মুষিক প্রসবের মতোই হয়েছে।

আমাদের সব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক ১০ বছর ইংরেজি শেখানো হয়। কিন্তু ৯০ শতাংশ (ধারণানির্ভর) শিক্ষার্থী ভাষার সাধারণ উদ্দেশ্যগুলো ইংরেজিতে সাধনে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে পরবর্তী প্রজন্মকে এই ভাষা শেখানোর মতো পর্যাপ্ত জনশক্তি সৃষ্টি হচ্ছে না। আবার জনশক্তি সৃষ্টি হচ্ছে না বলে শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে ইংরেজি শিখতে পারছে না। এ যেন এক অশুভ চক্র। এ থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু আউট অব বক্সে গেলেই এর সমাধান মিলে যেত। যে সীমিত ইংরেজি জানা জনশক্তি আছে তাদের দিয়ে সব শিক্ষার মাধ্যমগুলো অনুবাদ করে নিলেই বিশাল জনগোষ্ঠীর সকলের বিদেশী ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন ছিল না। অনেকটা চামড়া দিয়ে পৃথিবী না ঢেকে পা ঢাকার মতো। আর যারা ইংরেজি শিখতে চায় তাদের জন্য দুয়ার অবারিত থাকুক। 

বিদেশী ভাষায় রচিত জ্ঞান বিজ্ঞান বাংলা ভাষায় আত্তীকরণের চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। বিশেষ করে বিজ্ঞানে প্রচুর বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে। কিন্তু এসব কেন জানি ব্যবহারকারীদের সুবিধার দিক দেখা হয়নি। বরং ভাষাবিদদের পাণ্ডিত্যের প্রতিফলনই ছিল লক্ষ্য। একটা উদাহরণ দেই। ইংরেজি open seed-এর বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে নগ্নবীজ। লক্ষ্য করুন, ইংরেজি কিছুটা বোঝা গেলেও, বাংলা দুর্বোধ্য। ফলে তৎসম ভাষানির্ভর এসব পরিভাষা শিক্ষার্থীদের কাছে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে অনর্থক মনে হয়। তাই অম্লজানের পরিবর্তে অক্সিজেনই সবাই ব্যবহার করে।

ভাষার দায় কেন জানি সামষ্টিক পর্যায়ে না নিয়ে ব্যষ্টিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যক্তি বিদেশী ভাষা শিখে বহির্জগতের জ্ঞান অর্জন করে রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করবে। কিন্তু চীন রাশিয়া কিংবা ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলোতে এমন দেখা যায় না। বাংলাদেশে কর্মরত চৈনিক ও কোরিয়ান প্রকৌশলীদের ইংরেজি ভাষার দক্ষতা রীতিমতো হাস্যকর। কিন্তু তাদের প্রাযুক্তিক দক্ষতা ঈর্ষণীয়। ভাষিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে তারা সবচেয়ে এগিয়ে। এর কারণ তারা মাতৃভাষায় সকল প্রকার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। জ্ঞানার্জনের জন্য অন্যের দুয়ারে হাত পাততে হয়নি।

এই উপমহাদেশে মাতৃভাষা নিয়ে আবেগ বাঙালিদের পরেই বোধহয় তামিলদের। তারা বাঙালিদের চেয়ে অন্তত ১৫ বছর আগে ভাষা আন্দোলনে নামে। ১৯৩৭-এ কংগ্রেস মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে (যা এখন তামিলনাড়ু প্রদেশ) সি রাজ গোপালালচারীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গঠনের পর হিন্দিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ই.ভি রমাসামি (পেরিয়র)-এর নেতৃত্বে তখন যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল তা অভাবনীয়। মাদুরাই শহর শিক্ষার্থীদের বুকের রক্তে লাল হয়েছিল। পরবর্তীতে পেরিয়রের শিষ্য সি.এন. আন্নাদুরাই এ আন্দোলনকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যান। এখনও আন্না সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত আন্না ইউনিভার্সিটি এখন ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা বিদ্যায়তন। 

তারা কিন্তু তাদের ভাষার অহং প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের একমাত্র তামিলনাড়ু রাজ্যে আদালতে তামিল ভাষায় বিচার কার্য পরিচালনা করা হয়। সত্তরের দশকের পর থেকে সর্বভারতীয় কোন দল তামিলনাড়ুতে সরকার গঠন করতে পারেনি। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে সব রাজ্যের পরীক্ষার্থীকে হিন্দি ভাষায় পরীক্ষা দিতে হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম তামিলনাড়ু। 

কিন্তু সেই তামিলরাও কিন্তু আমাদের মতো ‘ভাষান্ধ’ হয়ে পড়েনি। তারা ভাষার শক্তি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও প্রগতির কাজে বুদ্ধিদীপ্তভাবে ব্যবহার করেছে। দুমাস চেন্নাইতে অবস্থান কালে আমি সেসব দেখেছি। তারা হিন্দির আগ্রাসন রুখে দেয়ার জন্য ইংরেজি খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে। যেখানে যে ভাষার প্রয়োজন সেই ভাষা তারা শিখে নেয়। ভেলোর কিংবা এ্যাপলো হাসপাতালে গেলে দেখবেন প্রচুর তামিল স্বাস্থ্যকর্মী বাংলায় কথা বলছেন। তামিলনাড়ুর প্রতিটি সাইনবোর্ড ও নির্দেশনায় তামিলের পাশাপাশি ছোট করে হলেও ইংরেজিতে লেখা আছে। এতে পর্যটনের বিকাশ ঘটে। বাইরে থেকে আসা লোকজন স্বচ্ছন্দবোধ করে। অথচ আমরা যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে ইংরেজির ব্যবহার করছি। চাচ্ছি সব মানুষ বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজি শিখুক। অন্যদিকে রাস্তাঘাটের সাধারণ নির্দেশনাগুলো একভাষাতে লেখা হচ্ছে। আমাদের মাথায় নেই এই রাস্তা একজন বিদেশী ব্যবহার করতে পারেন। কোন যুক্তিতে ট্রেনের কামরার নম্বর বাংলা বর্ণমালায় লেখা হয়? একজন বিদেশীর পক্ষে কী ক খ-এর সিরিয়াল মিলিয়ে ট্রেনের কামরা খুঁজে বের করা সম্ভব?

ভাষা নিয়ে একটা হ য ব র ল অবস্থার মধ্যে আমরা আছি। কখনো আমরা বিশ্বায়নের ধুয়ো তুলে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা’র প্রতি অতি-উদার। কখনও আবার ‘ভাষা সাম্প্রদায়িক’। কখনোই আমরা ভাষার বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ ঘটিয়ে জাতীয় উন্নয়নে তৎপর হইনি। মাতৃভাষার নিহিত শক্তি কাজে লাগাতে বরাবরই আমরা ব্যর্থ।