পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বড় ধরনের একটি সমাবেশে ভাষণ দেন। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কায়েদে আযম বা জাতির পিতার অনন্য মর্যাদা তাঁর। জনসভায় প্রচুর লোক সমাগম ঘটেছিল। অন্য অনেকের সঙ্গে সভায় উপস্থিত ছিলেন খ্যাতিমান কবি গোলাম মোস্তাফা। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর শিশুপুত্র মোস্তাফা মনোয়ারও জনসভায় সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি বাংলাদেশের চিত্রকলা জগতে বিশিষ্টজন হিসেবে পরিচিত হন।
মোস্তাফা মনোয়ার আমাকে বলেছেন, জিন্নাহ সাহেব যখন বলেন- উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, তাঁর পিতা ক্ষুব্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজের আসন ছেড়ে আমাকে (মোস্তাফা মনোয়ার) নিয়ে সভাস্থল ছেড়ে যেতে যেতে বলেন- ‘যে নেতার কাছে বাংলা ভাষার মর্যাদা নেই, তার বক্তব্য শুনব না। বাংলা ভাষা না থাকলে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব থাকবে না।’
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের মোট লোকসংখ্যার ৫৬ ভাগ ছিল বাঙালি, তাদের মাতৃভাষা বাংলা। তাদের ভাষা সমৃদ্ধ, সংস্কৃতি গৌরব করার মতো। জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা সফরের এক সপ্তাহ আগে ১১ মার্চ (১৯৪৮) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল বা বন্ধ পালিত হয়। এই হরতালের পিকেটিং করতে গিয়ে ঢাকাতেই যে ৭৫ জন গ্রেফতার হয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
জিন্নাহ সাহেব ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। কার্জন হলে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে তিনি রেসকোর্সের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। কিন্তু রেসকোর্সে প্রতিবাদ ছিল ক্ষীণ, কার্জন হলে তা অনেক সাহসী ও বলিষ্ঠ- ‘এটা হতে পারে না। বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।’
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে। এর কারণও ছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এক সমাবেশে বলেছিলেন- উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে। এর প্রতিবাদে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ছিলেন কারাগারে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ভাষার দাবিতে আন্দোলনের সমর্থনে তিনি কারাগারে থেকেই অনশন করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের প্রাঙ্গণের ঐতিহাসিক আমতলায় ২১ ফেব্রুয়ারি বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী সমবেত হয়েছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা অধিবেশন ভবনের (এক সময় জগন্নাথ হলের মিলনায়তন) দিকে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের সাহায্যে তাদের থামাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে প্রথম যার মৃত্যু ঘটে, তাঁর অবস্থান ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি অংশে। সেখানেই ছাত্রছাত্রীরা নির্মাণ করে শহীদ মিনার। মুসলিম লীগের নুরুল আমিন সরকার এ শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। কিন্তু বাঙালির অঙ্গীকার- ‘ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙ্গুক... ভয় কী বন্ধু / আমরা তো আছি চার কোটি পরিবার।’
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলে ২১ দফার অঙ্গীকার অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয় সেই প্রথম শহিদ মিনারের স্থানে। নকশা প্রণয়ন করেন শিল্পী হামিদুর রাহমান ও নভেরা আহমদ।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। শহিদ মিনারের নির্মাণ কাজ স্থগিত থাকে। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহিদ বরকতের মা হাসিনা বেগম কালো-ফিতা কাটার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন। সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান ও আতাউর রহমান খানসহ অনেক রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন।
সেই ১৯৫২ সাল থেকেই ২১ ফেব্রুয়ারি এ দেশের গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার পরিণত হয় বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে শপথ গ্রহণের স্থানে। এরপর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের কারাগারগুলোতে দলমত নির্বিশেষ রাজবন্দিরা মুক্তিলাভ করার পর শহিদ মিনারে এসে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও শপথগ্রহণ রেওয়াজে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শহিদ মিনারেই চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাঙালি আর যেন অপমানিত-লাঞ্ছিত না হয়। শহিদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।
পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের সহযোগীরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের ভীতে লিখে রাখে ‘মসজিদ’। গুঁড়িয়ে দেওয়া সেই শহিদ মিনারের ভীতের ওপর নাম না জানা কেউ দুটি ইট এমনভাবে রেখেছিলেন যেন শহিদ মিনারটি ফিরে এসেছে। ইট দুটির সঙ্গে একটি পুরনো খবরের কাগজে লিখে রাখা হয়েছিল: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’
২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশজুড়ে গণহত্যা অভিযান শুরু করে। ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। এ সময় হাজার হাজার মানুষ ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে হাজির হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। হৃদয়ে যে শহিদ মিনার, প্রেরণা যে শহিদ মিনার!
পাকিস্তানিরা এ কারণেই একাত্তরের মার্চ মাসের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়। হানাদারদের এ দেশীয় সহযোগীরা শহিদ মিনারের ভেতের একটি স্থানে লিখে দেয় ‘মসজিদ’। কিন্তু বীর বাঙালির বুকের ভেতর আগুন জ্বলে! একুশের চেতনা মুছে যাওয়ার নয়, ইটের মিনার ভেঙে দিলেও যা বিলীন হয় না। একুশ মানে মাথা নত না করা!
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে গণহত্যা চলাকালেই বিধ্বস্ত শহিদ মিনারের স্থলে অসম সাহসী কেউ দুটি ইট রেখে ‘নির্মাণ’ করেন অস্থায়ী শহিদ মিনার। সেই ইটেই চাপা দিয়ে রেখে দেয় একটি পোস্টার, যেটা লেখা হয়েছিল পুরনো একটি সংবাদপত্রের কাগজে। পোস্টারে লাল রঙে লেখা ছিল: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। সে সময় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে লড়ছিলেন বীরের মতো। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্যত মারণাস্ত্র উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের স্থানে ‘ইট’ রেখে শহিদ মিনার নির্মাণও ছিল মুক্তিযুদ্ধ!
জাতিসংঘ মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। বিশ্বের কোনো ভাষা যেন হারিয়ে না যায়, সকল ভাষা যেন সচল থাকে এবং সাহিত্য যেন বিকশিত হয় সে লক্ষ্যে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, যার সদর দফতর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। যে দিবস ছিল বাংলাদেশের বাঙালির নিজস্ব, তা এখন পালিত হয় দুই শতাধিক দেশে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...’ গাওয়া হয় সর্বত্র, এমনকি পাকিস্তানেও। এ গানের সুর দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মাহুতি দেন।
আরও দুটি শহিদ মিনারের কথা
১৯৬৮ সালে আমি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। একইসঙ্গে বরিশালের গৈলা স্কুলে শিক্ষকতাও করছি। মহান ২১ ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে আমি ও অগ্রজ আশীষ দাশগুপ্ত গৈলা বাজার থেকে চাঁদা তুলে স্কুল প্রাঙ্গণে নির্মাণ করি ভাষা আন্দোলনের অমর শহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার। ৫৪ বছর পরও সে শহিদ মিনারটি টিকে আছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হলের শহিদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে আমি উদ্যোগী হয়ে (সে সময় আমি এ ছাত্রাবাসে থাকি, ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক) এ শহিদ মিনারটি পুনঃনির্মাণ করি। এর অর্থ সংগ্রহের জন্য অভিনব উপায় অনুসরণ করা হয়- ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্লাড ব্যাংকে প্রায় দুইশ ছাত্র রক্ত বিক্রি করি। জনপ্রতি ৪০০ সিসি রক্তের জন্য মেলে ৪০ টাকা করে। শহীদের রক্তঋণ শোধ করা যায় না, কিন্তু তাঁদের যথাযথ মর্যাদা তো দিতে পারি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক