২৩ মার্চ তাহলে সবসময় কষ্টের নয়। কান্নার নয়। জয়ের দিন। আনন্দেরও বটে।
একটু পেছনে ফিরি।
২০১৬ সালের ২৩ মার্চ। ব্যাঙ্গালোরের চিন্নাসোয়ামি স্টেডিয়াম। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ম্যাচে প্রতিপক্ষ ভারত। নিশ্চিত জয় থেকে এক কদম দূরে বাংলাদেশ। উইকেটে তখনো মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ। ম্যাচ জিততে শেষ ওভারে চাই ৩ বলে দুই রান। কিন্তু সেই ম্যাচও বাংলাদেশ হেরে গেল ১ রানে। ম্যাচের তিন বলে তিন উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
এমন ম্যাচও কেউ হারে! বাংলাদেশ ক্রিকেটে চিরদুঃখী ম্যাচ হয়ে আছে ব্যাঙ্গালোরের সেই টি-টোয়েন্টি। ক্রিকেট সেদিন কেড়ে নিয়েছিল বাংলাদেশের নিশ্চিত জয়-আনন্দ।
পরদিন কলকাতা ফেরার ফ্লাইট ধরতে ব্যাঙ্গালোর বিমানবন্দরে, ভারতীয় বন্ধু সাংবাদিকদের সান্ত্বনা-সমবেদনা পিঠের শিরদাঁড়ায় সূচ বিঁধেছিল। তারচেয়েও বেশি যন্ত্রণা নিয়ে সেই সময়টা কাটিয়েছেন মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ।
ছয় বছর পর আরেকটি ২৩ মার্চে ক্রিকেট আনন্দে ভেসেছেন তারা। সঙ্গে পুরো দল। দেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটি থেকে এই সিরিজ জয় সন্দেহাতীতভাবে এখন পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশের সর্বসেরা সাফল্য।
ক্রিকেট কখনো নিষ্ঠুর! কখনো আবার অপার আনন্দও! তারিখ সেই একই। শুধু সময় আর অভিজ্ঞতার বয়স বেড়েছে।
২০০৩ বিশ্বকাপ। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সেটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্সের নজির হয়ে আছে। কানাডা আর কেনিয়ার মতো দলের কাছে হেরে সেই বিশ্বকাপে ক্রিকেটের কানাকড়ি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ।
ক্রিকেটে দিতে গিয়েও কেড়ে নেওয়ার এমন আরো অনেক নজির আছে। তবে সেই দুঃখে কাতর হয়ে বাংলাদেশ থেমে যায়নি বলেই আজ মাঠের ক্রিকেট আমাদের হাসি-আনন্দের সুযোগও করে দিয়েছে। যে আঙ্গিনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট একসময় বাজে হারে অপমানিত হয়েছিল, সেই মাটি থেকে আজ ১৯ বছর পর ওয়ানডে সিরিজের ট্রফি নিয়ে ফিরছে দারুণ সম্মানের সঙ্গে।
কেড়ে নেওয়া কিংবা ফিরিয়ে দেওয়া। দুটোই ক্রিকেটের সমান্তরাল শক্তি। এই বিশ্বাস এবং বোধ হৃদয়ে গেঁথেই আমাদের গ্যালারিতে বসতে হবে। তাহলে দল হারলেও তারা আপনার-আমার সমর্থন হারাবে না। বাজেভাবে হারলেও আপনি-আমি গোঁয়ার যুক্তি দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলবো না, ‘নাহ্, এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না!’
সত্যিকার অর্থে একটা দলের জন্য সমর্থন তখনই বেশি প্রয়োজন যখন দলটা বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। তবে চিরকালীন সুখ হলো সবাই জয়ীর সঙ্গেই যেতে চায়, জয়ের অংশীদারই কেবল হতে চায়!
কোনোদিন দেখলাম না বাজে ভাবে হারা দলের অধিনায়ক, খেলোয়াড় বা দলকে কখনো কেউ একটা মানসিক সমর্থন জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। ফোন করেছেন। কাঁধে সমবেদনার হাত রেখে বলেছেন, 'দেখিস একদিন আমরাও..!'
অথচ জয় শেষে ক্রিকেটাররা মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে ফেরার আগেই নিউজরুমে অভিনন্দন বন্যার টেলেক্স, ই-মেইল, মেসেজের গা জোয়ারি শুরু!
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল তার ফেসবুক স্ট্যাটাসেও সেটাই লিখলেন, ‘ভবিষ্যতে আবার বাংলাদেশ হারবে। তখন যেন আমরা মনে রাখি, আজকের তুখোড় বিজয়ের স্মৃতি। মনে রাখি দুর্দান্ত দিনে কী করতে পারে বাংলাদেশ, কতটা বিস্ময়ানন্দে মোহিত করতে পারে বাংলাদেশ! ভবিষ্যতে কোনোদিন একদিন খারাপ খেলবে তামিম বা লিটন। তখন মনে রাখি যেন, কতটা ভালো খেলার ক্ষমতা আছে তাদের।’
সাকিবদের গুরু, দেশের বিখ্যাত ক্রিকেট কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিমও বাস্তবতা মনে করিয়ে দিলেন, ‘সাফল্য কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটা কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, শেখা, পড়াশোনা, উৎসর্গ এবং সর্বোপরি আপনি যা করছেন সেটাকে মনেপ্রাণে ভালবাসার অনন্য রূপ।’
ক্রিকেট সাফল্যের সঙ্গে রোলার কোস্টারের দারুণ একটা মিল আছে। নিচে থেকে উপর। আবার উপর থেকে মাঝে, নিচে পড়ে আবার উপরে। নিচে নামলেই সব শেষ। আবার উপরে উঠলেই সব পেয়ে গেলাম, এমন ক্ষুদ্রতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, হবেই।
এই চক্রই তো জীবন। ক্রিকেট তারই এক টুকরো অংশমাত্র।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিংবিডি