মতামত

বিদ্বেষের গণতন্ত্রে বিপন্ন শ্রীলঙ্কা

ছোটবেলায় শ্রীলঙ্কা দেশটার নাম শুনলে যুগপৎ দুটো অনুভূতি জন্ম নিতো। প্রথম ভয়ের, পরে বিস্ময়ের! 

একটা দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সাংঘাতিক গেরিলা দলটি সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে। এমন না সরকার খুব বড় আয়তনের। ছোট্ট দেশ। আমাদের দেশের অর্ধেক। জনসংখ্যা আরো কম, আট ভাগের এক ভাগ। এই গেরিলা দলকে সামাল দিতে সরকারকে হিমশিত খেত হয়। এরা কখনো নিজের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে, কখনো একমাত্র প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, কখনো-বা হামলা চালায় প্রধান বিমানবন্দরে। এমন একটা ত্রিশঙ্কু অবস্থায় শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছিল ঈর্ষণীয়। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি ছিল সেখানে। ১৯৯০ সালের পর থেকে একটি বছর (২০০১) বাদে প্রতিবছর মাথাপিছু আয় হুহু করে বেড়েছে শ্রীলঙ্কার। বিশেষ করে ২০০৯-এর এলটিটিই বা তামিল টাইগার গেরিলাদের শোচনীয় পরাজয়ের পর অর্থনীতির পারদ এতোটাই ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছিল, সবাই ধরে নিয়েছিল আর কিছুদিনের মধ্যে শ্রীলঙ্কা পরবর্তী সিঙ্গাপুর হিসেবে আবির্ভূত হবে। 

ভৌগোলিকভাবে  শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর অন্যতম সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন যে সমুদ্রপথ তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তার অবস্থান। সুয়েজখাল থেকে বের হয়ে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর ইন্দোনেশিয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে একবার ছুঁয়ে যেতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। জাহাজে তেল-জল সরবরাহ করেই শ্রীলঙ্কা অনেক টাকা আয় করে। অন্যান্য দেশ যখন গভীর সমুদ্রবন্দর বানাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে সেখানে কলম্বো পোর্ট প্রাকৃতিকভাবে ১৮ মিটার বার্থ ডেপথ নিয়ে সৃষ্টি। যেখানে সিঙ্গাপুরের বন্দর ১৫ মিটারের। আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও চা এই দেশটির আরো বড়ো দুটি সম্পদ। 

দেশটিতে একসময় পর্যটন খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ও চা থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার আয় হত প্রতি বছর। তবে সবচেয়ে বড়ো সম্পদটি হুট করে চোখে পড়ে না। তাদের বড়ো সম্পদ প্রায় ১০০ ভাগ শিক্ষিত জনশক্তি। মোটামুটি সবাই ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। কারণ শ্রীলঙ্কার শিক্ষাব্যবস্থা এখনো ক্যামব্রিজের ক্যারিকুলাম অনুসরণ করে চলে। এই জনশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সারাদুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমাদের দেশে শিল্প কারখানায় শ্রীলঙ্কার নাগরিক উচ্চ বেতনে কাজ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৫টি শ্রীলঙ্কান কোম্পানির ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। এই সুশিক্ষিত জনশক্তি পর্যটন বিকাশে বিশেষ সহায়ক। 

কিন্তু এতো কিছুর পরও আজ শ্রীলঙ্কার এই শ্রীহীন দশা কেন? বাজারে খাদ্য নেই। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। পেট্রোল পাম্পে জ্বালানি নেই। দিকে দিকে কেবল নেই আর নেই। পৃথিবীর বোধহয় এমন কোনো সামর্থ্যবান রাষ্ট্র নেই যার কাছে শ্রীলঙ্কা সরকার হাত পাতে নি। এমনকি বাংলাদেশের কাছে তারা হাত পেতেছে। যে বাংলাদেশ থেকে এখনো শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ ২০২১ সালে ২৫ কোটি ডলার কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কাকে দিয়েছে। সেই অর্থ পরিশোধের খবর নেই, এখন আবার টাকা চেয়ে বসেছে দেশটি। বাংলাদেশ স্রেফ ‘না’ করে দিয়েছে। 

এ সবই পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো ‘ওই সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ’-এর এই দশা হলো কী করে? উত্তর পেতে একটু পিছে তাকাতে হবে। শ্রীলঙ্কা দ্বীপরাষ্ট্র নিরঙ্কুশভাবে সিংহলিজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ব্রিটিশরা শ্রীলঙ্কায় চা চাষ শুরু করলে প্রচুর কৃষিশ্রমিক ভারত থেকে নিয়ে আসে। তারা মূলত তামিলনাড়ু থেকে আসা তামিল জনগোষ্ঠী। তারা দেড় দুইশ বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় আছে। কিছু সিংহলিজ কোনোভাবেই তাদের নাগরিক মর্যাদা দিতে রাজি নয়। বিশেষ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এদের প্রতি খুব কট্টর। এই ভিক্ষুদের হাতে নিহত হন সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা বন্দরনায়েক কুমারাতুঙ্গার পিতা ফ্রিডম পার্টির প্রতিষ্ঠা সলোমন বন্দরনায়েকে। পরবর্তীকালে আমরা দেখব এই ফ্রিডম পার্টি আর ইউনাইটেড পার্টি ঘুরে ফিরে ক্ষমতায় আসছে। মাহিন্দা রাজাপাকসের বাবা ডিএ রাজাপাকসে এই ফ্রিডম পার্টির টিকেটে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত হাম্বানটোটার এমপি ছিলেন। মাহিন্দাও ১৯৭০-এ মাত্র ২৪ বছর বয়সে এমপি হয়েছিলেন এই আসন থেকে। 

চন্দ্রিকা বন্দরনায়েকের মা শ্রীমাভো এই তামিল বিদ্বেষকে পুঁজি করে হাজার ব্যর্থতার মধ্যেও বারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়েছেন। শ্রীমাভোর ধাপ্পাবাজি ধরতে পেরে শ্রীলঙ্কার জনগণ প্রো-ইন্ডিয়ান বলে পরিচিত ইউনাইটেড পার্টিকে ১৯৭৮ সালে ক্ষমতায় আনে। লক্ষ্য করুন, এর দুবছর আগে কিন্তু তামিল টাইগার্সের জন্ম। প্রেসিডেন্ট জুনিয়াস রিচার্ড জায়েওরডেনে বহু চেষ্টা করেও তামিলদের দমন করতে না পেরে ভারতের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করেন ১৯৮৭ সালে। সে চুক্তি অনুসারে শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলে তামিল অধ্যুষিত এলাকা থেকে শ্রীলঙ্কান সৈন্যর সরিয়ে নেয়া হবে বলা হয়। আরো বলা হয়, পিস কিপিং টিম হিসেবে ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন করা হবে। তাদের কাছে তামিলরা অস্ত্র সমর্পণ করবে। কিন্তু সেই চেষ্টা ফলবান হয়নি। জুন মাস থেকে ভারত বিভিন্ন সামরিক হস্তক্ষেপ চালিয়েও তামিলদের বাগে আনতে পারেনি। উল্টো এই হস্তক্ষেপের জন্য রাজীব গান্ধীকে গুপ্তঘাতক দিয়ে হত্যা করে তামিল টাইগার্সরা। এর বছর চারেক পর নিহত হন রানাসিঙে প্রেমাদাসা। তার অপরাধ ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারা। 

১৯৯৪ সালে শ্রীমাভোর কন্যা চন্দ্রিকা বন্দরনায়েক কুমারাতুঙ্গা ক্ষমতায় বসে নরমে গরমে তামিলদের বাগে আনার চেষ্টা করেন। তিনি নিজেও একবার হামলার শিকার হন। সবাই ভারত বিরোধিতার কথা বললেও ক্ষমতায় গিয়ে ঠিকই ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করে চলে সে। কারণ এর কোন বিকল্প ছিল না। চন্দ্রিকা ৯ বছর শাসন করেন।  ২০০৫-এ মাহিন্দা রাজাপাকশে ক্ষমতায় আসেন। তিনি কিন্তু শ্রীমাভো ও চন্দ্রিকার ভারতবিরোধী দল ফ্রিডম পার্টির ব্যানারেই জিতে ক্ষমতায় আসেন। দুই বার নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় চন্দ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাহিন্দা আরো সাহস নিয়ে ভাবলেন, ভারতের দিকে চেয়ে থাকলে তামিল সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ ভারত কখনোই তামিলদের প্রতি কঠোর হতে দেবে না। তত দিনে চীন বৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনেশিয়েটিভের মাধ্যমে বিশ্বনৌপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে উঠে পড়ে লেগেছে। সমুদ্র তীরবর্তী ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলে আটকে ফেলার কৌশলে তারা নেমেছে। চীন তখন প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। মাহিন্দা ভারতকে ঠেকানোর মোক্ষম সুযোগটা লুফে নেন। ভাগ্য দেবীও সাহসী মাহিন্দার পক্ষে ছিল। মাত্র ৪ বছরের মাথায় হাজার হাজার নিরীহ তামিলকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তামিল টাইগার্সদের নিমূর্ল করতে সক্ষম হন তিনি। মাহিন্দা পান ‘লৌহমানব’ খ্যাতি। এরপর তার জয়যাত্রা রুখে কে? 

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির চাকা ঘুরতে থাকে দ্রুত বেগে। সিংহলিজরা যখন আনন্দে বিভোর, তখন মাহিন্দা তার পরিবার নিয়ে নেমে পড়েন ‘উন্নয়নের লুটপাট’-এ। যত বড় প্রজেক্ট তত বেশি কমিশন। শুধু দাতা দেশ বা রাষ্ট্র থেকে ঋণ নিয়ে তিনি ক্ষান্ত হননি, ২০০৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সার্বভৌম বন্ড ছেড়ে উচ্চ সুদে  ঋণ নেওয়া শুরু করেন। একটা কথা বলে রাখা দরকার, আমরা স্বল্পউন্নত রাষ্ট্রের তালিকা থেকে মুক্তি পেয়েছি বেশি দিন হয়নি। অথচ শ্রীলঙ্কা মুক্ত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। তাই তাদের দাতা সংস্থাগুলো থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার দুয়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।  

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় হামবানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, হামবানটোটা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, কলম্বোয় সমুদ্রবন্দরের কাছে চায়নিজ সিটি নির্মাণসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পে সহজ শর্তে ঋণ নেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে দেখা যায় এসব বন্দরে জাহাজ কিংবা উড়োজাহাজ তেমন একটা আসে না। এক্সপ্রেসে রোডে যে পরিমাণ টোল ওঠে তা দিয়ে কর্জ শোধ তো দূর, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেলে না। একসময় দেখা যায়, রেভিনিউ জেনারেট হচ্ছে না বলে ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে চীন হামবানটোটা ডিপ সি পোর্টটি ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়ে নেয়। কিন্তু অন্য প্রকল্পের তো আর এ ভাগ্য হয় না। সেসব প্রকল্পের আসল ও সুদ দুই-ই পরিশোধ করতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে।  

২০১৫ সালে নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপাকশে হেরে যান। ভারতপন্থী ইউনাইটেড দলের রনিল বিক্রমাসিংহে ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু ২৬ অক্টোবর ২০১৮, প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে মাহিন্দা রাজাপাকশেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী পদে বসান শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। এটা ভারতের জন্য এতো বড় আঘাত ছিল যে, তামিলনাড়ুর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘রাজাপাকশে শুধু তামিলবিরোধী নন, তিনি পুরো তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে।‘ 

২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল কলম্বোর তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে একযোগে বোমা হামলা হয়। বিস্ফোরণে ১৮৯ জন মৃত্যুবরণ করে। এতে শ্রীলঙ্কার মূল চালিকাশক্তি পর্যটন শিল্প একটা ধাক্কা খায়। মাহিন্দা নিষ্ঠুরভাবে চড়াও হোন শ্রীলঙ্কার ক্ষুদ্র মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপর। নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হয়। রাজাপাকশে পরিবার এবার মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ কাজে তাকে বিশেষ সাহায্য করে। মাহিন্দার সাংবিধানিক সীমাবন্ধতার কারণে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ ছিল না। ছোট ভাই গোটাবায়াকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে তিনি নিজে হন প্রধানমন্ত্রী।  

২০২০-এর মার্চ থেকে শুরু হয় বিশ্বজুড়ে অতিমারি। এতে শ্রীলঙ্কায় পর্যটক আসা বন্ধ হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কার জিডিপির সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যটন খাত যোগান দেয়। তাই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় একটি উৎস বন্ধ হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয়ের বড়ো দুটি ক্ষেত্র হলো তৈরি পোশাক আর চা। সেসবেও ভাটা নামে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণের বোঝা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানের যা জিডিপির ১০১ শতাংশে গিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের তা সাড়ে ১৩ শতাংশেরও কম। ঋণ শোধ করতে করতে রাজকোষ শূন্য হয় হয় অবস্থা। ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেওয়া চাই-এর মতো ঋণের টাকা শোধ করতে হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কা প্রতিবছর ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সার কেনে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে শ্রীলঙ্কা সরকার ঘোষণা দেয় তারা সার ও কীটনাশক আমদানী করবে না। সম্পূর্ণ অর্গানিক উপায়ে কৃষিকাজ হবে শ্রীলঙ্কায়। শুনতে যতটা ভালো লাগে বাস্তবে ততটা সুখদায়ক নয়। শ্রীলঙ্কার কৃষি অর্থনীতিবিদদের দেওয়া হিসাবে জানা যায়, কৃত্রিম সার আমদানী বন্ধ হওয়ায় ২৫ শতাংশ চালের উৎপাদন কমে গেছে। কৃষকের আয় কমেছে ৩৩ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার প্রধান খাদ্য শস্য চালের দাম বেড়ে গেছে ৩০ শতাংশ (পরে আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়)। কৃষি জিডিপিতে কৃষির অবদান ৭ শতাংশ হলেও এতে ২৭ শতাংশ জনশক্তি নিযুক্ত আছে। ফলে এতে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার সেটা বুঝতে পেরে সেনাবাহিনীকে জৈবসার উৎপাদনে লাগায়। কিন্তু ইউরিয়া ছাড়া যে কেবল জৈবসারে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব নয় সেটা যেন অনেকের জ্ঞানেই ছিল না। তড়িঘড়ি করে চায়নার Qingdao Seawin Biotech Group Co Ltd থেকে ৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে ৯৯ হাজার মেট্রিক টন জৈব স্যার আমদানি করে তারা। কিন্তু বন্দর থেকে খালাসের আগে স্যাম্পল টেস্টিং করে শ্রীলঙ্কার কৃষি গবেষকরা এই সার শ্রীলঙ্কার জীব প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর হবে বলে রায় দেয়। এ কারণে রিক্তপ্রায় শ্রীলঙ্কার ৬৩ মিলিয়ন ডলার গচ্চা যায়। 

অবশ্য নভেম্বরে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে লিথোনিয়া ও ভারত থেকে বিপুল সার আমদানি করেছে তারা। কিন্তু এখন সমস্যা অন্যখানে। সার ও ডিজেল ভর্তি জাহাজ এসে বন্দরে ভিড়ছে। কিন্তু অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় পণ্য না নামিয়েই চলে যাচ্ছে সেগুলো অন্য কোনো গন্তব্যে। সারের অভাবে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। এখন সেই খাদ্য আমদানির জন্য লাগছে বাড়তি ডলার। বৈদিশিক মুদ্রা আহরণের বড় ক্ষেত্র ছিল চা ও রাবার। সেসবেরও  উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে সার কীটনাশকের অভাবে। একটা ভুল সিদ্ধান্ত কীভাবে হাজারটা ভুলের জন্ম দেয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বর্তমানের শ্রীলঙ্কা। আর ভুলগুলো অনেক আগেই ধরা পড়ত। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ সুশিক্ষিত সিংহলিজদের অন্ধ করে রেখেছিল। খাদ্য আর জ্বালানির অভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার পর তাদের মোহ ভাঙে। কিন্তু এখন বোধহয় তেমন কিছু আর করার নেই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক