চেনা মানুষজন জানেন, আমি একটু পুরোনো ঘরানার মানুষ। পুরোনো দিনের গান শুনি, পুরোনো দিনের সিনেমায় নস্টালজিক হয়ে যাই। সারাদিন সংবাদেই থাকি। তাও সকালে ছাপা পত্রিকা না পেলে দিন শুরু হতে চায় না। ঘুম ভাঙার পর থেকেই দরজার সামনে গিয়ে ঘোরাঘুরি করি, কখন আসবে দৈনিক পত্রিকা। করোনা এসে সেই অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। সকালটা শুরু হয় ডিজিটাল ডিভাইসে ই-পেপার পড়েই। তবে অফিসে এসে প্রথম কাজ হলো পত্রিকা হাতে নেওয়া। ছুঁয়ে না দেখলে আমার পড়াটা ঠিক পূর্ণ হয় না। ই-পেপারের মতো ই-বুকেও আমার মন ভরে না। আমি ছুঁয়ে দেখতে চাই। ভার্চুয়াল নয়, আমি অ্যাকচুয়াল জগতের মানুষ। অনেকদিন ধরেই ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানারকম শঙ্কার কথা শুনে আসছি। কিন্তু আমাদের মতো পুরোনো ঘরানার মানুষ যতদিন আছে, ততদিন ছাপা পত্রিকা থাকবেই। করোনা এসে ছাপা পত্রিকার সার্কুলেশনে বড় ধাক্কা দিয়েছিল। এখন আবার পত্রিকার প্রচার সংখ্যা বাড়ছে।
ছাপা পত্রিকা যেমন দাপটের সাথেই টিকে আছে, তেমনি গণমাধ্যমের অনিবার্য গন্তব্য হয়ে এসেছে, অনলাইন নিউজ মিডিয়া। যতদিন যাবে, মানুষের অনলাইন নির্ভরতা তত বাড়বে। গণমাধ্যমের তথ্য প্রচারের যে কটি মাধ্যম তার মধ্যে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নিঃসন্দেহে অনলাইন। ছাপা পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন হয়ে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ এখন অনলাইনে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই এই প্রবণতাই এখন বাস্তবতা। সংবাদ সংগ্রহের জন্য মানুষের নির্ভরতা ক্রমশ অনলাইনমুখী হচ্ছে। সব ছাপা পত্রিকারই অনলাইন ভার্সন আছে, অধিকাংশ টিভিরও আছে। অনেক পত্রিকার সার্কুলেশনের চেয়ে অনলাইনে পাঠক বেশি। এখনই আমি এমন অনেক লোককে চিনি, যারা পত্রিকা পড়েন না, টিভি দেখেন না। কিন্তু তারা আবার পিছিয়েও থাকেন না। অন্তর্জাল জগতের নানা মাধ্যম থেকে তারা প্রয়োজনীয় নিউজের লিঙ্কটি ঠিকই খুঁজে নেন।
শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত; কানে শুনতে পেলেই যে কেউ বেতারের শ্রোতা হতে পারেন। টেলিভিশনের দর্শক হতে হলে, কানের সাথে দৃষ্টিশক্তিও থাকতে হবে। কিন্তু পত্রিকার পাঠক হতে হলে আপনাকে অন্তত বানান করে পড়ার মতো শিক্ষিত হবে। আর অনলাইনের পাঠক হতে হলে শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না, কিছুটা প্রযুক্তি শিক্ষাও থাকতে হবে। সাথে থাকতে হবে ইন্টারনেট কেনার মতো আর্থিক সক্ষমতাও। তার মানে অনলাইনের পাঠক হচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ। আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়, সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশের মাধ্যমটিতে সাংবাদিকতাও উৎকর্ষের চূড়া স্পর্শ করবে। কিন্তু ঘটনা ঘটছে উল্টো। সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর পাঠকদের মাধ্যম অনলাইনেই হচ্ছে সবচেয়ে অনগ্রসর সাংবাদিকতার চর্চা।
আপনি বাংলাদেশের কয়টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিউজ বিশ্বাস করেন? আচ্ছা প্রশ্নটা আরও সহজ করে দেই। আপনি বাংলাদেশের কয়টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের নাম জানেন? ৫টা, বড় জোর ১০টা। আমি কিন্তু ১০টার বেশি পারবো না। কিন্তু বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে কয়টি? এক হাজার, ৫ হাজার, ১০ হাজার। হা হা হা। স্কাই ইজ দ্যা লিমিট। এক সময় বলা হতো, আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। এখন বলতে হবে, আকাশের যত তারা, বাংলাদেশে তত অনলাইন। সরকার অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে বটে, তবে এখনও নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে অনেক অনলাইন।
গণমাধ্যমের কাজ হলো মানুষকে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ করা। কিন্তু সাংবাদিকতার পাশেই শুয়ে থাকে অপসাংবাদিকতা। পত্রিকায় নিউজ ছাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় অনেক পুরোনো অভিযোগ। চাঁদা না পেলে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে নিউজ ছাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগও কম নেই। সাংবাদিকতার নামে সেই চাঁদাবাজিটা করতে আগে অনেক কষ্ট করতে হতো। অন্তত পত্রিকা ছাপতে তো হতোই। অনলাইন আসার পর এখন সবকিছু জলবৎ তরলং। কারো বিরুদ্ধে যে কোনো একটা ‘ডটকম’-এ একটা নিউজ প্রকাশ করতে হবে। তারপর সেই নিউজের লিংক ফেসবুকে শেয়ার দিতে হবে, বন্ধু-বান্ধবদের দিয়ে শেয়ার দেওয়াতে হবে। আরও বেশি প্রচার চাইলে অল্প কিছু টাকা দিয়ে বুস্ট করাতে হবে। ব্যস, আপনি যাকে ঘায়েল করতে চাইছেন, তিনি শেষ হয়ে যাবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন শত শত লিংক ঘুরে বেড়ায়।
পত্রিকার সার্কুলেশন নির্ধারিত হয় বিক্রির ভিত্তিতে, পত্রিকার টিআরপি নির্ধারিত হয় দর্শক সংখ্যার ভিত্তিতে। আর অনলাইনের জনপ্রিয়তা মাপা হয় ক্লিকএর ভিত্তিতে। যত পাঠক ঐ লিংকে ক্লিক করবে অনলাইন তত হিট। এই হিটের জন্য পাগলপারা সব অনলাইন। আর ক্লিক পেতে মরিয়া অনলাইনগুলো যা করে, তার সাথে সাংবাদিকতার দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। শিরোনামের সাথে কন্টেন্টের কোনো মিল নেই। কন্টেন্ট যা থাকে তা করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নিয়ম-কানুন মানা হয় না। গোটা দশেক বাদ দিলে বাংলাদেশের অধিকাংশ অনলাইন নিউজ পোর্টালের কোনো মা-বাপ নেই। মা-বাপ নেই বলাটা বোধহয় ঠিক হলো না। আদরের সন্তানের নামের শেষে ২৪ডটকম জুড়ে দিলেই হয়ে গেল একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। মা প্রকাশক, বাবা সম্পাদক। ব্যস সাংবাদিক পরিবার। গাড়ির সামনে ‘সংবাদপত্র’ লাগিয়ে ঘুরবেন, চাঁদাবাজি করবেন, মাস্তানি করবেন। সব জায়েজ। শত শত, হাজার হাজার অনলাইনের ভিড়ে সত্যিকারের সাংবাদিকতা করা গোটা দশেক অনলাইনের মান-সম্মান নিয়ে টিকে থাকাই মুশকিল। কোনটা ভুরুঙ্গামারি২৪ডটকম, কোনটা রাইজিংবিডি, আর কোনটা বিডিনিউজ২৪ডটকম বোঝা দায়।
ইন্টারনেটের বিশাল জগতে ঘুরে বেড়ানো শত শত, হাজার হাজার লিংকের কোনটা নিউজ, কোনটা ফেক তা যাচাই করতে পাঠককে রীতিমত গোয়েন্দা হতে হয়। এসব লিংকের এমন চটকদার শিরোনাম, দেখলেই আপনার আঙ্গুল নিশপিশ করবে ক্লিক করতে। কিন্তু ক্লিক করে দেখবেন ভেতরে আসলে কিছু নেই। আর হাতে গোনা গোটা দশেক অনলাইন ছাড়া, বাংলাদেশের বাকি সব অনলাইন ক্লিকনির্ভর। তাদের চাই হিট, যে কোনো মূল্যে। আর এই হিটের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা। এখন যারা অনলাইন সাংবাদিকতা করছেন, তাদের একই সঙ্গে দুটি কাজ করতে হবে। নিজেদের আরও ভালো সাংবাদিকতা করতে হবে এবং আবর্জনার বিরুদ্ধে লড়াইটা চালাতে হবে। সরকারকেও অনলাইনকে একটা জবাবদিহিতা ও শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। অনলাইন হোক ভালো এবং আধুনিক সাংবাদিকতার প্ল্যাটফর্ম, ব্ল্যাকমেইলের নয়।
গত কয়েক বছরে অনলাইনের ধারণাটাও পাল্টে গেছে। শুরুতে নিছক লিখিত কন্টেন্ট থাকতো। এখন তাতে যুক্ত হয়েছে অডিও ভিজ্যুয়াল। অনলাইন গণমাধ্যম মানে একের ভেতরে তিন- পত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশন। এখন অধিকাংশ পত্রিকার অনলাইন ভার্সন আছে। প্রায় সব টিভিরও অনলাইন ভার্সন আছে। সব মিলে অনলাইনে এখন দারুণ প্রতিযোগিতা। আর প্রতিযোগিতায় দুটি ঘটনা ঘটতে পারে- যেন তেনভাবে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অথবা ভালোর প্রতিযোগিতা, আরও উৎকর্ষের দিকে যাওয়ার চেষ্টা। আশা রইলো, আরও ভালো করার প্রতিযোগিতাই বাংলাদেশের অনলাইন গণমাধ্যমকে সামনে এগিয়ে নেবে। আর সেই প্রতিযোগিতায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে রাইজিংবিডি। ২৫ এপ্রিল, ২০২২
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ