সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদ এলেই আমরা একটা প্রবণতা দেখতে পাই। আমরা এক-দু'জন রিপোর্টারকে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে পাঠাই সন্তান-সন্ততি থেকে দূরে আমাদের এমন সিনিয়র নাগরিকদের ঈদ কেমন কাটছে সেটা দেখার জন্য। এতে দোষের কিছু নেই। এটা বরং এসব নাগরিকের প্রতি আমাদের দায়িত্বকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
কিন্তু আমি ভাবছি আমরা, মানে মিডিয়া, আমাদের রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে এসব নাগরিকের প্রতি সবসময় ন্যায়বিচার করতে পারছি কি-না। কোনো সন্দেহ নেই বৃদ্ধাশ্রমের জীবন নিরানন্দ, একঘেঁয়ে ও যন্ত্রণাকাতর। জীবনের শেষ সময়টুকু সবাই ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় কাটাতে চায়। কিন্তু সবার সেই সৌভাগ্য হয় না। কারো কারো ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে, যদিও আমাদের দেশে এই সংখ্যা খুবই কম।
আমাদের প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে আমরা মাঝেমধ্যেই বৃদ্ধাশ্রমের জীবন সম্পর্কে একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করি। প্রতিবেদনগুলো এমন একটা ধারণা দেয় যে, কিছু মানুষের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে কারণ তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেনি। এই মানুষগুলোকে ব্যর্থ মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এটা হয়তো আংশিক সত্য। তবে অন্য কারণও আছে। একটা রিপোর্টেই দেখলাম এক নিঃসন্তান নারী স্বামী মারা যাওয়ার পর স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমের জীবন বেছে নিয়েছেন। কিছু মানুষকে জানি যারা বিদেশে বসবাস করেন কিন্তু তাদের যান্ত্রিক জীবনে বাবা-মাকে নিয়ে যেতে চান না। তারা মনে করেন বিদেশের চেয়ে সমবয়সীদের মাঝে দেশেই কোনো বৃদ্ধাশ্রমে তারা ভালো থাকবেন।
ছেলে-মেয়েদের অযথা সবসময় খলনায়ক না-বানিয়ে আমাদের তাদের বক্তব্যও শোনা উচিত। এটা আমাদের জানতে সাহায্য করবে ঠিক কোন পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদের বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন। এ ধরনের প্রেক্ষাপটকে এড়িয়ে যেতে এটা অন্যদের সাহায্য করতে পারে। মুদ্রার দুই পাশ না-দেখে আমরা যদি কেবল আবেগের ফেরিওয়ালা হয়ে যাই এটা একটা সমস্যাই বটে। এতে করে জেনে অথবা না-জেনে গুরুতর একটা সমস্যাকে আমরা আরো খারাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
লন্ডনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা হেল্প এজ ইন্টারন্যাশনালের দেওয়া তথ্যমতে ২০৫০ সালে বাংলাদেশে ষাটের উপরে জনসংখ্য দাঁড়াবে ৩ কোটি ৬০ লাখ, যা বর্তমান ১ কোটি ৩০ লাখের প্রায় তিনগুণ।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২। এটা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। অনুমান করা যায়, সেক্ষেত্রে বয়োবৃদ্ধ লোকের সংখ্যাও বাড়তেই থাকবে। অনেক নবীন পরিবারেই, বিশেষত শহরাঞ্চলে এখন সন্তানের সংখ্যা এক বা দুই, যা তাদের পূর্বপুরুষের তুলনায় ব্যতিক্রম। ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বিশ বছর বা তারও কিছুও সময় পরে এসব পরিবারের অনেকেরই ঠাঁই হবে বৃদ্ধাশ্রমে। এখন যদি আমরা বৃদ্ধাশ্রমের জীবনকে ক্রমাগত হেয় করে যাই, ছেলে-মেয়েদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে প্রয়োজন সত্তেও অনেকে সেখানে যাবেন না এবং নীরবে কষ্ট সয়ে যাবেন।
লেখক: ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজ’-এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক