মতামত

কণ্টকাকীর্ণ পথে চলেছেন, হাল ছাড়েননি কখনও

জননেত্রী শেখ হাসিনা কি উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসেছেন? সন্দেহ নেই, মহত্তম উত্তরাধিকার তিনি বহন করে চলেছেন। সর্বদা তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার কন্যা’ এর চেয়ে বড় পরিচয় আর কিছুই হতে পারে না।

১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সম্মেলনে তাকে সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়, যখন তিনি দিল্লিতে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন। এ পদে অভিষিক্ত করার সময় ‘জাতির পিতার কন্যা’ এটিই প্রধান বিবেচনায় ছিল। কিন্তু এ পদ ছিল চ্যালেঞ্জের, এ পদ ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ফিরিয়ে আনার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চারনেতার নিষ্ঠুর হত্যা, শত শত নেতা-কর্মীর কারাগারে দুঃসহ জীবন, বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নিরবচ্ছিন্ন কুৎসা ও মিথ্যাচার- এমন প্রতিকূল পরিবেশে দলকে পুনর্গঠিত করার কাজ হাতে নিতে হয়েছে তাকে। তিনি প্রতিটি চ্যালেঞ্জ জয় করেছেন। এ কারণে ধারণা হতেই পারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, অসম্ভব জনপ্রিয় ক্যারিশমেটিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তের উত্তরাধিকার বহন করার কারণেই তিনি এমনটি পেরেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দেশকে স্বল্প আয়ের কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়ে মধ্য আয়ের দেশের সিঁড়িতে তুলেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় নিজের স্থান করে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে, জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতাদের পাশে, মর্যাদার আসনে।

বাস্তবতা কী ছিল? বঙ্গবন্ধু কৈশোর থেকেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোহরাওয়ার্দী সাহেব বাংলা প্রদেশের খাদ্যমন্ত্রী, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী। ওই সময়ে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীসহ একটি প্রভাবশালী মহল ব্লাকমার্কেটিংয়ে যুক্ত হয়ে পড়েন। রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু অর্থের পেছনে ছোটেননি। দুর্ভিক্ষের সুযোগে অবৈধ সম্পদে নিজের পকেট ভারি নয়, বরং মাসের পর মাস কাটিয়েছেন লঙ্গরখানা পরিচালনায়। বিহারের প্রত্যন্ত জনপদে এ কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তানে এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকেন ১৫০ মোগলটুলীর মেসে, কোনোমতে চলার অর্থ আসে স্ত্রী ও পিতার কাছ থেকে। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রথম কন্যা শেখ হাসিনার জন্ম এ সময়েই- ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর।

পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে, চলে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বর্বর সামরিক জান্তার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ পর্যন্ত। এই ২৪ বছরের অর্ধেকের বেশি সময় বঙ্গবন্ধুর কেটেছে কারাগারে। প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম ফজিলতুননেছা মুজিব রেণু এবং পাঁচটি সন্তান এ কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন উচ্চাবাচ্য না করে, যাকে বলা যায় টুঁ শব্দটিও তারা করেননি। 

বঙ্গবন্ধুর ওপর সর্বক্ষণ নজরদারি ছিল গোয়েন্দাদের। তাদের পর্যবেক্ষণ কী বলছে? ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরুর চার মাসের মধ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ, যা ভাষা আন্দোলনসহ পরবর্তী সময়ের প্রতিটি আন্দোলন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সময় তিনি কারাগারে, কিন্তু সবাই বুঝে যায় তিনিই প্রাণপুরুষ। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই ফের সক্রিয়। কিন্তু ১৯৫০ সালের প্রথম দিন থেকে ফের কারাগারে, যা স্থায়ী হয় ১৯৫২ সালের সফল ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত। কারাগারে বসেই তিনি দিকনিদের্শনা দিয়েছেন আন্দোলনের, নিজে অনশন করেছেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তিলাভের পর স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান এবং বয়স্ক পিতামাতাকে টুঙ্গিপাড়া রেখে তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়; দায়িত্বপালন শুরু হয় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। পরের বছর নির্বাচিত হন সাধারণ সম্পাদক। গোটা বাংলাদেশ চষে বেড়াতে থাকেন সংগঠন গড়ে তোলা ও জনগণকে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সচেতন করার মহান লক্ষ্য সামনে রেখে। 

বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু যে জীবন বেছে নিয়েছিলেন, তাতে কষ্ট-যন্ত্রণার অন্ত ছিল না। কিন্তু স্ত্রী ও সন্তানেরা এ নিয়ে গর্ব করেছেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। সামরিক শাসনামলে জেল গেটে স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ৩০ অক্টোবর। পরের সাক্ষাতের তারিখ ছিল ২০ নভেম্বর। বেগম ফজিলাতুননেছা এবং শেখ হাসিনা, শেখ কামাল ও জামালের সঙ্গে রেহানা। এই প্রথমবারের মতো কারাগার দর্শন ঘটে শিশু রেহানার- আবেদনে বয়স লেখা ২ বছর। শেখ হাসিনার বয়স লেখা ১০ বছর ১১ মাস (আনুমানিক)। পরের সাক্ষাৎ ছিল ২৮ নভেম্বর। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বেগম মুজিব তাঁর স্বামীকে সাক্ষাতের সময় বলেন, সিদ্ধেশ্বরী এলাকার কোয়ার্টারে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়। এলাকাটি ঝোঁপ-জঙ্গলে ভরা। পানির কষ্ট। তিনি দালালদের মাধ্যমে নতুন একটি বাড়ি ভাড়া নিতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সকলে বলছে- শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দিলে বিপদ হবে। শেখ মুজিব স্ত্রীকে বলেন, উপযুক্ত বাড়ি না পেলে ছেলেমেয়েদের ফাইনাল পরীক্ষার পর যেন টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাড়ি চলে যায়। 

অথচ সে সময় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিছুদিন আগেও ছিলেন প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, দলের কাজে বেশি সময় দেওয়ার জন্য যে পদ তিনি অবলীলায় ছেড়ে দেন। কিছুদিনের মধ্যেই যিনি পাকিস্তানের লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের দুঃশাসনের চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত হচ্ছেন, তার পরিবারের মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই!

এমন কঠিন পরিবেশেই কিন্তু শেখ হাসিনার বেড়ে ওঠা। ১৯৬৬ সালে ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েট শাখার ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন, বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসে যেদিন এ দায়িত্ব ছাড়েন, সেদিন তাঁর বিয়ের পাকা কথা চলছে। বিনাবিচারে আটক বঙ্গবন্ধুকে তখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় ফাঁসানোর সব আয়োজন চূড়ান্ত। প্রহসনের বিচারে ফাঁসির দণ্ড হবে, তেমনই রটনা নানা দিকে। এই কঠিন সময়েই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’- যাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ইতিহাস ফুটিয়ে তুলেছেন অনন্য দক্ষতায়, সাহিত্য মানেও যা অতুলন। স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত ঐতিহাসিক ৬-দফা প্রদানের কারণে বাঙালির মুখ্য কণ্ঠ তিনি। শাসকচক্র বলছে- এ কর্মসূচি ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার দলিল এবং এই অপরাধে শেখ মুজিবের ক্ষমা নেই। এমন হুমকির মুখে কেমন ধীর-স্থিরভাবে তিনি লিখে গেছেন দিনলিপি ও রাজনৈতিক জীবনের প্রথম অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মাথা একেবারে ঠান্ডা!

হ্যাঁ, পিতার এ গুণটিই পেয়েছেন পরিবারের প্রথম সন্তান শেখ হাসিনা। তার বিয়েতে কোনো সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা নেই। ‘আত্মীয়-স্বজন ভয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় আসে না। বর ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার প্রধান যোগ্যতা পরমাণু বিজ্ঞানী, অর্থ-বিত্ত নেই। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘স্ত্রীকে তুলে আনার ‘অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমার পক্ষ থেকে কাপড়-চোপড় ছাড়া আর কোন অলঙ্কার দেয়া সম্ভব হয়নি। ঐ অনুষ্ঠানে কোন আলোকসজ্জারও ব্যবস্থা করা হয়নি। শেখ সাহেবের আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে কিছু অলঙ্কার ও সামান্য উপহার দেয়া হয়েছিল।... ইত্তেফাক পত্রিকায় খবর পরিবেশিত হয়: শেখ মুজিবের জেষ্ঠ্যা তনয়ার বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় নিরানন্দ ও আলোকসজ্জাহীন পরিবেশে শিরোনাম দিয়ে।’ [পৃষ্ঠা ৩৬]

শেখ হাসিনা এই সাধারণ জীবন মেনে নিয়েছিলেন। তবে এই সাধারণ জীবনেই ধীরস্থিরভাবে যে কাজটি করেছিলেন সেটা হচ্ছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কিংবা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি পিতার সঙ্গে পরিবারিক দেখাসাক্ষাতের সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের জন্য পরামর্শ-উপদেশ নিয়ে আসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে উচ্চ শিক্ষার জন্য কেবল পা রাখা, সদ্য বিবাহিত শেখ হাসিনা ডাকসুর ভিপি এবং ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন, এমন অনেক ঘটনার উল্লেখ আমরা পাই ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার গ্রন্থে।

সে সময়ে পরিবারের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল? কলরেডি মাইক সার্ভিসের মালিক দয়াল ঘোষ ও হরিপদ ঘোষ আমাকে বলেছেন, আগরতলা মামলা ও সংসার খরচ চালানোর জন্য বেগম মুজিব তাদের কাছে নিজের স্বর্ণের চুড়ি পাঠিয়েছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফাকে দিয়ে। বন্ধক রেখে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ জানিয়ে। দলের একজন শুভানুধ্যায়ী বেগম মুজিবকে বলেছিলেন- শেখ কামাল কলেজের পাঠ চুকিয়ে আদমজী জুটমিলে চাকরি নিতে চাইলে সে ব্যবস্থা করা যাবে। এতে অন্তত সংসারটা বাঁচবে।

করুণা প্রদর্শনের আরও একটি উদাহরণ দিয়েছেন ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া- ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কৌসুলী বিত্তবান এডভোকেট সালাম খান শেখ হাসিনার বিয়েতে ১০ টাকার ১০টি নোট উপহার দিয়েছিলেন।’ 

বঙ্গবন্ধুর পরিবার এই দুঃসময়ে মাথা নত করেনি। বাঙালির স্বার্থের সঙ্গে বেঈমানি করেনি। অন্যায় ও অসত্যের সঙ্গে আপস করেনি। ষাটের দশকের শেষ দিকে শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। মিছিল-সমাবেশে সামনের সারিতে। কিন্তু সংগঠনের কোনো নেতৃত্বের পদে তারা নেই। ঊনসত্তরের মহান গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বন্দি পিতা যখন মুক্ত হয়ে এলেন, বাঙালি যখন তাকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে বরণ করে নিলো, আওয়ামী লীগের পতাকাতলে যখন আপামর জনতা ঐক্যবদ্ধ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্বাচনে যখন ছাত্রলীগের জয়জয়কার, তখনও শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল সংগঠনের সাধারণ কর্মীদের সারিতে। কোনো অনুষ্ঠানে বক্তার তালিকায় নেই তারা, কর্তৃত্বের ভূমিকায়ও নেই। 

কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন সশস্ত্র রূপ গ্রহণ করল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, বেগম মুজিব সদ্য জননী হওয়ার গৌরবে ধন্য, কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে ঢাকায় কঠোর সামরিক প্রহরায় অন্তরীণ- দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল তখন রণাঙ্গনে, মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে অসম সাহসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি। বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়ে দেশের পুনর্গঠন কাজে নিবেদিত, কিন্তু শেখ হাসিনার ব্যস্ততা পড়াশোনা ও সংসার নিয়ে, কামাল-জামাল-রেহানা-রাসেল নিজ নিজ শ্রেণিকক্ষে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে তারা অনেকটা গাদাগাদি করে বসবাস করেন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে অহমিকাবোধ ও উন্নাসিকতা যেন জন্ম না নেয়, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সে জন্য বেগম মুজিব কোনোভাবেই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বাসবভন শেরে বাংলা নগরের গণভবনে যেতে রাজী হলেন না।

এই সুশৃঙ্খল ও কঠিন কিন্তু একইসঙ্গে সাধারণ জীবনযাপনই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী চরম প্রতিকূল সময়ে অকূতোভয়ে দলের নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি যখন আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন, তখন দেশে চলছে জিয়াউর রহমানের নিষ্ঠুর সামরিক স্বৈরশাসন। শত শত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী কারাগারে। আওয়ামী লীগ প্রকৃতই বিশৃঙ্খল, বিশাল কর্মী বাহিনী গভীর হতাশায় নিমজ্জিত এবং কার্যকর নেতৃত্ববিহীন। খুনী মোশতাকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন যে সব নেতা, তাদের একটি অংশ অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে দলে ফিরলেও কর্মীদের আস্থায় ছিলেন না। ষাটের দশকে আওয়ামী লীগে বড় ভরসা ছিল ছাত্রলীগ। স্বাধীনতার পর জাসদ চটকদার ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের স্লোগান তুলে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ফেলে দেয় গৌরবের এ সংগঠনের একটি অংশকে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছিল তখন ফের আঘাত আসে বাকশাল ও জাতীয় ছাত্রলীগ গঠন করে দলকে হীনবল করে ফেলা হয়।

১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বামী ও দুই শিশু সন্তান এবং প্রিয় বোন শেখ রেহানাকে প্রবাসে রেখে যখন ঢাকায় পা রাখেন, তখন শেখ হাসিনার ফের আশ্রয়হীন জীবন। ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি সরকারের দখলে। আজ এ বাড়ি, কাল ও বাড়ি এভাবেই কাটছে জীবন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ‘ভাঙা স্যুটকেস’ দেখিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বিশাল বাড়ি, গুলশানের বাড়ি ও অঢেল সম্পদের বরাদ্দ নেন বেগম খালেদা জিয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা তখন মিলাদ পড়াতেও পিতার রেখে যাওয়া বাসভবনে প্রবেশের অনুমতি পান না। একইসঙ্গে শেখ হাসিনার মাথায় ঝুলছে মৃত্যুপরোয়ানা- বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা বারবার বিষাক্ত ছোবল হানতে চেয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার-কুৎসা চলছিল। জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ ও খালেদা জিয়া- তিনজনের শাসনামলেই তা চলছিল বিরামহীন। মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তরের চেতনা, স্বনির্ভর-সমৃদ্ধ দেশ- এ সব মহত্তম ধারণা শিকেয় তুলে দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখান থেকেই আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দলে ও অঙ্গ সংগঠনগুলোতে রয়েছে অগণিত নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, যারা বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত- এটা তিনি জানতেন। তিনি তাদের কাছে ছুটে যান, তারাও দলে দলে অকূতোভয়ে আসতে থাকে প্রিয় সভানেত্রীর কাছে। শাসকদের রক্তচক্ষুকে তারা উপেক্ষা করেছে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তিনি ১৫ দল গঠন করেন। পাশাপাশি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করে গড়ে তোলায়। 

একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা মনোযোগী থেকেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার রূপকল্প রচনায়। কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বিশ্বের বুকে গর্বের বাংলাদেশ- সব কিছু বিবেচনায়। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও জেল হত্যার বিচার হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধপরাধীদের বিচার ও দন্ড কার্যকর হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মিথ্যাচার রুখে দিয়ে প্রমত্তা পদ্মায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতু মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আজ যে আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে নেতৃত্ব প্রদানের অবস্থায় চলে এসেছে, তার ভিত কিন্তু এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল এবং তা সযতনে, নিরলস শ্রম ও সাধনায়, অসম সাহসে করেছিলেন জননেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। অমসৃণ, কণ্টকাকীর্ণ পথে তিনি হেঁটেছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন। কিন্তু পিতার মতোই হাল ছাড়েননি। পথ হারাননি। জাতির সুসময়ে আমরা যেন ঝড়ের খেয়া এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কঠিন সংকল্পের সময়টি বিস্মৃত না হই। 

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য