মতামত

নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে বিদ্রোহী নজরুল 

পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন নজরুল। তিনি মূলত চেয়েছিলেন স্বাধীনতা। স্বরাজ নয়। বলেছেন, ‘স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেন না ও কথাটার মানে এক-এক মহারথী এক-এক রকম করে থাকেন, ভারতবর্ষের এক-পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার-সব থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোন বিদেশিদের মোড়লীর অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।’ 

স্বাধীনতা প্রাপ্তির যে কোনো সক্রিয় পথের শরিক হতে নজরুল পা বাড়িয়েছেন সব সময়। সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যাবার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বয়স যখন তার ১৮, তখন তিনি প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক। স্বপ্ন তখন তাকে হয়তো আলোড়িত করেছে, দেশ ও জাতির মুক্তি। সে পথ সশস্ত্র হতে পারে। কারণ যখন তিনি  সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, দেশ জুড়ে তখন স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার। সশস্ত্র সংগঠনও গড়ে উঠেছে বাংলায়। আবার এই নজরুলই গান্ধীবাদকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদকেও করেছেন অভিনন্দিত। আবার যখন গণজাগরণের সাম্যবাদ এসেছে, তিনিও হয়েছেন নান্দীপাঠক। 

সবাইকে সমান অধিকারে স্বাধীন মানব হিসেবে দেখার উদগ্র  বাসনা এবং তাদের সঙ্গে গলাগলি হয়েই সেই স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তিনি। নজরুলের কাজে প্রাপ্তিই ছিল পরম চাওয়া। পথ বা পদ্ধতি নিয়ে টানাপোড়েন তেমন দেখা দেয়নি। যে পথেই হোক স্বাধীনতা চাই। এই একগুঁয়ে মনোভাব ছিল তীব্র। তাই গান্ধীর ডাকে চরকাও ঘুরিয়েছেন। কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন। জগতের লাঞ্ছিত  নিপীড়িত মানুষের উত্থানের গান গেয়েছেন। 

বাংলা সাহিত্যে নজরুলই প্রথম কবি, যিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন, নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার সপক্ষে জোরালো জনমত গঠনে। আর এতেও ছিল তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক কর্মী এবং সাংবাদিক নজরুলের চেয়ে সৃজনশীল সৃষ্টিশীল কবি হিসেবে ছিলেন আরো উঁচু স্তরের। কিন্তু রাজনীতি ও সাংবাদিকতা- এ দুটো মাধ্যমই ছিল তার ঔপনিবেশিকতার বিপরীতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠন এবং সাম্যবাদী ধারায় দেশ পরিচালনার স্বপ্ন। যুগের হাওয়ায় নজরুল  ইসলাম নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। একাই নিজের বাণী বহন করেছেন। নিজস্ব চিন্তা, চেতনা, ভাবনাকে সামনে এগিয়ে নিতে একাই লড়েছেন, অদম্য সাহসে। 

১৯১৯ সালে মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে বাঙালি সেনাদের প্রয়োজন ফুরায়। ১৯২০ সালে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেয়া হয়। সৈনিকদের বিভিন্ন পদে চাকরি দেয়া হয়। কিন্তু চাকরি পেয়েও নজরুলের আর যোগ দেয়া হয়নি। কলকাতায় বন্ধু মুজফফর আহমদের সাহচর্য তাকে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার সপক্ষে সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক করে তুলে। দেশমাতৃকার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে তীব্র। দু’জনেই রাজনীতি করার ব্রত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, সংবাদপত্র প্রকাশের। এবং তা সান্ধ্য দৈনিক। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের অর্থায়নে নজরুল ও মুজফফর আহমদের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই ‘নবযুগ’ বাজারে এলো। প্রথম সংখ্যা থেকেই তা পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাংবাদিকতার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা নজরুল তখন একুশ বছর বয়সী। নিজের সহজাত তীক্ষ্ণ মেধা, কাব্যরুচি, রাজনৈতিক বোধ এবং প্রখর কান্ড ও নীতিজ্ঞান তাকে সাংবাদিক হিসেবে  সামনে আসার পথ তৈরি করে দেয়। দৈনিক পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা না থাকা এই দু’জনে তখন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। নজরুল বড় বড় প্রতিবেদনগুলো সম্পাদনা শুধু নয়, সংক্ষিপ্তাকারে নিজের ভাষায় লিখতেন। পত্রিকায় শিরোনাম দিতেন বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়েও।

‘নবযুগ’ পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ নজরুলের রচনা। স্বাধীনতার পক্ষে তার কলম তখন জোরালো। তার লেখার জন্যই ব্রিটিশ সরকার ‘নবযুগ’ প্রকাশক ফজলুল হককে সতর্ক করে দিয়েছিল বার তিনেক। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই যাদের লক্ষ্য, তারা থেমে থাকবে কেন? নজরুলের একটি জ্বালাময়ী  প্রবন্ধের কারণে সরকার পত্রিকার জামানত এক হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করেছিল। নতুন করে অনুমতি পেতে ২ হাজার টাকা জমা দিয়ে আবার ‘নবযুগ’ প্রকাশ করা হলেও তারা তা বেশিদিন চালান নি। সাত মাস পর ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে তারা নিজেরাই পত্রিকা ছেড়ে দেন। অবশ্য পরে নতুন মালিকানায় ‘নবযুগ’ প্রকাশ হলে নজরুল তাতে যোগ দিয়েও বেশিদিন থাকেন নি নীতিগত কারণে। নজরুল ততোদিনে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। 

১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্বলিত ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় ‘যুগবাণী’ নামক প্রবন্ধগ্রন্থ। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় সাত মাসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ও অন্যান্য নিবন্ধগুলো থেকে বাছাই করে ২১টি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশ করেন ‘যুগবাণী’ সংকলন গ্রন্থ। নজরুল কবি হিসেবে পরিচিতির পাশাপাশি সাংবাদিক ও কলাম লেখক হিসেবে আবির্ভূত হবার সাথে সাথে পাঠক হৃদয় জয় করেছিলেন। তার ক্ষুরধার কলম সাহস করে সেইসব কথাই বলেছে, যা নিপীড়িত, লাঞ্চিত, পরাধীন মানুষের অন্তরের কথা। তিনি তাদের মধ্যে জাগরণের মন্ত্র তুলে দিয়েছেন। যে সব লেখার কারণে ‘নবযুগ’ রাজরোষে পড়েছিল, সে সব লেখার সংকলন প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যে তা সরকার নিষিদ্ধ করে। বিস্ময়কর যে, এই নিষেধাজ্ঞা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বহাল ছিল। নজরুলের প্রথম গদ্যগ্রন্থটিই  শুধু বাজেয়াপ্ত হয়নি, তার আরো দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থও পরে বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৬) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়। এটিও দেশভাগের পর মুক্ত হয়। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত অপর প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘দুর্দিনের যাত্রী’ রও একই ভাগ্য ঘটে। 

নজরুলের গ্রন্থ সংখ্যা ৫৩ টি। এর মধ্যে প্রবন্ধ গ্রন্থ তিনটি ছাড়াও বাজেয়াপ্ত হয় চারটি কাব্যগ্রন্থ, ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪), ‘ভাঙ্গার গান,’ ‘প্রলয়শিখা’ (১৯৩০) ‘চন্দ্রবিন্দু’ (১৯৩০)। প্রথম দু’টি প্রকাশের সাথে সাথে এবং পরের দুটি একছর পর ১৯৩১ সালে বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই গ্রন্থগুলোর  একটিও নজরুলের অসুস্থতা পূর্ব সময়ে আর প্রকাশিত হয়নি। নজরুলের আরো কয়েকটি গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে তা করা না হলেও সেগুলোর  বিক্রয় ও প্রচারে পুলিশী  বাধা অক্ষুণ্ন ছিল।

‘যুগবাণী’ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘নবযুগ’। যা ছিল পত্রিকার নাম। লিখেছেন নজরুল, “আজ নারায়ণ মানব। তাহার হাতে স্বাধীনতার বাঁশি। সে বাঁশির সুরে সুরে নিখিল মানবের অনুপরমাণু ক্ষিপ্ত হইয়া সাড়া দিয়াছে। আজ রক্ত প্রভাতে দাঁড়াইয়া মানব নব প্রভাত ধরিয়াছে- ‘পোহাল পোহাল বিভাবরী, পূর্ব তোরণে শুনি বাঁশরি, এ সুর  নবযুগের। সেই সর্বনাশা বাঁশির সুর রুশিয়া, আয়ার্ল্যান্ড শুনিয়াছে, তুর্ক শুনিয়াছে এবং সেই সঙ্গে শুনিয়াছে আমাদের হিন্দুস্থান। জর্জরিত, নিপীড়িত, শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষ।” নজরুলের লক্ষ্য কী ছিল তা এই লেখায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নজরুলের প্রথম গ্রন্থটি বেরিয়েছিল ১৯২২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে, গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ কে বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু করা হলো কবির প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ। প্রকাশের ২৮ দিনের মাথায় ২৩ নভেম্বর। 

অসহযোগ আন্দোলনে দেশ তখন তুঙ্গে। বৃটিশ উপনিবেশ বিরোধী মনোভাব তীব্রতর। শাসক গোষ্ঠী নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। সেই সাথে নেতাদের গ্রেফতার। আর তাদের ১৭৯৯ সালের ১৩ মে চালু করা ‘প্রেস রেগুলেশন এ্যাক্ট’ বলবৎ করে।  রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অশ্লীলতার অভিযোগ এনে বহু বই-পুস্তক, নাটক, কবিতা, গান, লিফলেট, সাময়িকীপত্র, এমনকি গ্রামোফোন রেকর্ডও বাজেয়াপ্ত করা হয়। বঙ্কিম, দীনবন্ধু, মুকুন্দ দাস, গিরীশচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের ধারায় কবি নজরুলের গ্রন্থও বাজেয়াপ্ত হয়।  তবে তার গ্রন্থই সর্বাধিক বাজেয়াপ্ত হয়। ৭টি পুরোপুরি আর ৫টির প্রচার ও বিক্রয়ে অলিখিত বাধা প্রদান করা হয়। পুলিশ নিষিদ্ধ না থাকা সত্বেও তল্লাশি চালিয়ে  বই আটক করতো। 

নজরুলের জানা ছিল, বৈপ্লবিক আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামে অপরিসীম প্রভাব সৃষ্টির অভিযোগে বৃটিশরা এদেশে ধর্মগ্রন্থ ‘ভগবদগীতা’ ও ‘চন্ডী’ চূড়ান্ত  নিষেধ না করেই তল্লাশি চালিয়ে জব্দ করেছে। পূর্ববঙ্গ এমনকি আসামপ্রদেশ থেকেও নজরুলের বই  তল্লশি করে জব্দ করা হয়েছে। ইংরেজ শাসক প্রথমে বাজেয়াপ্ত করে নজরুল সম্পাদিত ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা। এই পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামে কবিতা প্রকাশের জন্য। এরপর বাজেয়াপ্ত করে ‘যুগবাণী’ গ্রন্থটি। গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। এর প্রকাশক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রন্থকার। নেপথ্যে যদিও পেশাদার প্রকাশনা সংস্থা ছিল। গ্রন্থটি যে  ঔপনিবেশিক সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে এমন ধারণা প্রবন্ধগুলো যখন ‘নবযুগ’-এ প্রকাশ হয় তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  

নিজের গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত  হবার পর তা বিক্রি হলেও নজরুল রয়্যালিটি পেতেন না। ‘মুখবন্ধ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে  নজরুল বাঙালির প্রাণের আর্তিকে তুলে ধরেছিলেন। যখন নেতারা সাহস করে সত্য উচ্চারণ নয়, শাসকের তল্পিবাহক বা মোসাহেবীতে লিপ্ত, নজরুল সেখানে সাহস করে গণজাগরণের পথনির্দেশনা দিলেন। ইংরেজি রাজত্বে ইংরেজের বিরুদ্ধে এভাবে সরাসরি  ক্ষোভ, বিষোদগার প্রকাশের সাহস নজরুলই দেখিয়েছিলেন। 

কেবল লেখার মধ্য দিয়ে নজরুল দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেননি, জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গেও তার ছিল প্রত্যক্ষ যোগ। বিপ্লবীদের সঙ্গে ছিল তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর দেশে দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈপ্লবিক আন্দোলন মাথাচাড়া দেয়, তার পেছনে তার লেখনীর প্রেরণা অনস্বীকার্য। একদিকে রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও অপরদিকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা সমকালীন আর কোনো কবির মধ্যে মেলেনি। এই তৎপরতাই নজরুলকে ব্রিটিশ শাসকের চোখে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে মূল্যায়িত করেছে। তাই তার কণ্ঠরোধ করার জন্য শাসকরা বারবার তৎপর হয়েছে। কারাগারে আটকাবস্থায় ‘স্লো পয়জন’ দিয়েও নিরস্ত করা যায়নি। শাসক চেয়েছিলেন কারাগারে অনশনে কবির মৃত্যু ঘটুক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথসহ দেশবাসী চায়নি বলেই নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করতে হয়েছিল। এটা আজকের সময় এসে বলা যায়, একজন লেখক-সাংবাদিক হিসাবে সমসাময়িককালে নজরুল ইসলামের রচনাই সবচেয়ে বেশি শাস্তিপ্রাপ্ত। নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে তাকে বন্দির হাজারো প্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু নজরুল কোনোভাবেই দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। অকুতোভয় সাহস তাকে যে কোনো বিপদকে মোকাবিলার শক্তি দিয়েছিল বুঝি।

লেখক: মহাপরিচালক, পিআইবি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক