এক দশক আগে ২০১২ সালের ১ জুলাই লিখেছিলাম: ‘পদ্মা সেতু: বরিশালে থেকেই প্রতিদিন ঢাকায় অফিস’। তখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে সরে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের ভেতরেই একটি মহল এমন প্রচার শুরু করে, যাতে জনমনে ধারণা সৃষ্টি হয়- সম্ভবত দুর্নীতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতই বলতে থাকেন- বিশ্বব্যাংক কোনো অর্থ ছাড় করেনি, দুর্নীতিও হয়নি, কিন্তু সেটা যেন চাপা পড়ে যেতে থাকে।
এক দশক পর সেতুটি নির্মিত হয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগও মিথ্যা-ভিত্তিহীন গালগল্প হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এ অবস্থায় যথার্থভাবে বলা হয়েছে: ‘Gap of South Bridged’. প্রকৃতই কেবল দক্ষিণাঞ্চল নয়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হিসেবে পরিচিত খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর অর্থনীতির জন্য এ প্রকল্প সৃষ্টি করবে সম্ভাবনা- যা অশেষ। বরিশাল অঞ্চল সাধারণ শিক্ষায় বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল থেকে এগিয়ে। পদ্মা চালু হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের যে অপরিমেয় চাহিদা সৃষ্টি হবে, তার সঙ্গে মানবসম্পদ জোগানের সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে হবে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে এ কাজ তারা করতে পারে।
নদনদীর অঞ্চল হচ্ছে বরিশাল। নদনদী সেচের পানি জোগায়। মাছের বড় উৎপাদন স্থল এসব জলাধার। আমাদের পরিবেশ রক্ষায় মিঠা পানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্প ব্যয়ে মানুষ ও পণ্য পরিবহনেও নদনদীর অবদান বিপুল। পদ্মা সেতু চালু হলে নদনদী নিয়মিত ড্রেজিং করার কাজ যেন বন্ধ না হয়ে যায়, বিষয়টির প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ আকর্ষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা। পদ্মা পারের অনেক কৃষককে বলতে শুনেছি- সেতু চালু হওয়ার পর নদনদীর প্রবাহ ও গভীরতা যথাযথ পর্যায়ে রাখার জন্য পরিকল্পনা রাখতেই হবে। সেতু চালু হলে নদীপথের রক্ষাণাবেক্ষণ, ড্রেজিং যেন গুরুত্ব না হারায়। প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে পরিচিত বরিশালের একদল বিদ্যালয় শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা- বরিশাল শহরের বুক চিরে চলুক জাহাজ। কিন্তু এ জন্য তো খাল-নদীতে চাই স্রোত। পদ্মা সেতু চালুর পর সড়কপথ গুরুত্ব পাবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু নদনদী যে বাংলাদেশের প্রাণ!
বাংলাদেশে সড়ক পথ, রেলপথ, বিমান বন্দর- এ সব নির্মাণ ব্যয়বহুল। নদনদী প্রকৃতির দান। রাষ্ট্রের দায়িত্ব কেবল এ সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ। কিন্তু এ জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ কি আছে? বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন বিমান বন্দর ব্যবহারে যাত্রীদের টিকিট কাটতে হয় না। তাহলে যে কোনো লঞ্চ ঘাট ব্যবহারে যাত্রীদের কেন টিকিট কাটতে হয়? দক্ষিণাঞ্চলের প্রতি কেন এ বৈষম্য?
পদ্মা সেতু রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দূরত্ব কমিয়ে দেবে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার। বন্দরের দূরত্ব আরও বেশি। পদ্মা সেতু পথে ঢাকা থেকে মংলা বন্দরের দূরত্ব এর চেয়ে কম। সেতু পথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব কমবে ১০০ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি। ঢাকা-মাওয়া সড়ক পথ নতুর রূপ পেয়েছে। যারা এ পথে নিয়মিত চলাচল করছেন তাদের কাছে এ পথ যেন ইউরোপ-আমেরিকার মহাসড়ক। এ পথ ব্যবহার করে বরিশাল, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলার বাসিন্দারা প্রতিদিন নিজের বাড়িতে থেকেই ঢাকায় অফিস করতে পারবেন। রেলপথ চালু হলে বরিশাল, খুলনা বা যশোর থেকে দেড়-দু’ঘণ্টাতেই ঢাকা যাওয়া-আসা করা যাবে। অনেকে ভাবছেন- প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করা যাবে বরিশাল-ফরিদপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে। এর ফলে রাজধানীর ওপর মানুষের চাপ কমবে।
কিন্তু বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে কিছু সড়ক পথে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত বিশ্বমানের চার লেনের সড়ক তৈরি হয়েছে। ভাঙ্গা থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠিতে এমন মানের সড়ক নির্মাণের অগ্রগতি কত দূর? এ অঞ্চলের রাজনীতিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তা, সমাজকর্মী, গণমাধ্যম- এ সব এখন তাদের নিত্যদিনের এজেন্ডা। সেতু চালু হলে প্রতিদিন ২৫ হাজারের মতো গাড়ি চলবে। ফলে চাপ বাড়বে সড়কের ওপর। ঢাকা থেকে এক ঘণ্টাতেই গাড়ি চলে যাবে ভাঙ্গার মোড়। তারপর গাড়ি প্রবেশ করবে দুই লেনের ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-বরগুনা সড়কে। এ সব সড়ক চার লেনে পরিণত করার কাজ যখন চলবে তখন কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে? কেউ কেউ তো মনে করেন আগামী দু’তিনটি বছর নরক-যন্ত্রণা সইতে হতে পারে কয়েকটি জেলায় যাতায়াতকারীদের।
প্রশ্ন উঠছে- ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখীল-বরগুনার রেল পথের খবর কী? কত বছরে চালু হবে এ পথ? আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও কি বিদ্যালয়ের এমসিকিউ-এর মতো সম্মুখীন হতে হবে এমন প্রশ্নের- কোন জেলায় রেল পথ নেই?
পদ্মা সেতু চালু হলে মংলা বন্দর ও পায়রা বন্দর চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের তুলনায় অনেক কাছে হবে। এমনকি রাজধানী ঢাকার অনেক ব্যবসায়ীও আমদানি-রফতানির জন্য চট্টগ্রামের পরিবর্তে মংলা বন্দর ব্যবহারে উৎসাহী হবেন। রেল ও সড়ক পথে বেনাপোল স্থলবন্দর, সাতক্ষীরার স্থলবন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সড়ক ও রেল পথের কাজ জরুরি ভিত্তিতে শুরু করা।
পদ্মা সেতুর কারণে খুলনার শিল্পাঞ্চল জেগে উঠবে। কিন্তু বরিশাল বিভাগে তো শিল্প-কারখানাই নেই। এ অঞ্চলের উদ্যোক্তা-প্রশাসন-জনপ্রতিনিধি-রাজনীতিকসহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে কি তাদের নিত্যদিনের এজেন্ডায় পরিণত করবেন? পদ্মা সেতু পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। কেউ চাইলে ঢাকা বা আশপাশের এলাকা থেকে এক দিনেই কুয়াকাটা কিংবা কুড়িয়ানার পেয়ারাবাগান-নদীর হাট-গুঠিয়া মসজিদ-বিজয় গুপ্তের মনসা মন্দির এলাকা ঘুরে যেতে পারবেন।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক চক্রান্ত করেছে। বাংলাদেশের এক শ্রেণির লোকও তাতে সায় দিয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়েছেন, বিশ্ববাসী জেনেছে বাঙালিকে দাবায়ে রাখা যায় না। যখন বিশ্বব্যাংক একের পর এক অন্যায় করেছে, সেতু নির্মাণে শিশুর রক্ত চাই বলে গুজব রটিয়েছে একটি মহল- তার কি সময়োপযোগী জবাব আমরা দিতে পেরেছি?
২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হবে। এ সেতু জাতীয় মর্যাদার প্রতীক। বর্তমান সরকারের কাছে এ প্রকল্প ছিল বড় চ্যালেঞ্জের। তারা মনে করছে এ প্রকল্প চালু হলে দলের প্রতি জনসমর্থন বাড়বে। কিন্তু সেতু চালুর পর যদি বরিশাল অঞ্চলে বাড়তি গাড়ির চাপে এক ঘণ্টার পথ অতিক্রম করতে তিন-চার ঘণ্টা লেগে যায়? যারা সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করেছে তারা এ সব ইস্যু করবে সন্দেহ নেই। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর ঢাকা-টাঙ্গাইল চারলেন করার কাজ চলছে। সেখানে সৃষ্ট যানজটের তিক্ত অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্টদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে?
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি বিশেষভাবে সমুদ্র সম্পদ, নদনদী, কৃষি ও মৎস্য সম্পদ নিয়ে গবেষণা কর্মসূচি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ জন্য নতুন বিভাগ চালুর কথা ভাবা যেতেই পারে।
বরিশাল অঞ্চল কৃষি প্রধান ছিল। পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে। শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার জন্য সৃষ্টি হবে অনুকূল পরিবেশ। অনেকের কাছে ঢাকা বা আশপাশের চেয়ে বরিশাল-পটুয়াখালী অঞ্চলে কারখানা স্থাপন লাভজনক মনে হবে। চট্টগ্রাম নয়, তাদের পছন্দের বন্দর হবে মংলা বন্দর। বেনাপোল স্থল বন্দরের গুরুত্বও বেড়ে যাবে। সেতুর কারণে শিল্প হবে, সড়ক-হাসপাতাল-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-হাউজিং প্রকল্প গ্রহণে এগিয়ে আসবেন উদ্যোক্তারা। পর্যটন সুবিধার প্রসার ঘটবে। এ সব কারণে কমে যাবে চাষাবাদের জমি। ফলে কৃষি উৎপদন কমে যেতে পারে। পরিবেশের ওপর পড়তে পারে বিরূপ প্রভাব। সংশ্লিষ্টরা এ সব বিবেচনায় রাখছেন নিশ্চয়ই।
সব কিছু ছাপিয়ে উঠবে সম্ভাবনার চিত্র। পদ্মা সেতু নির্মাণ যে কোনো মানদণ্ডেই মহৎ কর্মযজ্ঞ। তবে এটা হচ্ছে আরও অনেক বড় লক্ষ্য- দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদের উন্নয়নের পথে চলার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নিশ্চিতভাবেই আমরা এ ধারায় দেখতে থাকব একের পর এক দূরদর্শী, সৃষ্টিশীল ও সংকল্পবদ্ধ পদক্ষেপ।
লেখক: প্রাবন্ধিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
আরও পড়ুন :
* পদ্মাকাহন: আমাদের স্বপ্ন সেতু
*ষড়যন্ত্রের মেঘ সরিয়ে উঠলো সত্যের সূর্য