মতামত

একটি সেতুর গল্প

১. পত্রিকায় বিশাল শিরোনাম হয়েছিল— ‘পদ্মা সেতু হচ্ছে না।’ পদ্মার বুকে এই সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংকসহ চারটি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অর্থায়ন সহযোগিতার জন্য ঋণচুক্তি করেছিল। কারা ছিল সেই সংস্থা। বিশ্বব্যাংকের কথা তো জানা হলো। বাকি তিন সংস্থা ছিল— এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)। 

২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চুক্তি করে। কিন্তু এই চুক্তি স্বাক্ষরের ছয় মাসের মধ্যেই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি স্থগিত করলো। এবং ২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল হলো। 

বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ানোয় বাকি তিন সংস্থা— এডিবি, জাইকা এবং আইডিবিও সেই পথেই হাঁটলো। তারাও সরে গেল। কিন্তু থামলো না বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেবে। দেশি-বিদেশি অনেক অর্থনীতিবিদ এই প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয় বলেও মত দিলেন। তবুও স্বপ্ন দেখল বাংলাদেশ। জেদ দেখালো, জেতার জেদ। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই জেদ, দৃঢ়তা, ঐকান্তিকতা, ইচ্ছাশক্তি ছিল বলেই পদ্মা সেতু আজ বাস্তব। সেই একই পত্রিকায় এখন নতুন এক শিরোনাম— ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আজ’!

এই সেতুর প্রতিটি বস্তুকণাজুড়ে যে লেখা, ‘জেদ জেতার গল্প!’

২.  পদ্মা সেতু এক সময় ছিল মানুষের কল্পনার মাঝে। কিন্তু নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে এখন বাস্তব। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের এক চোখ ধাঁধানো স্বপ্নের নাম পদ্মা সেতু। দুই স্তর বিশিষ্ট সেতুটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার অনন্য প্রতীক। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের পরিবহন, অর্থনীতি, শিক্ষা এবং চিকিৎসাসহ সকল ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, তার অন্যতম সাক্ষী এই সেতু। এ সেতু নির্মিত হওয়ায় মানুষের সময় বাঁচবে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং মানুষ অধিক কর্মমুখী হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি ও প্রসারের নিয়ামক হবে পদ্মা সেতু। কুয়াকাটা সৈকতে আনন্দ ভ্রমণ কিংবা সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে আশায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পায়রা বন্দর থেকে খালাস হওয়া পণ্য এখন আরও কম সময় ও সহজেই ঢাকায় পৌঁছাবে। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় শিল্প কল-কারখানা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক ও জীবন ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়নের পথ রচিত হবে। এতদ অঞ্চলের অর্থনীতির উন্নয়ন এবং পিছিয়ে থাকা মানুষের জীবনমান বদলে দেবে পদ্মা সেতু। 

এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি-সক্ষমতা ও গর্বের গল্প। 

৩. নিউ ইয়র্কে বেড়াতে গিয়ে সাধারণত স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে দাঁড়িয়ে কেউ ছবি তোলার সুযোগ হারাতে চান না। মালয়েশিয়ায় এসে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের সামনে কে না ছবি তুলতে চাইবেন? প্যারিসে গেছেন কিন্তু আইফেল টাওয়ার পেছনে রেখে ছবি তুললেন না, তাহলে তো আপনার ফ্রান্স সফরের আনন্দ পুরো হলো না! প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লিতে গিয়ে ইন্ডিয়া গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেরেননি এমন মানুষ খুবই কম। ইংল্যান্ডের টাওয়ার ব্রিজ ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ছবি তোলা যেন পর্যটকের জন্য নিয়মমাফিক একটা রুটিন। কারণ আর কিছু নয়, স্ট্রাকচারগুলো এসব দেশের আইকন। আইকনিক স্ট্যাচু।

গর্বের পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের অন্যতম আইকনিক স্ট্রাকচারের একটি। উদ্বোধনের আগে থেকে এই সেতুর আশপাশে দাঁড়িয়েই ছবি তোলার ধুম পড়ে গেছে।

গঠনশৈলী, স্থাপত্য কৌশল, নির্মাণ যজ্ঞ, আকৃতি— তীব্র স্রোত ও পানিপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে সুগঠিত এবং শক্তিশালী কাঠামোর ভিত তৈরি এসব পরিকাঠামো পদ্মা সেতুকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা ও আইকনিক সৌন্দর্য। ৬.১৫ কিলোমিটারজুড়ে রাতের আলোয় পদ্মা সেতুর সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেবে। বিশ্বের ২০টি দেশের সেতু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও মেধার প্রয়োগ রয়েছে এই সেতুর নির্মাণ কাজে। মূল সেতু, নদীশাসন এবং সংযোগ সড়কে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে— সেগুলোর টুকরো অংশ নিদর্শন হিসেবে সেতুর মিউজিয়ামে থাকবে। 

এই সেতু বাংলাদেশের আইকনিক স্থাপত্যশৈলীর আনন্দময় গল্প। 

৪.  আহরার হোসেন। বিবিসি বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক। ২৩ জুন সকালে নিজের ফেসবুকে পদ্মা সেতুর আলো ঝলমলে একটা ছবি দিলেন, ক্যাপশনে লেখা— ‘বাড়ি যাওয়ার পথ।’ আহরারের মতো এমন অপার আনন্দে ভাসছেন দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার কোটি কোটি মানুষ। 

পদ্মা সেতু এই অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র বদলে দিচ্ছে। ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকার সেই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলছে। নদীর খরস্রোত ও পলিমাটিতে বিযুক্ত পদ্মার দুই তীরকে এক করে সেতু তৈরির কাজ মোটেও সহজ কিছু ছিল না। এখন মাত্র কয়েক মিনিটে এই সেতু পার হওয়া গেলেও; এর পেছনের কঠিন পরিশ্রম, সৎ-সাহসী সিদ্ধান্তের গল্প আজীবন বাংলাদেশের ইতিহাসের অনুষঙ্গ হয়ে থাকবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও ভোগান্তিপূর্ণ জটিল যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপরীতে উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বাক্ষর পদ্মা সেতু।

বিদ্যুৎ বিভাগের উপ-পরিচালক শামীম হাসান দারুণ খুশি। শরীয়তপুরের কবিরাজকান্দিতে বেয়াই বাড়ি যেতে এবার আর ফেরিঘাটের ঝক্কি পোহাতে হবে না। সেতু উদ্বোধনের এক দিন আগে শামীম ফেসবুকে সেই স্বস্তিই জানালেন: ‘মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পদ্মার ওই পাড়ে। তাই আমার কাছে এই সেতু শুধু সেতু নয়, এ যেন সামাজিক সম্প্রীতির ও পারস্পরিক সম্পর্কের মেলবন্ধনের দৃষ্টিনন্দন এক স্মারকও। সামনে আবারও যাবো মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। তবে এবার আর ফেরি নয়, সরাসরি পদ্মা সেতু দিয়ে। সাঁই সাঁই করে!’ 

এই সেতু যোগাযোগ উন্নয়নে সক্ষমতা ও স্বস্তির গল্প। বাংলাদেশের আবেগ-আনন্দ, আত্মমর্যাদা, সম্মান ও মাথা তুলে দাঁড়ানোর গল্প। 

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিংবিডি