মতামত

রক্তের আল্পনায় আঁকা আগস্টের মহাট্র্যাজেডি

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মহান স্থপতি। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের মহানায়ক। তাঁর নির্ভীক নেতৃত্ব ও বিশ্ববিজয়ী ব্যক্তিত্বের কথা আজ বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হলেও একদল সুবিধাবাদী, দেশদ্রোহী ঘাতক, দেশি-বিদেশি চক্রান্তে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেই থেকে মধ্য আগস্টের এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকের দল মূলত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল পাকিস্তানি-সামরিক আমলাতান্ত্রিক ও মৌলবাদী ভাবধারায় বাংলাদেশকে পরিচালনা করতে। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে’ ঘাতকের দল ‘ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ পরিণত করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ বলে স্বীকৃতিপত্রও পাঠিয়েছিল। তাদের সেই চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয় বাংলার লড়াকু মানুষ। বঙ্গবন্ধু এমনভাবে এদেশের নিপীড়িত মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরেও এ দেশের মানুষের মন থেকে তাঁর অমর নাম মুছে ফেলতে পারেনি ধিকৃত হন্তারকরা। 

সোনা যত আগুনে পোড়ে তত খাঁটি হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শও দিনে দিনে উজ্জ্বল হয়ে, দশদিকে আশার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। সে চোখ ধাঁধানো আলোয় ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন হত্যা করতে পারেনি নিষ্ঠুর ঘাতকের দল। ব্যক্তির চেয়ে ব্যক্তি প্রবর্তিত আদর্শ ও দর্শন অনেক বেশি শক্তিশালী হয় ইতিহাস সেটা বারবার প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশের মানুষও উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে আস্থা রেখে। 

আজকের আধুনিক ও উন্নয়নমুখী বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সদম্ভে এগিয়ে যাচ্ছে বটে, তবে এর পেছনে রয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘকালের লালিত স্বপ্ন ও তাঁর অভিনব রাজনৈতিক দর্শন। আমি বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। পেয়েছি তাঁর আদর ও আলিঙ্গন। বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী স্পর্শ এখনও আমি অনুভব করি আমার সত্তাজুড়ে। তাঁকে যত দেখেছি তত তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলি ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখে অভিভূত হয়েছি। সত্যিকার অর্থেই তিনি বাঙালি জাতির অকৃত্রিম দোসর ছিলেন। বাংলাদেশবিরোধী চক্র বুঝেছিল শেখ মুজিবকে নিশ্চিহ্ন করতে না পারলে বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। তাই তারা রাতের আঁধারে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। 

তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকে যারা বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, সেই জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে বন্দি অবস্থায় ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ জেলের ভেতর হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করার জন্যই ১৫ আগস্টের পরে আওয়ামী লীগের উপর দমন-পীড়নের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।

যে বঙ্গবন্ধু পরাধীন বাংলাকে স্বাধীনতা এনে দেন, তাঁর নামও উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃকর্মীদের তথা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসীদের গ্রেফতারের ফলে কারাগারগুলো ভরে যায়। এমন পরিস্থিতিতে অনেকের মতো আমিও দেশ ছাড়তে বাধ্য হই। স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যাই পড়শি রাষ্ট্র ভারতে। কলকাতার মাটিতে বসে দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলি। ১৯৭৬ সালে দিল্লিতে ও লন্ডনে বঙ্গবন্ধু-স্মরণে যে দুটি শোকসভা হয়, তার নেপথ্যে যেকজন মানুষ অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। 

১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পরে জার্মানিতে বসবাসরত বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার জীবনও হুমকির মুখে পড়ে। সে সময় জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কত গোপনীয়তা রক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জীবন বাঁচাতে ভারতে পাঠিয়েছিলেন, তা আজ অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। সেদিন দিল্লির পান্ডারা রোডের বাড়িতে শেখ হাসিনাদের অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় থাকতে হতো। শেখ হাসিনার সেই দুঃসময়ে যেকজন মানুষ শেখ হাসিনার পান্ডারা রোডের বাসায় যাতায়াত করতে পারতেন তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। সে সময় তাদের করুণ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমি স্বচক্ষে দেখেছি।

১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন নয়, বাংলাদেশকে হত্যা করার চক্রান্তের দিনও বটে। ১৫ আগস্টের পর রাতারাতি বদলে যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দৃশ্যপট। চেনা মানুষেরা অচেনা হয়ে যায়, নেতা হয়ে যায় সাধারণ জনতা, সাধারণ জনতা হয়ে যায় ছদ্মবেশী নেতা। কালো আঁধার এসে পুরো বাংলাদেশকে গ্রাস করে। শুরু হয় ঘাতকদের উল্লাস। সেই উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নামে এমন সব মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে যাতে বাংলার মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এর পেছনে দীর্ঘদিনের চক্রান্ত তো ছিলই, আরো ছিল বিশাল টাকার বিনিয়োগ।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় মার্কিন দূতাবাসের অস্থিরতা দেখেই বোঝা যায় সে রাতে তারা কে কোথায় ছিল, কার কী ভূমিকা ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য ’৭০-এর দশকে আমেরিকা গণতন্ত্রপন্থী নেতাদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। সেসময় অনেক বরেণ্য নেতা হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনাও মার্কিনি ষড়যন্ত্রের অংশ। মার্কিনিরা শেখ মুজিবের সামনে বাংলার মানুষকে শোষণ করতে পারবে না বলেই তড়িঘড়ি করে তাঁকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশকে দীর্ঘ একুশ বছর অকার্যকর, বিশৃঙ্খল, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ভারতে প্রায় চার বছর স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকার পর আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি ১৯৭৯ সালে। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে ১৫ আগস্ট উদযাপন করি এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে খালি পায়ে পদযাত্রা করি। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন একটি মাইলফলক ঘটনা। এরপর ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সংগঠিত হয়ে আবার বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা বেগবান করেন।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হলেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ একুশ বছর তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকে এবং নানা ধরনের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়। দীর্ঘ একুশ বছর অবিরাম লড়াই-সংগ্রাম করে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে আবার বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্বের সব দেশ, সব মানুষ যখন বাংলাদেশের উন্নতি দেখে বিস্মিত এমন পরিস্থিতি আবার সেই পুরাতন ষড়যন্ত্রকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। ইতোমধ্যে ১৯ বার তাকে হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল সবচেয়ে নির্মম হত্যা প্রচেষ্টা। ২১ আগস্ট ২৪ জন নেতাকর্মী ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান, আহত হন শতশত নেতাকর্মী। জননেত্রী শেখ হাসিনাও সেই গ্রেনেড হামলার পরে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।

বঙ্গবন্ধু একটা কথা বারবার বলতেন- ‘যে মরতে প্রস্তুত, তাকে কেউ মারতে পারে না।’ হয়তো তাকে শারীরিকভাবে মেলে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু ইতিহাস থেকে তাঁর নাম কেউ মুছতে পারে না। আজ জননেত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলছেন- তাকেও হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে। এ কথায় আমি মোটেই আশ্চর্য ইই না, তাকে হত্যা করা হতেই পারে। কেননা শেখ হাসিনাই আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক। বাংলাদেশের আপামর মানুষ তাঁর নেতৃত্বে স্বস্তিবোধ করছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে শেখ হাসিনার অবদান অনস্বীকার্য। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশকে আজ তিনি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় সব সূচকেই বাংলাদেশ বেশ শক্ত অবস্থানে আছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ একদিন উন্নত দেশে পরিণত হবে। 

কিন্তু এটা অনেকের কাছেই ভালো লাগছে না। বিশেষ করে যারা দেশদ্রোহী ঘাতক, তারা আবার একটি আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চায়। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা কিছুতেই যেন সেই সুযোগ না পায় এই জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হবে, দেশবাসীকেও অতন্ত্র প্রহরী হয়ে জেগে থাকতে হবে। বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আজ দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’ 

‘শোষিতের গণতন্ত্রের’ প্রবর্তক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের দিকেই আজ পৃথিবীর মানুষ ধাবিত হচ্ছে। আজ মানুষ একটি মানবিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রত্যাশা করছে। বঙ্গবন্ধু মানবিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই সংগ্রাম করেছিলেন এবং এই কারণেই তাকে ঘাতকের বুলেটে প্রাণদান করতে হয়।  

বঙ্গবন্ধুকে তার মিত্ররা বারবার সাবধান করেছিলেন কিন্তু তিনি তাতে সতর্ক হননি। আশা করি জননেত্রী শেখ হাসিনা তেমন কোনো ভুল করবেন না। কেননা আবার যদি এদেশে আগস্ট ট্র্যাজেডির মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে বাংলাদেশের সমস্ত অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। এদেশের মুক্তিকামী মানুষ বিপন্ন হবে, উল্লাসিত হবে মৌলবাদীরা। ঘাতকেরা আবার ক্ষমতায় বসবে দেশপ্রেমিকদের বিতাড়িত করে। শক্ত হাতে দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্রকারীদের দমন করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নেতেৃত্ব দেবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। জাতীয় শোক দিবসে শাহাদাৎবরণকারী সকল শহীদের প্রতি রইল বিনম্র্র শ্রদ্ধা।    

০৬ আগস্ট, ২০২২ লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ