গল্পটা খুব সরল। এক দেশে ছিল এক তরুণ। নাম তার মুজিব। খুব ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে যায় রেণুর সঙ্গে। কিশোর মুজিব, রেণু তখনো শিশু। দুজনের ফুলশয্যা হয় আরও পরে। মুজিব অন্যায় দেখে চুপ থাকতে পারেন না। সকলের দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হন। মিছিলের আগে থাকেন। শ্লোগানে উচ্চকিত মুজিবের কণ্ঠস্বর। কম বয়সে হাজতবাসের অভিজ্ঞতাও হয়ে গেছে।
কী দরকার সবার ঝামেলা একার কাঁধে নেওয়ার? দেশের সরকার অন্যায় করছে, শোষণ করছে সাধারণ মানুষকে, তা নিয়ে কথা বলে বিপদে পড়তে হবে কেনো রেণুর স্বামী মুজিবকে? দিনরাত স্বামীর পথ চেয়ে থাকা একলা রেণু টের পান, দিনকে দিন একলা হয়ে পড়তে হচ্ছে তাকে। কী করবেন তিনি? কঠোর হবেন? স্বামীকে বলে দেবেন- স্রেফ সংসার করতে চান তিনি? স্বামী-সন্তান নিয়ে ছিমছাম সংসার, ঠিক আর দশটা বাঙালি গৃহবধুর মতো সংসার কেনো হবে না তার?
তিনি বলেন না। স্বামীকে উৎসাহ দেন। পাড়া-প্রতিবেশীরা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাকে রাশ টেনে ধরতে কি বলেনি? কেউ কি বলেনি, বউ! স্বামীকে সামলাও। পুলিশ লেগেছে পেছনে। এভাবে চললে ছেলেপুলে মানুষ করবে কী করে? কে তোমাদের দেখবে? বিপদে-আপদে যে স্বামী গৃহকর্তা হিসেবে সংসারের সবাইকে আগলে রাখে, সে নিজেই অনুপস্থিত! কে তোমাদের আগলে রাখবে? কে দেখবে ভালো-মন্দ? বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন বটে, তবে এ বয়সে তারাই বা এত ভার সইবেন কেনো?
তিনি বলেননি। স্বামীকে কখনো রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার বা কেবলমাত্র সংসার করার কথা তিনি কখনোই বলেননি। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক চাপ কম সইতে হয়নি মুজিব পরিবারকে। প্রতিবাদী মুজিব রাজনীতিতে যত সক্রিয় হয়েছেন, তত বেশি অসম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন সংসারের সঙ্গে ব্যস্ততার কারণে। আর যখন জেলে বন্দী থাকতেন, তখন তো তিনি একেবারেই অনুপস্থিত। মুজিবের সংসার হয়নি। সংসারটি হয়েছে কেবল রেণুর সংসার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’
রেণুর প্রথম সন্তান জন্মের পরপরই চিরতরে হারিয়ে যায়। স্বামী কাছে ছিলেন না। এরপর ১৭ বছর বয়সে রেণু একটি মেয়ের জন্ম দিলেন। মেয়ের দাদা শেখ লুৎফর রহমান নাম দিলেন শেখ হাসিনা। তখনো মেয়ের বাবা কাছে ছিলেন না। কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ঠেকাতে ব্যস্ত তিনি। রেণুর যেন তাতেই সুখ। অন্য নতুন মায়ের মতো তিনি অনুযোগ করেননি স্বামী কাছে নেই বলে। চির নির্ভরতা তাঁর ভেতর, স্বামী দেশের কাজে ব্যস্ত আছেন, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই তাঁর। বাবাকে কাছে না পাওয়া ছেলে শেখ কামাল হাসিনা অর্থাৎ হাসু আপার বাবা যে তারও বাবা, তা বুঝতে পারে না। সবচেয়ে ছোট ছেলে শেখ রাসেল বাবাকে কাছে না পেয়ে মাকে ‘আব্বা’ ডেকে শান্ত হয়।
রেণুর দুই কন্যা ও তিন পুত্র নিয়ে ভরা সংসার, স্বামীকে ছাড়াই সামলাতে হয় একা তাকে। জীবনের এই যুদ্ধে তিনি এক অক্লান্ত সৈনিক। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে বলে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে একটি স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলার কাজ শুরু করলেন, তাও একার সিদ্ধান্তে। রাজমিস্ত্রীদের সঙ্গে থেকে কাজ দেখেছেন, ইটে পানি দিয়েছেন নিজের হাতে। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বাবা-মায়ের শাসন সম্বন্ধে বলেছেন, ‘হয়তো কখনো কখনো বাবা-মায়ের হাতে মারও খেতাম। কিন্তু মায়ের আদর, মায়ের স্নেহ, মায়ের ভালোবাসার প্রাপ্তি অনেক বেশি।’(৫ই আগস্ট ১৯৯৯ সালে বিটিভিতে প্রচারিত বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার একটি সাক্ষাৎকার। এ বাড়ি শুধু আমাদের নয়, বাংলার জনগণের স্মৃতিবিজড়িত, মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার ৮৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে প্রকাশিত স্মরণিকা ২০১৩, পৃ.৩০)
ছোট মেয়ে শেখ রেহানা মাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘আমার মা ছিলেন এমনই একজন আদর্শ নারী, যাঁর মধ্যে আমরা মায়ের ভালোবাসার স্বাদ, দেশপ্রেম, সাহস ও শুদ্ধতার সম্পর্ক দেখেছি। জ্ঞান হবার পর দেখে এসেছি আমার বাবা কারাবন্দি। মা তাঁর মামলার জন্য উকিলদের সঙ্গে কথা বলছেন, রাজবন্দি স্বামীর জন্য রান্না করে নিয়ে যাচ্ছেন, গ্রামের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়স্বজনের খবরাখবর রাখছেন। মা আমাদের ভাইবোনদের সব আবদার মেটাতেন। লেখাপড়া, অসুস্থতা, আনন্দ-বেদনা সব কিছুর প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। এত কিছুর পরও তাঁর নিজের জন্য সময় খুঁজে নিয়ে তিনি নামাজ পড়েছেন, গল্পের বই পড়েছেন। আমাদের সঙ্গে গল্প করেছেন। কী ভীষণ দায়ভার বহন করেছেন। আমার মা ছিলেন পরিবারের প্রাণ। একজন আদর্শময়ী অভিভাবক।’(শেখ রেহানা, একজন আদর্শ মায়ের প্রতিকৃতি, মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার ৮৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে প্রকাশিত স্মরণিকা ২০১৩, পৃ. ২৩)
গ্রামের মিশনারী স্কুলে ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়া অতি সাধারণ রেণু স্বামী অন্তপ্রাণ বলেই কি স্বামীর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন সময়ের সাথে সাথে? বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবির সাফল্য এসেছে যে দৃঢ় ধনুকভাঙ্গা প্রতিবাদের মাধ্যমে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেই প্রত্যয় ধরে রাখতে, নেতা মুজিবকে অটল থাকতে কী পরিমাণ সহযোগিতা করেছেন বেগম মুজিব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুকে একনিষ্ঠ লড়াইয়ে থাকার সাহস জুগিয়ে রেণু হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতির কাছে বঙ্গমাতা।
সাধারণ বাঙালি মায়ের শ্বাশত চরিত্রের বঙ্গমাতা ঘটনার ধারাবাহিকতায় অনন্য সাধারণ চারিত্রিক দৃঢ়তা লাভ করেছিলেন। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য স্বামীর জীবনভর যুদ্ধ তিনি দেখেছেন, স্বাধীনতা লাভ করার পর সেই দেশের মানুষ গুজব আর অপপ্রচারে কতটা নির্মমতা দেখিয়েছিল, তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন বঙ্গমাতা। তিনি কষ্ট পেতেন নিশ্চয়ই। সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে কথায় কথায় বঙ্গমাতা দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘দেখ ভাই, আমাদের এখন এত বড় একটা দুঃসময়, এমন সময়ও শত্রুরা আমাদের শত্রুতা করতে ছাড়ছে না। প্রচার চালাচ্ছে, কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে গুলি খেয়েছে। এ কথা যদি সত্য হতো, তাহলে আমি মা হয়েও ওর প্রাণ বাঁচানোর জন্য আল্লার কাছে আকুতি মিনতি করতাম না। হাসপাতালে পড়ে থাকতাম না। ওকে মরতে দিতাম।’ (আবদুল গাফফার চৌধুরী, ৮ই আগস্ট শোকের মাসে অ-শোক একটি দিন, বঙ্গমাতার ৮৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গমাতা স্বপ্ন জয়ের সারথি, স্মরণিকা ২০১৮, পৃ. ২২-২৫)
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কালরাতে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য হতাকাণ্ড ঘটেছিল ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে, রেণুর সংসারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণশক্তি যার গভীরতর ছিল, সেই বঙ্গমাতা কি কিছুই টের পাননি? বুঝতে পারেননি গভীর অন্ধকার নেমে আসছে বঙ্গবন্ধু তথা বাংলাদেশের ভাগ্যে?
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সদস্য বদরুন্নেসা আহমেদ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে বঙ্গমাতা কফিন ছুঁয়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আপা, আপনি তো অনেক সম্মান নিয়ে চলে গেলেন, এখন আমাদের কী হবে?’ বদরুন্নেসা আহমেদের কন্যা, পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ড. নাসরীন আহমেদ এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন তাঁর ‘খুব সাধারণ ছিলেন তিনি’ নিবন্ধে। তিনি আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে তিনি ও বঙ্গমাতা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। দেখলেন, নিচের রাস্তায় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য ঘোরাফেরা করছে। বঙ্গমাতা নাসরীন আহমেদকে বলেছিলেন, ‘দেখ, আজকে যারা আমাদের পাহারা দিচ্ছে, একদিন তারাই আমাদের দিকে গুলি তাক করবে।’
যুদ্ধক্ষেত্রে কখনো ভয় না পাওয়া যোদ্ধা বঙ্গমাতা বিপর্যয়ের আশঙ্কা ঠিকই করেছিলেন। শেখ হাসিনা স্বামীর কাছে সন্তানদের ও ছোট বেন শেখ রেহানাকে নিয়ে জার্মানি গেলেন। বিদায়ের সময় মা নাকি অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন। এর আগে কত বারই না বিদেশ গেছেন শেখ হাসিনা। মাকে এভাবে কাঁদতে দেখেননি। মায়ের মন কি বুঝতে পেরেছিল, এই বিদায় ছিল শেষ বিদায়? বুঝতে পেরেছিলেন যে, আর দেখা হবে না?
বঙ্গমাতার বড় বোনের মেয়ে ফরিদা শেখও স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘১৩ই আগস্ট বঙ্গমাতার সঙ্গে শেষ দেখা হয়। বাসায় গিয়ে দেখেছিলেন বঙ্গমাতা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন। তিনি বঙ্গমাতার কাছে জানতে চান, ‘খালাম্মা, আপনার কি শরীর খারাপ?’ তাঁর জিজ্ঞাসায় বঙ্গমাতা জানিয়েছিলেন, ‘না রে, চারদিক কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। তাই নেয়ামুল কোরআন পড়ছিলাম।’ ফরিদা শেখ মনে করেন, পুরো পরিস্থিতিটাই যেন তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন।’(নাছিমা বেগম, রেণু থেকে বঙ্গমাতা, পৃ. ৬১) জীবন অঙ্কের শেষ দৃশ্যটা কেমন ছিল যোদ্ধা রেণুর? শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, ‘যখন আমার আব্বাকে গুলি করলো, আমার মা কিন্তু জীবন ভিক্ষা চায়নি। মা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, উনাকে যখন হত্যা করেছো, আমাকেও হত্যা করো।’
সিঁড়িতে পড়ে থাকা হিমালয়সদৃশ্য নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া রক্তাক্ত শরীর দেখে বঙ্গমাতা নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, জীবনভর যে যুদ্ধ করে আসছিলেন, তাতে পরাজয় নিশ্চিত। তবুও পরাজয় তিনি মেনে নেননি। সংশপ্তক যোদ্ধার মতো তিনি দৃঢ়চিত্তে রায় ঘোষণা করে বলেছিলেন- উনাকে যখন হত্যা করেছো, আমাকেও হত্যা করো।
বঙ্গমাতাকে তাঁর শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলা হয়। ১৫ই আগস্ট যবনিকাপাত ঘটে অসম সাহসী এক সংশপ্তক যোদ্ধার জীবন সংগ্রামের। ইতিহাস গভীর বেদনায়, বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে বঙ্গমাতাকে, যাঁর সাথে দেখা আর কখনোই হবে না আমাদের।