সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদারের একটি মন্তব্যে অনেকেই কষ্ট পেতে পারেন। কোভিড শুরুর আগে থেকেই দেশে চালের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। হু হু করে বাড়তে থাকে দাম। সরকারের পক্ষ থেকে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ; এমন তথ্য দেওয়া হলেও প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে পরিচিত ‘ধান’ উৎপাদনে বাংলাদেশ মোটেও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অর্থাৎ ধান বা চাল উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে। অন্যসব খাদ্য উৎপাদন মিলিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হলেও চাহিদা পূরণে প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানি করতে হচ্ছে।
কোভিডের ধাক্কা কাটতে না কাটতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিপদ ডেকে নিয়ে আসে। এই যুদ্ধ পৃথিবীর অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে মহা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যার বিরুপ প্রভাব অন্যান্য দেশগুলোর ন্যায় বাংলাদেশেও পড়েছে।
দেশে দেশে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। তাই চাল বা খাদ্যশাস্য রপ্তানিতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। নিজেদের চাহিদা বা খাদ্য ঘাটতির কথা মাথায় রেখেই এমন সতর্কাবস্থা। তাছাড়া এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। এই সুযোগে দেশে আমদানি নির্ভর পণ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের বাজার অস্থির। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম মানুষকে দিনের পর দিন ভোগাচ্ছে।
চাল, আটা, ময়দা, ডিম, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে শাক সবজির দাম অব্যাহত বৃদ্ধি পাওয়ায় এ নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। জীবন যাপনে কষ্ট হচ্ছে মধ্যবিত্ত থেকে সবার। সঞ্চয় ভেঙে চলতে হচ্ছে অনেকের। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চাল আর ভোজ্যতেল নিয়ে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মূল্যের লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টি চরম পর্যায়ে গেছে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চাল আমদানি করাসহ বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতেও দেখা গেছে। তবুও সমস্যার আশানরূপ উন্নতি হয়নি। চালের বাজার যখন সবার মনে রীতিমতো উদ্বেগ ছড়িয়েছে ঠিক তখন এই উদ্বেগের আগুনে ঘি ঢেলেছেন খাদ্যমন্ত্রী নিজেই। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘দশে চালের বাজারে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে সিন্ডিকেট আছে, তা ভাঙা সম্ভব নয়’।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘বর্তমানে দেশে প্রায় বিশ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আরও গম ও চাল আমদানি করা হবে।’ তিনি মিলে কি দরে চাল বিক্রি হচ্ছে, সেখান থেকে আড়তে তারা কি দরে বিক্রি করছেন এবং আড়ত থেকে কিনে খুচরা বিক্রেতারা কত লাভে বিক্রি করছেন তা মনিটর করার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধও জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘...চালে কেউ অস্বাভাবিক মুনাফা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত হলো, চাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয় কেন? একজন মন্ত্রী হিসেবে কেন এই ব্যর্থতার গ্লানি শোনালেন তিনি। কেন মানুষকে আরো অস্বস্তির দিকে ঠেলে দিলেন? তাহলে কী তার পক্ষে চালবাজদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না? তাহলে কি সরকারের চাইতে চাল ব্যবসায়ীরা শক্তিশালী? নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী চক্র যদি শক্তিশালী হয় তাহলে এই ব্যর্থতা রাষ্ট্রের ঘাড়ে এসে বর্তায়। তাছাড়া গুটিসংখ্যক ব্যবসায়ী কোটি কোটি মানুষকে জিম্মি করে রাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাল নিয়ে ব্যবসা করে যাবে, এটা তো হতে পারে না। রাষ্ট্রকে এই চ্যালেঞ্জ যে কোনো মূল্যে মোকাবিলা করতে হবে। মন্ত্রী হিসেবেও তিনি এর দায় এড়াতে পারেন না।
দেশে যদি চালের অভাব নাই থাকে, তবে কেন দাম বাড়ছে? এই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আমরা মন্ত্রীর কাছে রাখতেই পারি। তিনি যদি চাল সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারেন, ব্যর্থতার দায় জাতির সামনে স্বীকার করে নিশ্চয়ই করণীয় জানাবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মন্ত্রীরা ব্যর্থতার দায়ে সড়ে দাঁড়ানোর ইতিহাস নতুন নয়। চালচক্রকে ঠিক করে বাজার পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করতে হয় এর ওষুধ তাকেই আবিষ্কার করতে হবে।
মিলমালিক, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কে কত টাকা প্রতি কেজি চালে লাভ করছেন এমন তথ্য তুলে ধরতে খাদ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের সহযোগিতাও চেয়েছেন। গণমাধ্যমের সহযোগিতা চাওয়া দোষের নয়। তবে কথা হলো, কোন ধাপে চাল ব্যবসায়ীরা কত টাকা লাভ করছেন তা দেখার কি কেউ নেই? গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কি কোনো বিভাগ নেই এসব মনিটরিং করার। মন্ত্রণালয়ের কেউ কি কোনো দিন চালের বাজার দেখতে অনুসন্ধানে নেমেছেন?
চাল সিন্ডিকেট চক্রের একটি তালিকাও তো মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি। এটা কি মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা নয়? প্রশ্ন হলো আর্থিক মন্দা পরিস্থিতির মুখে বেশি দামিই সাধারণ মানুষকে চাল কিনে যেতে হবে? যদিও গতকাল চালের কেজি ২ টাকা কমেছে এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দুদিন পরেই যে কেজিতে চার টাকা বাড়বে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেই এসব দেখতে হবে। তাদের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতার সুর চাল সিন্ডিকেট চক্রকে আরো বেশি উসকে দেবে। তাই অসহায় আত্মসমর্পণ নয়, শক্ত হাতে চাল সিন্ডিকেট চক্রের লাগাম টেনে ধরতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক