গত বৃহস্পতিবার ব্রিটেনের দীর্ঘতম রাজ্য শাসন করা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দেহাবসান হলো। দীর্ঘ ৭০ বছরের শাসনের যবনিকাপাত ঘটল। তিনি যুক্তরাজ্যসহ ১৫টি দেশ ও অঞ্চলের রানি এবং ৫৪ সদস্যের জোট কমনওয়েলথের প্রধান ছিলেন। সে হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী শাসক ছিলেন তিনি। যদিও এ যুগে রাজা-রানির পদ আলঙ্কারিক। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে মধ্যযুগীয় এই আলঙ্কারিক পদ কেন আকড়ে ধরে আছে ব্রিটেনের মতো অগ্রসর একটি দেশ? যখন পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে আন্দোলনের মুখে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছে। এই প্রশ্নটা শৈশব থেকে আমার মাথায় ঘুরপাক খেত। বিশেষ করে প্রিন্সেস ডায়ানাকে নিয়ে যখন ব্রিটেনের রাজপরিবারে টানাপোড়েন শুরু হয়।
১৯৮১ সালে যুবরাজ চার্লসের সঙ্গে বিশ বছর বয়সী অনিন্দ্য সুন্দরী ডায়ানা ফ্রান্সেস স্পেন্সারের বিয়ে হয়। অল্প দিনে ডায়ানা রূপের আগুন ছাপিয়ে ব্যক্তিত্বের প্রখরতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। তিনি লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর কাছে যেমন ফ্যাশন আইকন ছিলেন, তেমনি ছিলেন মানবতার প্রতীক। এইডস রোগ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও ভূমি মাইনের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু বিয়ের বছরপাঁচেক যেতে না যেতেই যুবরাজ চার্লসের সঙ্গে ক্যামিলা পার্কারের পরকীয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। লম্পট চার্লকে শাসন করছেন না রানি, এমন একটা মর্মবেদনা আমাদের মধ্যে কাজ করত। ১৯৯২ সালে চার্লস এবং ডায়ানা প্রকাশ্যে আলাদা হয়ে যান। এর তিন বছর পর রানি এদের বিবাহ বিচ্ছেদের আহ্বান জানান। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ডায়ানা।
আজ এতোদিন পর রানির সেদিনকার ভূমিকা নতুন করে ভেবে দেখলাম। আসলে কী-বা করার ছিল ভদ্রমহিলার। চার্লস ও ডায়ানা তো ভালোবেসেই সংসার করেছিলেন। সব প্রথা উপেক্ষা করে সাধারণ পরিবারের মেয়ে ডায়ানাকে রাজপরিবারে সাদরে গ্রহণ করে নেন রানি। এরপর যদি তাদের মিলমিশ না হয়, কি করার থাকে তৃতীয় ব্যক্তির। সেসময় এসব ব্যাপারে নিরুচ্চার থেকে রানি যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন আজ তা ভাবলে অবাক লাগে।
ডায়ানা-চার্লস নিয়ে বিশ্ব যখন ব্যস্ত, তখন রানির আরেক পুত্র অ্যান্ড্রুর সংসারও ভাঙছে। পরে তার নামে শিশু নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।
রানির নাতিরাও বাপ-চাচার চেয়ে কম নন। প্রিন্স হ্যারি রাজপরিবারের রীতি ভঙ্গ করে অশ্বেতাঙ্গ মেয়ে বিয়ে করে কম নাকানি চুবানি খাওয়ায়নি বৃদ্ধা দাদিকে। কিন্তু সব কিছু ধৈর্য্য ও কৌশলে সামাল দিয়েছেন রানি এলিজাবেথ। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের মেয়েরা হয়ত বংশানুক্রমিকভাবে এই প্রজ্ঞা পেয়ে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর জার্মান বোমার হাত থেকে বাঁচাতে দুই রাজকুমারী এলিজাবেথ এবং মার্গারেটকে কানাডায় সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তখনকার রানি এলিজাবেথ বোয়েস-লিয়ন মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন, আমার বাচ্চারা আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। আমিও রাজাকে ছেড়ে যাব না। যুদ্ধের পুরো সময় রাজকুমারী এলিজাবেথ দেশেই ছিলেন। অক্সিলারি টেরিটোরিয়াল সার্ভিসে ড্রাইভার ও মেকানিক্সের কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, ফকল্যান্ডস যুদ্ধে তিনি তার সন্তানকে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছিলেন। এ প্রজ্ঞার কারণে ব্রিটেনের রাজপরিবার সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন হারায়নি শত শত বছর পরও।
অভিষেক অনুষ্ঠানে বাকিংহাম প্যালেসের ব্যালকনিকে ডিউক অব এডিনবার্গের পাশে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওপিনিয়াম রিসার্চ ২১ থেকে ২৪ আগস্ট ২০১৫ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের ২,০০৩ জন প্রাপ্তবয়স্কের উপর একটি অনলাইন জরিপ পরিচালন করে। সেখানে রানির ভূমিকায় ৭১% ব্যক্তি সন্তোষ প্রকাশ করে। তারা রাজতন্ত্রের পক্ষে। এদের রানির একটি গুণ বা দোষ বলতে বলা হয়েছিল। ৩৭% বলেছে রানি নিবেদিত, ৩৪% কঠোর পরিশ্রমী এবং ৩২% ঐতিহ্যগত। অবশ্য ১৭% সেকেলে এবং ১৫% পুরনোও বলেছে।
১৯৯৯ সালে রানির উপনিবেশ অস্ট্রেলিয়ায় ‘গণতান্ত্রিক অস্ট্রেলিয়া’ করার ব্যাপারে গণভোট হয়। সেখানে ৫৫% ভোটে রাজতন্ত্র টিকে যায়। এখনো রাজপরিবারকে ব্রিটিশরা তাদের অভিভাবক হিসেবে মনে করে। এর পেছনে বিরাট ইতিহাস আছে। একটা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এই রাজপরিবারের শাসকরাই সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সাম্রাজ্যের মালিক করে তুলেছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে হয়ে উঠেছিল পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
দ্বিতীয় এলিজাবেথের কথার প্রসঙ্গে প্রথম এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩) নিয়ে কিছু না বললে ইতিহাসের প্রতি অবিচার হবে। এই মহিয়সী নারী ব্রিটিশদের যুদ্ধজয়ী জাতিতে পরিণত করেছিলেন। একটি সামুদ্রিক দ্বীপের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজ জাতির একসময় ভীষণ সমুদ্র-ভীতি ছিল। তারা ক্রীট দ্বীপের চেয়ে বেশি দূরে যেতে চাইত না। তাও পশম বিক্রির জন্য। স্পেনিশরা ইতোমধ্যে সমুদ্রপথে পৃথিবী দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা আমেরিকা আবিষ্কার করে বিশাল ধনী। পর্তুগিজরা আফ্রিকা দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। ইটালীয়রা শত বছর ধরে পৃথিবী শাসন করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। গ্রিক বা ডাচরাও কম যায় না।
ব্রিটিশদের মূল ব্যবসা ছিল পশমের কাপড়ের। কিন্তু ফ্রান্স ও স্পেনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ায় পশম কাপড়ের ব্যবসায় ধ্বস নামে। ইউরোপের বাজার হাতছাড়া হয়ে যায়। তখন রানি দেখলেন বিকল্প বাজার খোঁজা ছাড়া টিকে থাকা যাবে না। ব্রিটিশদের ভাগ্য তাই সমুদ্রপথেই লেখা আছে। তিনি দূরসমুদ্র যাত্রায় নাবিকদের উৎসাহিত করতে লাগলেন। তাতে তেমন একটা কাজ হলো না। তাঁর চোখ গেলো জেলেদের দিকে। ওরা যদি নিয়মিত সমুদ্রে যায় তাহলে সমুদ্র-ভীতি কেটে যাবে। কিন্তু জেলেরাও যেতে আগ্রহী নয়। কারণ ইংল্যান্ডের মানুষ মাছ খেতে চায় না। তাদের প্রধান খাদ্য ভেড়ার মাংস। ভেড়া পালে পশমের জন্য। পরে সেই ভেড়া কেটে মাংস খায়। কী এক বিপদের ব্যাপার!
তখন রানি বাধ্য হয়ে একটা আইন করলেন, সাপ্তাহে দুই দিন শুক্রবার আর বুধবার কেউ মাংস খেতে পারবে না। আর লেন্ট অর্থাৎ ইস্টারের আগের ৪০ দিন কেউ মাংস খেতে পারবে না। এই আইনের কারণে সামুদ্রিক মাছের চাহিদা বেড়ে গেলো। একটা ঘরকুনো জাতি আস্তে আস্তে বিশ্বজয়ে বের হলো। কিন্তু কথা হলো, সে রামও নেই সে অযোধ্যাও নেই। ব্রিটিশ রাজপরিবারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবার মতো কে কী রইল আর? তাই অনেকে বলছেন, দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ রাজপরিবারের গুরুত্ব দিন দিন কমে আসবে।
বিপরীত মতও আছে। স্বৈরাচারী রাজা জন, সামন্তবাদীদের (ব্যারন) বিদ্রোহের মুখে ১২১৫ সালের ১৫ জুন যে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, সেটাই ইংল্যান্ডকে আধুনিকতার পথ দেখিয়েছিল। বিশ্ব প্রথম দেখল রাজাও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ম্যাগনা কার্টা নামের এই চুক্তি ইংল্যান্ডকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে পৃথিবীর মানুষ রাজতন্ত্রের নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য ইংল্যান্ডের পথ দেখেছিল। ফলে এতো পুরনো ও পরিণত রাজতন্ত্র সহজেই ধসে পড়বে না বলে অনেকের বিশ্বাস।