মতামত

জলবায়ু উদ্বাস্তু আসলে কারা?

বছর দুয়েক আগে রিপোর্ট করতে গিয়েছিলাম ঢাকা শহরের একমাত্র স্বীকৃত জলবায়ু উদ্বাস্তু আশ্রয়কেন্দ্রে। সদরঘাটের খুব কাছে, বুড়িগঙ্গার পাড়ে সুপরিসর এক জায়গায় এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সুযোগ-সুবিধা সেখানে ভালোই রাখা হয়েছে। বাস্তুচ্যুত যেকোনো মানুষের জন্য এটি একরকম স্বপ্নের আবাস। কিন্তু সেখানে গিয়ে যাদের দেখা পাওয়া গেলো তারা ঠিক বাস্তুচ্যুত কি না তা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিছু দরিদ্র মানুষ সেখানে আশ্রয় পেয়েছে বটে। তাদের মধ্যে ফুটপাথের খুচরো ব্যবসায়ী যেমন আছেন, আছেন ভাসমান পতিতাও। নানা কারণেই ঢাকায় তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই। কিন্তু সেই কারণটি ঠিক জলবায়ু বলে তাৎক্ষণিক বোধগম্য হয়নি। 

রিপোর্টিংয়ের কাজেই এবার যাওয়া ঢাকার কল্যাণপুর বস্তিতে। উদ্দেশ্য একই। জলবায়ু উদ্বাস্তুর সন্ধান। কিছুটা হতাশ হতে হলো এবারও। ১৭ একর বিস্তৃত জায়গায় নিয়ে গড়ে ওঠা এই বস্তিতে প্রায় ১০ হাজার লোকের বসবাস। স্থানীয়ভাবে সবাই এটাকে পোড়া বস্তি নামে চেনে। ১৯৮৮ সালে বন্যার পর এই বস্তি গড়ে ওঠে। এরপর ছয় ছয়বার এটি অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর সবই যে দুর্ঘটনাজনিত বস্তিবাসীরা সেটা বিশ্বাস করেন না। তবে সেটা অন্য আলোচনা। আগুনে পোড়ার আগে একসময় মানুষের কাছে এই বস্তি পরিচিত ছিল ভোলা বস্তিু নামে। কারণটা অনুমেয়। এর অধিকাংশ মানুষ ভোলা থেকে আসা। তাদের একটা বড় অংশ নদী ভাঙনের কারণে বাস্তুচ্যুত। 

বস্তিুতে কাজ করেন এরকম একটি এনজিওর মাধ্যমে আগেই তাদের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেছে। এনজিওটির করা জরিপে জানা যায়, এই বস্তিুর কমপক্ষে ২১ শতাংশ বাসিন্দা জলবায়ু উদ্বাস্তু। সেই এনজিওর অফিসেই কথা হয় কমপক্ষে ১৫ জন বস্তিবাসীর সঙ্গে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ১৫ জনের মধ্যে কাউকেই পাওয়া যায়নি যারা জলবায়ুর প্রভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রান্ত থেকেই তারা এখানে এসেছেন। নিজ এলাকা ছেড়ে বস্তির জীবন বেছে নেওয়ার পেছনে সবার কারণও একটাই। নদী ভাঙন। সেই ভাঙনটাও হয়েছে কয়েক দশক আগে। নিকট অতীতে ঘর-বাড়ি ভেঙেছে এমন কারো দেখা অন্তত এখানে পাওয়া যায়নি। এখন যাদের ঘর ভেঙেছে তারা হয়তো আবার নদীর কাছাকাছি কোথাও নতুনভাবে জীবন গড়ার চেষ্টায় আছেন।         দ্বিধাটা এ কারণেই। আমরা যাদের জলবায়ু উদ্বাস্তু বলে ধারণা করি, এরাই কি তারা? নদী ভাঙনের যারা শিকার তাদের কি জলবায়ু উদ্বাস্তু বলা যায়? নদীতো ভাঙছে সেই অনাদিকাল থেকেই। সন্দেহটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এই বিষয়ে বড়মাপের একজন বিশেষজ্ঞ সালিমুল হক। ব্রিটিশ বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ইনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ‌্যান্ড ডেভলপমেন্টের পরিচালক। তার কাছেই প্রশ্ন রেখেছিলাম, জলবায়ু উদ্বাস্তু আসলে কারা? বাংলাদেশে এখন যাদের জলবায়ু উদ্বাস্তু বলা হয় তাদের কতো শতাংশ সত্যিকারের জলবায়ু উদ্বাস্তু। উত্তরে তিনি যা জানালেন, তার সারমর্ম এমন, জলবায়ু উদ্বাস্তুর সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। এখন যাদের জলবায়ু উদ্বাস্তু বলা হচ্ছে তারা মূলত নদী ভাঙনের শিকার।

তবে ভবিষ্যতে জলবায়ুর সরাসরি প্রভাবে অসংখ্য মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কাটা তিনি জানিয়ে রাখলেন। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে ২০৫০ সালে বাংলাদেশে এই সংখ্যাটা ১ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছাবে। এদের একটা বড় অংশ সুপেয় পানির অভাবে নিজেদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হবে। ফসলি জমিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতাও অনেককে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য করবে। ঘূর্ণিঝড় আইলার ব্যাপক এবং মারাত্মক প্রভাবে এ ধরনের উদ্বাস্তুর সংখ্যা এখনই নেহায়েত কম নয়। এখন তারা যদি নদী ভাঙনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সঙ্গে যোগ হন তবে এখনই বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ‌্য সংখ্যক জলবায়ু উদ্বাস্তুর দেশ বলা যায়।   

এ বছর সিলেট অঞ্চলে যে বন্যা হয়েছে তাতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্তু হয়েছে। এদের অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে বন্যা শেষে তাদের প্রায় অধিকাংশ ঘর-বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন। বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত, সিলেটের আকষ্মিক এই বন্যায় জলবায়ু পরিবর্তনের দায় অনেকখানি। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে এবারের বৃষ্টিপাত কয়েক দশকের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আশে-পাশের অন্যান্য অঞ্চলেও বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। যার কারণে মানুষ বাধ্য হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যেতে। তাদের কতজন স্থায়ীভাবে উদ্বাস্তু হয়েছেন সে হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি।  আর এসব কারণেই নানা বৈশ্বিক সংস্থা এখানে জলবায়ু উদ্বাস্তুর হিসাব দিয়ে যাচ্ছেন তা নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। 

জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়ান ফ্রাই মাত্রই বাংলাদেশ সফর করেছেন। তার কাছেও প্রশ্ন রেখেছিলাম, নদী ভাঙা লোকজনকে জলবায়ু উদ্বাস্তু বলা যায় কি না। ফ্রাই অবশ্য তাদের জলবায়ূ উদ্বাস্তু বলার পক্ষেই। কারণটা ও পরিস্কার করেছেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি কারণে বন্যাও ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে, সময় পরিবর্তিত হচ্ছে। এর ফলে ভাঙনের তীব্রতাও বাড়ছে। বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙেও মানুষের বাড়িঘর তলিয়ে যাচ্ছে। ভাঙন কবলিত এই মানুষগুলোই এক সময় ভাসমান হয়ে যাচ্ছে, ঠাঁই নিচ্ছে ঢাকার সিটি করপোরেশনের আশ্রয় শিবির কিংবা পোড়া বস্তিুতে।   

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, নিউ এইজ ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি ইএফই