দুর্গাপূজা মূলত একটা যুদ্ধকে স্মরণ করে মহামায়া শক্তির আরাধনা করা। মহিষাসুরের হাত থেকে স্বর্গ উদ্ধারের জন্য দেবতাদের পুঞ্জীভূত শক্তিতে মহালয়ার দিন দেবী মহামায়ার আবির্ভাব। তার সাত দিনের মাথায় মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়। দশম দিনে দেবীর জয় হয়। তাই ‘বিজয়া’ বলা হয়। সেই যুদ্ধ হয়েছিল চৈত্র মাসে। পরে শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধারের জন্য লঙ্কা যাত্রার পূর্বে ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর পুজা করেন আশ্বিন মাসে। সেখানেও উদ্দেশ্য যুদ্ধজয়। আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত দেবতাদের নিদ্রাকাল। এসময় দেবীর ঘুম ভাঙানো হয়েছিল বলে এ পূজাকে ‘অকালবোধন’ বলা হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে বৃন্দাবন ক্ষেত্রের মহা রাসম-লে শ্রীকৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন। দ্বিতীয় দুর্গাপূজা করেন ব্রহ্মা। মধু ও কৈটভ দুই দৈত্যকে বধ করার জন্য তিনি মহামায়ার শরণাপন্ন হন। তৃতীয় দুর্গাপূজা করেন স্বয়ং মহাদেব ত্রিপুরাসুরকে দমনের জন্য। এরপর দুর্গাপূজা করেন দেবরাজ ইন্দ্র। এছাড়া সুরথ রাজা দুর্গাপূজা করেছিলেন হারানো রাজ্য ফিরে পাবার জন্য।
এতো গেলো পুরাণের কথা। কিন্তু ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব আরো কঠিন কিছু সাক্ষ্য দেয়। জানা যায় বিশ্বময় মাতৃবন্দনার এক বিস্তৃত ইতিহাস। প্রায় ২২ হাজার বছর পূর্বে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। এরও আগে অন্তত ৩০ হাজার বছর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পাথর খুঁদে উৎপাদনের প্রতীক হিসেবে নারী মূর্তি তৈরি করে উপাসনা করা হতো। তখনও হয়ত কোনো পূজার রীতি তৈরি হয়নি। এরকম একটি আলোচিত নারী মূর্তি ভেনাস অফ উইলেনডর্ফ। এটি পশ্চিম ইউরোপের অস্ট্রিয়ায় ১৯০৮ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। সেই মূর্তির সঙ্গে মিল পাওয়া যায় কুষান যুগে তৈরি বগুড়ার মহাস্থানগড় জাদুঘরে রাখা চতুর্ভুজ মহিষমর্দিনী মূর্তির। উইলেনডর্ফের ভেনাসের মতোই এই চতুর্ভূজা দুর্গার ভারী বুক পৃথুলা শরীর। তার দেহে লাস্যময়ী তন্বীর বিভা নেই, বরং আছে মাতৃত্বের ভারে ঝুলে পড়া শরীর।ৎ
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় বহুভূজা দেবী ইনান্না বা ইশতারর উপাসানা করা হতো। এর সঙ্গে দেবী দুর্গার মিল অবাক করার মতো। অনেকে ধারণা করেন ইনান্না বা এনান্না, ভারতবর্ষে এসে হয়ে গেলেন অন্নপূর্ণা। অন্নপূর্ণা দেবী দুর্গার আরেক নাম। আবার উল্টো দাবিও আছে অনেকের। সিন্ধু সভ্যতায় দেবীপূজার আবির্ভাব কীভাবে ঘটল সে সম্পর্কে ড. অতুল সুর তাঁর ‘সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ ও সমস্যা’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভৃতি নগরে দেবীপূজার যে ব্যাপক প্রচলন ছিল, তা মৃন্ময়ী মাতৃকাদেবীর মূর্তিসমূহ প্রকাশ পায়। পুরুষ দেবগণ কর্তৃক অধিকৃত ঋগ্বেদের দেবতামণ্ডলীতে, মাতৃদেবীর কোনো স্থান ছিল না। পরবর্তীকালে যখন সাংস্কৃতিক সমন্বয় ঘটেছিল, তখনই প্রাগার্য দেবীসমূহের হিন্দুধর্মে অনুপ্রবেশ ঘটে। যেমন, প্রাগার্য যুগের অন্তিমে আমরা কালী, করালী প্রভৃতি দেবীর নাম পাই।’
ড. অতুল এই গ্রন্থে সুমেরীয় দেবী ইনান্না বা এনান্নার সঙ্গে অন্নপূর্ণার অদ্ভুত সাদৃশ্য নিয়ে লিখেছেন: ‘সুমেরের প্রধান দেবতা এনান্না নামের সঙ্গে অন্নপূর্ণা নামের সাদৃশ্যও তাই সূচিত করে। বস্তুত সুমের এবং ভারতের মাতৃদেবীর মধ্যে কতকগুলো মূলগত সাদৃশ্য দেখে কোনো সন্দেহ থাকে না যে এই উভয়দেশের মাতৃপূজা একই সাধারণ উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।’
ছবি: দেবী ইনান্না
বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজা প্রচলন নিয়ে অনেক বির্তক আছে। কেউ কেউ দাবি করেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর মেধস মুণির আশ্রমে, কেউ দাবি করেন পশ্চিমবঙ্গে গড়দুর্গাপুরের অদূরে গড়জঙ্গলে, কারো কারো দাবিতে রাজশাহী জেলার তাহিরপুরে প্রথম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজা উদযাপন নিয়ে দারুণ একটি প্রবন্ধ ১৯৭০ সালের ১০ মে ‘দৈনিক যুগান্তর’-এ প্রকাশ হয়। লেখক ছিলেন রঞ্জিতবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে তিনি লিখেছেন: ‘আজ থেকে সে প্রায় চারশ বছর পেছনের বাঙলাদেশ। তাহেরপুরের (তাহিরপুর হবে) মস্ত বড় রাজবাড়ী। রাজার নাম কংসনারায়ণ রায়। জাতিতে ব্রাহ্মণ। রাজা কংসনারায়ণ রায়ের আবার পদবী ছিল খাঁ। তাই কেউ কেউ আবার তাঁকে রাজা বলেও সম্মান দিতো। রাজা কংসনারায়ণ রায়ও রাজ্যের সকল প্রজাদের খুবই ভালোবাসতেন। সুখ-দুঃখ বুঝতেন। এ হেন সেই সর্বজনপ্রিয় কংসনারায়ণ রায়ের একদিন হঠাৎ করে ইচ্ছে হলো- একটা বড় কিছু পুণ্য কর্ম করার। যেই ভাবা, সেই কাজ। পাত্র-মিত্রকে নিয়ে বসে গেলেন যুক্তি-পরামর্শের জন্যে। সবাই একবাক্যে বললেন: একটি যজ্ঞ করুন মহারাজ। মহাযজ্ঞ। রাজা বললেন: মহাযজ্ঞ? হ্যাঁ, মহারাজা, মহাযজ্ঞ। তাহলে আপনার মহাপুণ্যও হবে, আবার একটি কাজের মতো কাজই হবে, যা বাঙলাদেশে ইতিপূর্বে আর কেউ কোনদিন করেননি। আপনি তাই করুন। বেশ, তা হলে... তাই-ই করুন। এর জন্যে আমাকে কী কী করতে হবে, আয়োজন ইত্যাদিও সঠিকমত ফর্দ করে দিন আপনারা সবাই মিলে। দেখুন, আমার আর ত্বর সইছে না যেন। তখন পাত্র-মিত্ররা আবার আলোচনায় বসলেন। অচিরেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত শাস্ত্রী মহাশয়ের যুক্তি পরামর্শ নেওয়া হোক সবার আগে। তিনি এসে যা যা আয়োজন করতে বলবেন, তাই তাই করা হবে। রাজা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন: তাহলে আজই পণ্ডিত শাস্ত্রীকে আনতে লোক পাঠানো হোক। লোক গেল। এলেন শাস্ত্রী মহাশয়। তিনি সব শুনে রাজাকে বললেন: দেখুন মহাযজ্ঞ বিধানে চারটিই আছে। রাজা জিজ্ঞেস করলেন কী কী? পন্ডিত বললেন: অশ্বমেধ, গোমেধ, রাজসূয় আর বিশ্বজিৎ। এই চারটি মহাযজ্ঞ বলে আমি শাস্ত্রে পাচ্ছি মহারাজা। রাজা বললেন: তা হলে কোন মহাযজ্ঞের কী কী বিধান? আমাকে তা ভালো করে বুঝিয়ে বলুন। পণ্ডিত বললেন: শুনুন রাজা, এক এক করে আমি চারটি মহাযজ্ঞ করার অধিকার কার আছে, আর কোন্ মহাযজ্ঞ একেবারেই করা যায় না, তা বলছি। শুনুন। রাজা বললেন: বলুন। পণ্ডিত বললেন: একমাত্র দিগ্বিজয়ী রাজা যিনি, তিনিই শুধু ‘অশ্বমেধ’ মহাযজ্ঞ করতে পারেন। আপনার মত একজন ভুঁইয়া রাজা এ যজ্ঞ করতে পারেন না। আর ‘গো-মেধ’ মহাযজ্ঞ তো এ যুগে অচল। কারণ, এ যজ্ঞ পুণ্যের পরিবর্তে ‘পাপ’ বলেই খ্যাত আজকের দিন। তাহলে আর বাকী দুটি মহাযজ্ঞ। ‘রাজসূয়’ ও ‘বিশ্বজিৎ’ মহাযজ্ঞ। এবার শুনুন এ দুটি মহাযজ্ঞের কথা। বলুন, বলুন। রাজার অধীর প্রশ্ন। পণ্ডিত বললেন: একমাত্র একচ্ছত্র সার্বভৌম সম্রাট ছাড়া এ দুটিও সম্ভব নয়। অর্থাৎ যে রাজা আর আর সকল রাজ্য বাহুবলে জয় করে নিতে পারেন, ‘রাজসূয়’ ‘বিশ্বজিৎ’ মহাযজ্ঞ একমাত্র তাঁরই করবার অধিকার আছে বিধানে। শুধু তাই নয় সকল মহাযজ্ঞেরই একমাত্র অধিকার আছে বিধানে ক্ষত্রিয় রাজাদেরই। আপনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় নন। সব শুনে রাজা ক্ষোভে ভেঙে পড়লেন হতাশায়। বললেন: তা হলে উপায়? আমার দ্বারা কি কোনও বড় কাজ হতে পারে না পণ্ডিত। পণ্ডিত বললেন, হ্যাঁ, হতে পারে। ‘হতে পারে’ শুনে রাজা যেন ঘোর অন্ধকারের মাঝে এক ঝলক আলো দেখতে পেলেন। তখন পণ্ডিত গম্ভীর সুরে বললেন বড় পুজো।’
এই পূজা একসময় বিস্মৃতিতে তলিয়ে গিয়েছিল। প্রথম দুর্গাপূজা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও এটা সবাই স্বীকার করবেন পুজো বাঙালিদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলেন কলকাতার শোভাবাজারের রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব। ইংরেজদের বঙ্গবিজয়ের পেছনে এ ভদ্রলোক বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাই পলাশী যুদ্ধের পর তিনি হয়ে উঠেছিলেন কলকাতার সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী বাঙালি বাবু। তিনিই প্রথম দুর্গাপূজা চালু করেন। উদ্দেশ্য ছিল বছরে একবার একটা অনুষ্ঠানের ছলে ব্রিটিশ সাহেবদের তার বাড়িতে দাওয়াত দেওয়া। পূজার নামে পানাহার ও বাইজি নাচ হতো অকছার। তাই সাহেবদের খুব আগ্রহ ছিল এ পূজার ব্যাপারে। অবশ্য সেটা বুঝতে পেরে ১৮৪০ সাল থেকে ইংরেজ সাহেবদের পুজোয় যাওয়া বন্ধ করে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এর আগেই নবকৃষ্ণকে দুর্নীতির দায়ে ফাঁসি দেয় ইংরেজরা।
প্রথম দিকে এই পুজো ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এ দুঃখ থেকে বারো বন্ধু বা ইয়ার মিলে একটি পূজার আয়োজন করে। সেটাই পরে বারোয়ারি পুজা হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। মা দুর্গা ধনীর ঘর থেকে সাধারণের ঘরে আসতে শুরু করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বাঙালির কল্পনা। শরতে দেবী স্বামীর গৃহ থেকে আসেন বাপের বাড়ি বেড়াতে। সঙ্গে তার ৪ সন্তান। কিন্তু এই চার সন্তানের উপস্থিতি পুরনো কোনো দুর্গামূর্তিতে পাওয়া যায় না। এ একান্তই বাঙালি উচ্চ কল্পনাশক্তির বহিঃপ্রকাশ। যুদ্ধংদেহী দেবীকে গেরস্ত বাড়ির মেয়ে বানিয়ে দেওয়া হয়। হয়ত বাঙালি মার্শাল ন্যাশন নয় বলে দেবীর যুদ্ধংদেহী রূপ তারা হজম করতে পারেনি। তাই তাঁকে একটি পরবর্তিত কাঠামো দেয়া হয়। দেবী দুর্গার আদিরূপের আরাধনা বোধহয় বাঙালি করে না। করে নিজস্ব সৃজিত এক নির্মিতির।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা