মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সবচেয়ে বড় পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আজকে আমাদের যতটুকু উন্নতি, তা সম্ভব হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই। আজ যদি আমরা পাকিস্তানের অংশ থাকতাম, তাহলে এই ভূখণ্ড হতো জঙ্গি তালেবান অধ্যুষিত একটি গরিব অঞ্চল।
স্বাধীনতার আগে যেভাবে পাকিস্তানিরা একই দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের উপর শোষণ-নির্যাতন-জুলুম চালিয়েছিল, আমাদের গরিব মজুরে পরিণত করেছিল, আমরা স্বাধীন না হলে সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। আমরা সৌভাগ্যবান যে, বাঙালি জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষ জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের অপরিসীম ত্যাগ, সাহস ও বীরত্বের জন্যই আমাদের আজকের স্বাধীন স্বদেশ, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ!
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, বাংলার ইতিহাসে তা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি ভারতবর্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দল যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই তারা সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করতে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে তথা বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে এরা বিন্দু পরিমাণ মনোযোগ দেয়নি। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের রাজনীতিবিদদের বিভিন্নভাবে হত্যা করে দেশকে লুটপাটের অভয়ারণ্য বানানোর পাঁয়তারা করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে বিএনপি বা জাতীয় পার্টি এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি, যা দেখে বাংলার মানুষ অহঙ্কার করতে পারে। তারা শুধু লুটপাট করেছে এবং জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে বাংলার মানুষকে অগ্নি সন্ত্রাস উপহার দিয়েছে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় সবক’টি বড়ো দুর্নীতি ও আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য দুর্নীতির তীর্থ বনানীর হাওয়া ভবন সংশ্লিষ্টরা কোটি কোটি টাকা উৎকোচ আদায় করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান, তাদের পরিবারের সদস্যবর্গ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও তারেক রহমানের বন্ধু বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনসহ হাওয়া ভবন সিন্ডিকেট এসব টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক সাব্বির হত্যাকাণ্ড, সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সাবেরা বেগম ও তার মেয়ে হত্যাকাণ্ড, যুবদল নেতা সাগীর হত্যাকাণ্ড, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন হত্যাকাণ্ড, চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, বিডি ফুডসের বিদেশে পণ্য সামগ্রী পাঠানোর আড়ালে হেরোইন পাচারের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য হাওয়া ভবন সিন্ডিকেট স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের যোগসাজশে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে দুর্নীতির ত্রিরত্ন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান এবং গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে।
কথায় আছে- ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। আসলেই ধর্মের কল বাতাসে নড়েছে। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির রায়ের কল নড়েছিল ২৩ বছর ২ মাস পরে আর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষিত হয় ১৪ বছর ২ মাস ১৯ দিনের মাথায়। দীর্ঘ সময় পরে হলেও আদালতের রায়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুখোশ খুলে গেছে ষড়যন্ত্রকারীদের। আজ শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, পৃথিবীর নানান দেশের মানুষই বুঝতে পারছে বিএনপি স্বচ্ছ রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়, বিএনপির বিশ্বাস হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে! বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল, স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াত তাদের বন্ধু। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বিকেল ৫.৪০ মিনিটে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সেই হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান আওয়ামী লীগের ২৪ জন নিরপরাধ নেতাকর্মী। এর মধ্যে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানও আছেন। আহত হন পাঁচশ’র অধিক নেতাকর্মী।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দিবালোকে এমন নৃশংস ঘটনার আর কোনো নজির নেই। সবশেষে শেখ হাসিনাকে বহন করা গাড়িতেও গুলি করেছিল তাকে হত্যার জন্য। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। মূলত শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৯ বার হামলা চালানো হলেও, এর পেছনে ছিল আরও গভীর চক্রান্ত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য বানাতে চেয়েছিল, বিপথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তমূল্যে কেনা সমস্ত অর্জন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চায়নি বিএনপি ও তার দোসররা। এই হামলাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য সমস্ত আলামত নষ্ট করা হয়। তবু শেষ রক্ষা হয় না। একে একে বের হতে থাকে আসল ঘটনা। তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১০ অক্টোবর, ২০১৮ সালে ঘোষিত হয় আদালতের রায়। ৪৯ জন আসামির মধ্যে ১৯ জন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়, যাবজ্জীবন সাজা হয় ১৯ জনের, বাকি এগারো জন পায় বিভিন্ন মেয়াদের দণ্ড।
বাংলাদেশ একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলে পরিচিত ছিল। দুর্নীতিতে পাঁচ-পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। অখ্যাতি জুটেছিল ব্যর্থ রাষ্ট্রের। জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। খাদ্যে, কৃষিতে, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায়, শিল্পে, শিক্ষায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে, নারীর ক্ষমতায়নে, উত্তাল সবুজ পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায়, আইনের শাসন বাস্তবায়নে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জঙ্গি দমন করে, বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। একনজরে শেখ হাসিনা সরকারের বিগত বিশ বছরের উন্নয়নের কিছু তথ্য তুলে ধরছি। যেগুলো কেবল খাতা-কলমের উন্নয়ন নয়, বাস্তবেও তা দৃশ্যমান।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ৬.০১ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৮৬ শতাংশ; একইসঙ্গে মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হয়েছে ১ হাজার ৭৫২ মার্কিন ডলার। বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ১২.৩ শতাংশের তুলনায় বর্তমানে ৫.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশে দারিদ্র্য হার ২১.৩ শতাংশে ও অতি দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৮ সালে দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ৩৫.০ ও ২১.০ শতাংশ। মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ পূর্ণবেতনে চার মাস হতে ছয় মাসে উন্নীত করা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৪,৯৪২ মেগাওয়াট থেকে ২০,১৩৩ মেগাওয়াটে (ক্যাপটিভসহ) উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে ১৩,৯৮৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন; পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ি ও মহেষখালীতে কয়লাভিত্তিক সর্বমোট ৯,৯৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৮টি মেগা প্রকল্প চলমান। নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক ৫১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ৫২ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ৪৭ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত।
২০০৯ থেকে জুন ২০১৮ পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ অধিদফতর কর্তৃক উন্নয়ন খাতের আওতায় ৪ হাজার ৩৩১ কিলোমিটার মহাসড়ক মজবুতিকরণসহ ৫ হাজার ১৭১ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রশ্রস্তকরণ করা হয়েছে। ৪১৭ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার-লেন বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে; দেশের অর্থনীতির লাইফ-লাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের ১৯০ কিলোমিটার চার-লেনে উন্নীত করা হয়েছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালি পর্যন্ত ৮৭০৩.১১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৪৬.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ২০১১ সালে পৃথক ‘রেলপথ মন্ত্রণালয়’ গঠন করা হয়। প্রায় ১০ বছরে ৩৩০.১৫ কিমি নতুন রেললাইন নির্মাণ। ৯১টি স্টেশন বিল্ডিং নতুন নির্মাণ ও ২৪৮.৫০ কিমি মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর। রেলওয়ের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য ৩০ বছর মেয়াদি (২০১৬-৪৫) একটি মাস্টার প্ল্যান অনুমোদিত। লালমনিরহাট হতে বুড়িমারী পর্যন্ত ৯৫ কিমি সংস্কারকৃত পথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া ও পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর বন্ধ রেলওয়ে সেকশন চালু করা হয়েছে।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ২০০৮-০৯ অর্থবছর হতে প্রণোদনা চালু করেছে। অদ্যাবধি এ কর্মসূচির মাধ্যমে ৮২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৩ কৃষক উপকৃত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন বাবদ ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকার কৃষককে মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেওয়ায় ১ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৮টি ব্যাংক হিসাব খোলা সম্ভব হয়েছে, যেখানে বর্তমান স্থিতি প্রায় ২৮২ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত বাজেট ছিল ৭৯২৪.৫৭ কোটি টাকা, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৩০৩.৮৪ কোটি টাকায়, অর্থাৎ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। লবণাক্ততা, খরা, জলমগ্নতা সহনশীল ও জিংকসমৃদ্ধ, ধানসহ এ পর্যন্ত ধানের ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিজিটাল কৃষি তথা ‘ই-কৃষি’র প্রবর্তন করা হয়েছে। দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষি কল সেন্টার-১৬১২৩, কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষি তথ্য বাতায়ন, কৃষক বন্ধু ফোন-৩৩৩১, ই-বুক, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, রাইস নলেজ ব্যাংক, কৃষি প্রযুক্তি ভা-ার, ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগকেন্দ্রসহ বিভিন্ন মোবাইল ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে কৃষকদের কাছে স্বল্পমূল্যে ও দ্রুততম সময়ে সার সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশে সারের কোনো সংকট দেখা দেয়নি। দেশের কৃষক ও জনগণের কাছে সার সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। রাজধানীর হাজারীবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ট্যানারি শিল্পসমূকে একটি পরিবেশবান্ধব স্থানে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও সাভার উপজেলাধীন কান্দিবৈলারপুর, চন্দ্রনারায়ণপুর ও চর আলগী মৌজায় ধলেশ্বরী নদীর তীরে ২০০ একর জমিতে পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন শেষ পর্যায়ে। সাভার চামড়া শিল্পনগরীর বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে ১১৫টি ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে। এখানে শিল্প-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল ১০.৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৭-১৮ সালে সেই রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৩০.৬১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকারের বিশেষ উদ্যোগে এখন তৈরি পোশাক কারখানায় নিরাপদ ও কর্মবান্ধব পরিবেশে শ্রমিকরা কাজ করছে। দেশে বর্তমানে ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি’ গড়ে উঠছে। বর্তমান সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন্ধ মিল চালু করা, ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহাল, শ্রমিকদের মজুরি স্কেল ২০১০ বাস্তবায়ন করার ফলে মিলসমূহে শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯-১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আগামী প্রজন্মকে দক্ষ, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উদ্ভাসিত ও আলোকিত নাগরিক এবং সুশিক্ষিত ও আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করেছে সরকার। বর্তমানে ধাপে ধাপে এর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রথমবারের মতো ৯ হাজার ৭০৩ কপি ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হয়। উচ্চ শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ’ এবং ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ’ স্থাপনের আইন গত ১৭ জুলাই ২০১৬ মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়ে বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত। শিক্ষার্থীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’ (১৫ খ-) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। ফলে তাদের আর্থিক সুবিধা, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ বেতন পাচ্ছেন ১০০ শতাংশ।
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল বিশ্বে রোল মডেল। এর স্বীকৃতি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইউএন উইমেন ‘প্লানেট ৫০:৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড-২০১৬’ প্রদান করা হয়। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী শিক্ষার প্রতি অঙ্গীকারের জন্য প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে ইউনেস্কোর ‘পিস ট্রি’ পুরস্কার পান এবং গ্লোবাল ইউমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড-২০১৮ এ ভূষিত হন। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো নারী স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন। পাশাপাশি সংসদ নেতা, উপনেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন নারী মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যদের আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়েছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৩১টি মামলায় ৫৮ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমান সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে কাজ করছে। যে কোনো মুল্যে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ দমন এই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক বিশ্বÑ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বর্তমান সরকারের কর্মকা-কে প্রশংসা করছে। ২০১৩ হতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৯১টি জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ৫৮ জঙ্গি নিহত হয়েছে, ২৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে কোনো প্রয়োজনে পুলিশি সহায়তার জন্য ‘৯৯৯’ সেবা চালু করা হয়েছে। যে কেউ এই নম্বরে কল করে পুলিশের সহায়তা চাইতে পারে।
শেখ হাসিনা তার সুচিন্তিত ও সুদৃঢ় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন এ কথা আজ সর্বাংশে সত্য। তবু কিছু কিছু মানুষ ভুল পথে আছে, তারা এখনো বিশ্বাস করে পাকিস্তানি ভাবধারায়। এই ভুল পথে চলা মানুষগুলোকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। সবার পক্ষে নতুন ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। বাংলার মানুষ বিশ্বাস করে শেখ হাসিনার জন্য কোনো কিছুই আজ অসম্ভব নয়। তিনিই পারবেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়তে। এজন্য শেখ হাসিনার হাতকে আরো শক্তিশালী করা দরকার। দেশীয় ও বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা করে তিনি টিকে থাকতে পারলে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে উন্নত দেশে পরিণত হবে।
১৬ নভেম্বর, ২০২২ লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ