‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/ মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।’ মানুষকে ভালোবাসা এবং মানুষের কল্যাণ সাধনের মধ্যেই নিহীত রয়েছে মানুষের মুক্তি। লালনের ভাষায় যা ‘মানুষ ভজা’।
বিযুক্ত হওয়া নয়, যুক্ত হওয়ায় মানুষের সাধনা-প্রকৃত মনুষ্যত্বের পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের মানুষের ধর্মও এরকম। মানবদেহে রয়েছে অসংখ্য জীবকোষের উপস্থিতি– প্রত্যেকেই যারা পৃথক সত্তা এবং স্বতন্ত্র কাজে ব্যস্ত। কিন্তু সমন্বিতভাবে মানবদেহের পরিপুষ্টি সাধন তাদের লক্ষ্য। সমন্বিত কাজই তৈরি করে সম্পূর্ণ এক মানবসত্তা। এ কারণে প্রত্যেক মানুষ যেমন স্বতন্ত্র এক সত্তা, তেমনি একই সঙ্গে বিশ্বমানব সত্তারও অংশবিশেষ।
মানুষের সাধনা যতটা নিজেকে নিয়ে, ঠিক ততটাই হওয়া উচিৎ অপরকে নিয়েও। কেননা, ‘আমি’কে চেনায় অপর, তার ধর্মই এমন। এটা কেবল মানুষের ক্ষেত্রে নয়, সব প্রাণের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। মানুষ যেহেতু প্রাণের ভরকেন্দ্রে অবস্থিত এবং অন্যকে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী ও জীবনের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে, ফলে তাকে ঘিরেই আবতির্ত হয় জাগতিক পৃথিবীর কল্যাণ, প্রগতি, সভ্যতার অগ্রগতি এবং মানুষের মুক্তি। যা নিশ্চিত করতে পারে শুধু সোনার মানুষেরা। দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা। এরা জীবনের ব্রতে, কর্মের সাধনায়-বুদ্ধিজীবীর দায়ে সংশপ্তকের ভূমিকা জারি রাখা মহোত্তর এক মানুষ।
কে সোনার মানুষ, আর কে সোনার মানুষ নয়, তার প্রমাণ বিশেষভাবে মেলে বিশেষ কিছু মুহূর্তে। দেশ ও জাতির চরম সংকটে এবং সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে। বাঙালির জীবনে সেই সময় এনেছিল ১৯৭১ এর মুক্তির যুদ্ধে এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে। সেসময় রাজনীতিবিদরা তাঁদের লড়াই– সংগ্রামি দিয়ে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করার কাজটি করেছিল বুদ্ধিজীবীরা- বুদ্ধিজীবীদের ধর্ম এটাই। তারা চিন্তা দিয়ে, লেখালেখি দিয়ে, কর্ম দিয়ে মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার শক্তি ও প্রেরণা যোগায়। উনারা শুধু অন্যদের মধ্যে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র রোপণ করে না, অন্যদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে না কেবল; নিজেরাও সেটা ধারণ করে প্রকৃত সোনার মানুষের ভূমিকা পালন করেন। বুদ্ধিজীবীর দায় সম্পন্ন করেন জাতীয়তবাদে ও আন্তর্জাতিকতায় এবং দেশপ্রেমে ও বিশ্বপ্রীতিতে।
১৯৭১ এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে বাঙালির হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন-আকাঙ্ক্ষার ধন ‘স্বাধীনতা’কে মহিমান্বিত করেছে। বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস-ফি বছরের ১৪ ডিসেম্বর সেই গৌরবের দিন এবং বেদনার ক্ষণ। কারণ আমরা এই দিনে হারিয়েছি এ জাতির বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সোনার মানুষদের, যারা এ জাতির মর্মে মর্মে রোপণ করেছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র, মুক্তির স্বপ্ন সাধ। বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যার নীল নকশার শুরুটা হয়েছিল ২৫ মার্চের রাতে। স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে, পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাক হানাদার বাহিনী ১৪ ডিসেম্বরে সেই নীলনকশা বাস্তবায়ন করে রীতিমতো তালিকা ধরে, বাসায় বাসায় গিয়ে অপহরণ ও পরবর্তীতে হত্যার মধ্যে দিয়ে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে বুদ্ধিজীবীর দায় মিটিয়েছেন সোনার মানুষের ভূমিকায়-শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের জীবন-কর্ম-অপ্রকাশিত ডায়েরি-কবিতা ও অন্যান্য লেখালেখি এবং স্বজনদের অবলোকনে, সেটা অনুসন্ধানে এই লেখা। শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসান ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রাত্যাহিক কাজের বাইরে বেশীরভাগ সময় তাঁরা একসঙ্গে কাটিয়েছেন এবং একইভাবে মানবতা প্রগতি এবং দেশপ্রেমে নিজেদেরকে নিবেদেন করেছেন মৃত্যুবধি।
‘অনেক রাতে সুদীপ্ত শুতে গেলেন। মেঝেতে ঢালাও বিছানা। সারি সারি তাঁরা শুয়েছেন। সাতজনের শোয়া সম্ভব। আর তাঁদের একজনকেও তিনি চেনেন না… নব পরিচয়ের সূত্রপাত হয়েছে। পুরনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আজ তা-ই যাই … হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রত্যয়। যে আর কত দূরে। বেশি দূরে হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ কেটে যাবে।’
রাইফেল রোটি আওরাত– এর নায়ক সুদীপ্ত শাহীনের জীবনে সত্যি সত্যি রাতটুকু মাভৈঃ কেটে গেছে। কিন্তু দ্রষ্টা আনোয়ার পাশার জীবনে রাতটুকু কাটেনি। রাত শেষে সূযের আলো ওঠার আগেই একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর তিনি শহীদ হয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের আলোয় উজ্জীবিত স্বদেশে আমরা তাঁর নামের সঙ্গে শহীদের তকমা লাগিয়েছি। ‘শহীদ’- পবিত্র এই শব্দের প্রতি তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে আমরা কতোটা শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছি- সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আনোয়ার পাশা জীবনভর যোদ্ধা ছিলেন। মানবতা, প্রগতি আর দেশপ্রেমের প্রতি তাঁরা ছিলেন জীবনভার উৎসর্গীকৃত এক প্রাণ। মানুষের কল্যাণে এবং শিল্পের সৃজন-সমৃদ্ধিতে তিনি ছিলেন অনন্য এক দৃষ্টান্ত। যার বিরল ব্যতিক্রমী উদাহরণ যুদ্ধদিনে রচিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অমর সাক্ষ্য ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। একাত্তরের যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ে ভূলুণ্ঠিত মানবতার মর্মন্তুদ মুহূর্তেও তাঁর কলম থামেনি। লেখালেখি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতায় হাত বাড়িয়েছেন যোদ্ধার ধর্মে। একাত্তরের দিনগুলোতে, যখন রাজধানী ঢাকা-পশ্চিম পাকিস্তানী হন্তারক ও এদেশীয় দালালদের অভয়ারণ্য তখনও তিনি ভয়কে উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন দেশেপ্রেমের মহানমন্ত্রে।
অন্যদিকে, ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসান ‘আমাদের রাত্রিগুলো’ কবিতায় লিখেছেন : ‘আমাদের রাত্রিগুলো মাছের পেটের মতন/ সারা রাত আমরা সব জান-নূন হয়ে আছি/ আমাদের প্রার্থনার ধ্বনি/ তোমার প্রানে কী পৌঁছাবে?/ আমরা সবাই আজ প্রার্থনার মতো/ আমরা সবাই আজ প্রতীক্ষার বিগলিত মুহূর্তের ধারা/ আমাদের রাত্রিগুলো/ ইস্রাফীলের শিঙ্গা হয়ে ঝরে/ আমাদের রাত্রিগুলো/ ভয়ঙ্কর ঝড়ের মতন/ হলুদ পাতার মতো আমরা সব ঘুরপাক খাই/ আমাদের প্রার্থনার ধ্বনি/ তোমার প্রাণে কি পৌঁছেনি?’
১৯৭১ সালের অপ্রকাশিত ডায়েরির একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে রাশীদুল হাসান লিখেছেন: ‘আটই ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারির নানা তাৎপর্য আজ আবিষ্কৃত এবং এখনো ক্রমাবিস্ক্রিয়মান। প্রথমত এ ছিল বাঙলাদেশের বা পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা বাঙলার রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতির আন্দোলন। পরে এই আন্দোলন বাঙলাদেশের সর্বক্ষেত্রে সর্বাত্মক মুক্তির প্রতীকে উন্নীত হলো।
আমার কাছে এই আন্দোলনের যে চেহারা আজ প্রকাশিত, তার দুটি দিক সব থেকে তাৎপর্যময়। প্রথম, এর সবল ও সপ্রাণ সৃষ্টিশীলতা- সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি ও সমাজনীতির সর্বক্ষেত্রে- একটা সনিষ্ঠ ও বেগবান আত্মজিজ্ঞাসা- এক পবিত্র এ নির্মল আত্মাবিষ্কার। দ্বিতীয়, এর সর্বজনীনতা, ধর্ম বর্ণ সমাজ ও বিশ্বাস নির্বিশেষে এই প্রথম সবার আপন উৎসব বাঙালিরা পেল। ঈদোৎসব যেমন মুসলমানের পূজোৎসব যেমন হিন্দুর, একুশে ফেব্রুয়ারি বা আটই ফাল্গুনোৎসব তেমন নয়,- এ উৎসব বাঙলা ভাষাভাষী হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে সকলের- একান্ত আপনার মহোৎসব।’
মানুষকে ভালবাসা-মানুষের কল্যাণ সাধনে তারা কতোটা নিবেদিত ছিল আনোয়ার পাশার জীবনের একটা ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়। বুদ্ধিজীবীর দায় কেমন হওয়া উচিৎ-তারও একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় । লেখক-কলামিস্ট রণেশ মৈত্র একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, যা সবিশেষ তাৎপর্যময় এবং রাইফেল রোটি আওয়রাতের লেখককে বোঝার জন্য সবিশেষ গুরুত্ববহ। ঘটনাটি ১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিলের। আনোয়ার পাশা তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলার শিক্ষক। ওই দিন রাতে পাবনা শহরের সংঘটিত হয় ভয়াবহ এক দাঙ্গা। আনোয়ার পাশা ওই রাতে পালন করেছিলেন মানবধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সম্মুখসমরে দেশপ্রেমিক একজন যোদ্ধা যেমন দেশের তরে নিজ প্রাণ বিসর্জনে কুণ্ঠিত হন না বিন্দুমাত্র, তিনিও অন্যভাবে তেমন ভূমিকায় পালন করেছিলেন। দাঙ্গার ওই রাতে কলেজের হিন্দু ছাত্ররা ছিল শঙ্কিত এবং প্রাণ হারানোর ভয়ে ভীত ও বিপন্ন। কলেজ অধ্যক্ষের কাছে তারা আবেদন করেছিলেন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, যে কোনো মূল্যে দাঙ্গার হাত থেকে তাদের জীবন রক্ষার জন্য। কিন্তু অধ্যক্ষ মহোদয় শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দেননি-পাশে দাঁড়াননি, কোনো প্রকার খোঁজ খবরও নেননি।
এই অবস্থায় ওই রাতে সংশপ্তকের মতো নিজের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও বিপন্ন-বিপদগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আনোয়ার পাশা। নিজে বাসায় গিয়ে নাইটগার্ডকে ডেকে আনেন এবং ক্লাশরুম খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভেতরে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেন। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে রুটি কলা কিনে নিয়ে এসে রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এবং সারারাত শ্রেণীকক্ষের বাইরে নির্ঘুম রাত কাটান। ওই রাতে দাঙ্গাকারীরা হিন্দু হোস্টেলে আসে এবং শিক্ষার্থীদের না পেয়ে ভাঙচুর করে চলে যান। এই ঘটনার কথা আনোয়ার পাশার কাছের কয়েকজন মানুষ ব্যতীত কেউই জানেন না-কাউকে তিনি বলার প্রয়োজনবোধ করেননি। আত্মপ্রচারণা কিংবা আত্মঅহমিকার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক পিতা-পুত্রের বন্ধনের শাশ্বত এক সম্পর্ক। পুত্ররূপী শিক্ষার্থীদের রক্ষায় দাঙ্গার ওই রাতে তিনি কেবল পিতার ভূমিকা পালন করেছেন, এর বেশি কিছু নয়-আমৃত্যু জারি রেখেছিলেন এ বিশ্বাস।
‘হে আমার দেশ’ নামক একটা কবিতায় রাশীদুল হাসান লিখেছেন: ‘হে আমার দেশ/ আমি তোমার সঙ্গে আছি/ সুখে শোকে অজস্র সংকটে/ যে তোমাকে ছেড়ে যাবে যাক/ আমি যাবো নাকো/ চিরকাল র’বো আমি/ তোমার আত্মার আত্মীয় হয়ে/ তোমার নিঃস্বতা দিয়ে/ তোমার হৃদয়ে আজ/ আমার হৃদয়/ কথা কয়।/হে আমার দেশ/ তুমি আমি আজ/ এমন গভীর কাছাকাছি!!
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের কথা ডায়েরির পাতায় লিখেছিলেন এভাবে: ‘এতো লোক রমনার মাঠে কখনো দেখে নি। পনর লক্ষাধিক হবে। অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক বাঁশের লাঠি হাতে এসেছেন। স্বাধীনতা ও সংগ্রামে শপথ-স্লোগানে মুখরিত সভা। কোথাও পাকিস্তানী পতাকা নেই। স্বাধীন বাঙলার সুন্দর পতাকায় সভা শোভিত। এমন কখনো দেখেনি।!’
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে রাশীদুল হাসানকে। ওই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার কথা বলেন, দেশপ্রেমের কথা বলেন। চিরদিনের শান্ত, সৌম্য মানুষটি হানাদার বাহিনীর কাছেও এই সত্য স্বীকার করেছিলেন। মৃত্যু-শঙ্কা আছে জেনেও তিনি বলেছিলেন, ‘একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি যা বলেছেন, ঠিক বলেছেন। এটাকে তিনি তার কর্তব্য বলে মনে করেন। দেশের এই সংকটে একজন শিক্ষক হিসেবে এটাকে তার অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব বলে মনে করেন।’
এরপর ১২ দিন নাজিমউদ্দিন রোডের জেলখানায় আটক রাখা হয় রাশীদুল হাসানকে। নানা প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়, পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায়-অত্যাচারের সাফাই গাওয়ার জন্য ও তাদের পক্ষে মিথ্যে বিবৃতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেশপ্রেমের প্রশ্নে আপসহীন আর সত্যের পথে অবিচল রাশীদুল হাসানকে দিয়ে এই কাজটি করানো সম্ভব হয়নি। তাকে কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক নানা ফতোয়া দেওয়া হয়। দেশদ্রোহীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় তার নামের সঙ্গে। কিন্তু তার সুললিত কণ্ঠে কোরআন শরিফের সুরা রাহমান-এর পাঠ শুনে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে পাকিস্তানি এক মেজর জেলখানা থেকে ছেড়ে দেন তাকে।
১৯৭১ এর দিনগুলোতে নিজেদের জীবন বাঁচানোই যেখানে দায়, সেখানে কীভাবে রক্ষা করা হয়েছিল রাইফেল রোটি আওরাতের পাণ্ডুলিপি- তা বিস্ময়কর বৈকি। আনোয়ার পাশার স্ত্রী মদিনা খাতুন প্রবন্ধ লেখককে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধের দিনগুলোতে জান বাঁচানোর মতো করেই রাইফেল রোটি আওরাত এর পাণ্ডুলিপি রক্ষা করেছি। বাসা তল্লাশি হতে পারে এই ভয় সবসময়ই ছিল। একারণে সারাক্ষণই কেবলই ভয় হতো , যদি পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে পায়। এ কারণে টয়লেটের ফ্লাশের মধ্যে কাঠ দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছি, কখনোবা আবার আলমারীর পায়ের নীচে পেপার দিয়ে জড়িয়ে রেখেছি। তখন নিজেদের প্রতি যতোটা খেয়াল ছিল, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল পাণ্ডুলিপিটা রক্ষা করার। এভাবে পাণ্ডুলিপিটা রক্ষা করতে পেরেছি ঠিকই। কিন্তু পাণ্ডুলিপির স্রষ্টাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।’
রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার ‘অপরাধে’ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট বিভাগের নির্দেশে তাঁর পাসপোর্ট ছয় বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিল। আনোয়ার পাশার মনে প্রশ্ন ছিল, হিন্দুর দেশ যদি হয় হিন্দুস্তান (ভারত)। মুসলমানের দেশ যদি হয় পাকিস্তান। তাহলে মানুষের দেশ কোনটি? এ কারণে আমৃত্যু তার যুদ্ধ ছিল মানুষের দেশ অন্বেষণ ও বাস্তবায়নে-বাঙালি হওয়ার গৌরব অর্জনে।
আনোয়ার পাশা ও রাশীদুল হাসানকে ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর একসঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে একইসঙ্গে দুইবন্ধুর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। আরও কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে উনাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। বুদ্ধিজীবীর দায় কেমন হওয়া উচিৎ, জাতির সংকটে-দেশপ্রেমের প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীরা রাখতে পারে কতোটা ভূমিকা তার মহোত্তর দৃষ্টান্ত আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা। আনোয়ার পাশা ও রাশীদুল হাসানের জীবন কর্ম লেখালেখি ও ডায়েরির চুম্বকীয় কিছু অংশ থেকে আমরা অনুভব করতে পারি বুদ্ধিজীবীতার প্রশ্নে কতোটা সোনার মানুষ ছিলেন এবং মানুষ ভজা’য় তাঁরা কতোটা উৎসর্গীকৃত প্রাণ ছিলেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পেরিয়ে এসে ৫১ বছর বয়সী বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন কি সঙ্গত নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে সোনার মানুষের সংখ্যা ক্ষীণ হয়ে আসছে-বুদ্ধিজীবীর দায়-দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ নিষ্প্রভ হচ্ছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা উজানে যতোজন, তার চেয়ে অধিক অধিকতর সংখ্যা ঝাঁকের কৈ হয়ে ঝাঁকে মিলে যাচ্ছেন। সুযোগ-সুবিধা, পদক-পদায়ন, বিলাস-বিদেশের হাতছানিতে মত্ত ও মাতোয়ারা হয়ে আছেন, বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় নন।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক