মতামত

চ্যালেঞ্জ ছাপিয়ে মেট্রোরেলের যাত্রা

মেট্রোরেল ব্যবহারে শত থেকে ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা অনেক দেশের। মে তুলনায় নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন শেষে ২৯ ডিসেম্বর ২২ কিলোমিটারেরও বেশি মেট্রোরেল প্রকল্পের ১২ কিলোমিটারে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এই পথে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে থাকছে নয়টি স্টেশন।

প্রথম পর্যায়ে তিনটি স্টেশনে থামবে ট্রেন। তিন মাসের মধ্যে পুরোদমে এই অংশে ট্রেন চলবে। ২০২৫ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে কমলাপুর অংশে ট্রেন চলাচল শুরু হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন সম্ভব। ১৭ স্টেশন পাড়ি দিতে সময় লাগবে প্রায় ৩৮ মিনিট।  

বিশ্বের জনবহুল শহরে বাসকরা নাগরীকদের যাতায়াতে স্বস্তির জন্য মেট্রোরেল জনপ্রিয় গণপরিবহন। অনেক পরে হলেও আমরা সেদিকে যাচ্ছি। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এটাও কম প্রাপ্তি নয়। তাছাড়া মেট্রোর আবেদন তো বিশ্বে শেষ হয়ে যায়নি। বরং দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাই তিন পদ্ধতিতে মেট্রোর দিকে ঝুঁকছে বিভিন্ন দেশ। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানীতে ছয়টি মেট্রো রেল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। 

বিলম্বে হলেও যানজটের শহরে বাসকরা মানুষের চলাচলে স্বস্তির চিন্তা করা হয়েছে। প্রকল্প হাতে নেয়ার পর এখন সমাপ্তির পথে। এজন্য রাষ্ট্রকে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে সরকার সাহস করে কাজটি এগিয়ে নিয়েছে এটা চাট্টিখানি বিষয় নয়। এই প্রকল্পের যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো মেট্রোর যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে আরেকটি সাফল্যের পালক যুক্ত হচ্ছে। তাছাড়া আরেকটু বড় পরিসরে যদি বলি- পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের যাত্রা একই বছরে। এক বছরে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের উদ্বোধন ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে।

প্রশ্ন হলো অনেক আগেই ঢাকাবাসীর মেট্রোরেলে চলাচল করার কথা! কেন হয়নি? ঘোষণা দেয়া হয়েছিল স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের চাকা ঘুরবে। হয়নি। এ বছর হচ্ছে। কিন্তু উদ্বোধনী এলাকার সবকটি স্টেশনের কাজ এখনও শেষ হয়নি। নয়টি স্টেশনের মধ্যে তিনটি স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে। সরকারের প্রতিশ্রুতির কারণে এ অবস্থার মধ্যেই মেট্রো যাত্রা শুরু করছে। 

তবে এটা সত্যি যে, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবুও শেষ পর্যন্ত আশার আলো ফুটে উঠেছে- একে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ সাধারণ মানুষ হিসেবে কাজ এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে জটিলতাগুলো আমাদের কাছে অজানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।   

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে মেট্রোরেল উদ্বোধন হতে যাচ্ছে এটা সবার জন্যই আনন্দের খবর। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের স্টাডি রিপোর্টে প্রথমবারের মতো এমআরটি (ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট) করার প্রস্তাব করা হয়। এরপর জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ২০০৮ সালে এতে যুক্ত হয়। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সরকার ঢাকায় স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) তৈরি করে। এসটিপিতে তিনটি এমআরটি লাইনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই এসটিপির ওপর ভিত্তি করে জাইকা ২০০৮ সালে আরবান ট্রাফিক ফরমুলেশন স্টাডি করে। ওই সময়ে এমআরটি লাইন ৬-কে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১০-১১ অর্থবছরে সমীক্ষা জরিপ চালানো হয়। মূলত ২০০৫ সাল থেকেই মেট্রো নির্মাণের বীজ বপন হয়। দীর্ঘ ১৮ বছর পর যা সফলতার মুখ দেখছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষে ঋণ চুক্তি হয়। ২০১৩ সালে প্রথম ঋণ দেওয়া হয় এবং কনসালটেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়। এরপর শুরু হয় দরপত্র প্রক্রিয়া। কন্ট্রাকটর নিয়োগ শেষে ২০১৬ সালে কনস্ট্রাকশন কাজ শুরু হয়।

পদ্মা সেতুর পর মেট্রোরেল বাংলাদেশের অন্যতম বিরাট অবকাঠামো প্রকল্প এবং এটি সম্পন্ন করা সহজ ছিল না। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল নানা রকমের বিপত্তি। অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল ভূমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন। এ ছাড়া ভালো কন্ট্রাকটর নিয়োগ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা সুবিধার বিষয়টিও ছিল চ্যালেঞ্জের মধ্যে। তবে সবচেয়ে বড় যে দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে সেগুলো হলো হলি আর্টিজান সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা এবং কোভিড-১৯ মহামারি। 

হলি আর্টিজানে নারকীয় জঙ্গি হামলায় নিহত সাত জাপানি নাগরিক মেট্রোরেল নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা মেট্রোরেল প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করা জাইকা প্রতিনিধির বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজানে অন্যান্যের মতো জাপানি নাগরিকরাও খেতে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে দুই জন ছিলেন নারী। তারা মেট্রোরেলের সমীক্ষা কাজের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার যানজট ব্যবস্থাপনা নিয়েও গবেষণা করছিলেন। সেই অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা হলেন, তানাকা হিরোশি, ওগাসাওয়ারা, শাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই ও হাশিমাতো হিদেইকো। হলি আর্টিজানের মর্মান্তিক ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়। স্তম্ভিত হয়ে যায় বাংলাদেশসহ বিশ্ব। আমরা আজ তাদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। 

ঘটনার একদিন পর ৩ জুলাই (২০১৬) জাপানের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শেইজি কিহারার নেতৃত্বে জাপানের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেন। দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। ওই ঘটনার পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেন। তখনও তিনি সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার কথা বলেন।

হলি আর্টিজানে যখন হামলা হয় তখন মাত্র একজন কন্ট্রাকটর চুক্তি সই করেছিলেন। আরেকজন কন্ট্রাকটর নিয়োগের দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান ছিল। এমন বাস্তবতায় অনেক কোম্পানি দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করে। তারা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। এর বড় কারণ ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই বাইরের। হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর সবার মনে ভয় কাজ করে। এটাই স্বাভাবিক ছিল। বিষয়টি সরকারও অনুধাবন করতে পারে। তখন বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় চেষ্টায় সম্ভাব্য কন্ট্রাকটররা নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে আশ্বস্ত হন। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। যেমন অফিসের চারপাশে নিরাপত্তা দেয়াল তৈরি করা এবং নিরাপত্তা সেবা দেওয়ার জন্য কোম্পানি নিয়োগ দেওয়া হয়।

এ প্রকল্পে জাপানের পাঁচটি বিখ্যাত কোম্পানি যুক্ত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে কাওয়াসাকি, নিপ্পন, তোশিবা, মারুবেনি ও মিতসুবিসি। এরম ধ্যে কাওয়াসাকি, নিপ্পন ও তোশিবা মেট্রোরেল প্রকল্পের বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরির সঙ্গে জড়িত। তাছাড়া কোভিডের সময় কয়েক মাস কন্সট্রাকশন কাজ স্থগিত ছিল। ওই সময়ে লকডাউন ছিল এবং কন্ট্রাকটররা কাজ করতে পারছিলেন না। ওই সময়ে সরকার বেশ কিছু নিয়ম চালু করে। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা ইত্যাদি। এর ফলে কন্ট্রাকটররা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় এবং কাজ শুরু করে। 

মূলত মেট্রোরেল শুধু একটি প্রকল্প নয়। এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে। এই প্রকল্প মানুষের চলাচলকে মসৃণ ও সহজ করার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে বড় আকারে অবদান রাখার জন্য বিভিন্নমুখী পরিকল্পনা রয়েছে। 

এখানেই শেষ নয়, মেট্রো স্টেশনের সঙ্গে বাস বা অন্যান্য পরিবহনের সংযোগের বিষয়টিও ছিল অনেক চ্যালেঞ্জের। কারণ স্বল্প দূরত্বের জন্য বেসরকারী বাস মালিকরা সেবা দিতে সম্মত হবেন না এটাই স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত ট্রানজিট বিষয়ক উন্নয়নে বাস, প্রাইভেটকার, এমনকি রিকশাও স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চিত করে পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এ ছাড়া স্টেশনকে কেন্দ্র করে টাউনশিপ তৈরি নিশ্চিত হয়েছে। 

দিল্লি মেট্রোর ওপর অনেকগুলো জরিপ চালানো হয়েছে এবং দেখা গেছে নারীরা মনে করেন দিল্লি মেট্রো হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। দিল্লি মেট্রো তৈরির ক্ষেত্রেও সহায়তা করেছিল জাইকা। সেখানে প্রায় ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে আসছে সংস্থাটি। ঢাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। 

শুরুর দিকে মেট্রোরেল প্রকল্পের অর্থায়ন নিশ্চিত করা ছিল সরকারের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। ২০১২ সালে প্রকল্প নেয়ার পর জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি হয় পরের বছর। প্রথমে ব্যয় ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। পথ সম্প্রসারণ, স্টেশন প্লাজা নির্মাণ, নতুন করে জমি অধিগ্রহণ, পরামর্শক ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটিতে। এর মধ্যে জাইকা ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে। সরকারের খরচ হচ্ছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ নভেম্বর পর্যন্ত মেট্রো-৬ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৪  শতাংশের কিছু বেশি। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। মেট্রোরেল পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম বড় মেট্রোপলিটন শহর হতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মেট্রোরেলের মধ্য দিয়ে এ শহরে এক ধরনের রূপান্তর ঘটবে। সম্ভাব্য নির্মাণে রাজধানীতে তিনটি লাইনের মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১০০ কিলোমিটার। সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মেট্রোরেল নাগরীক জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসুক এটাই চাওয়া। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক