মতামত

রাষ্ট্র আর সরকারকে গুলিয়ে ফেলবেন না

চলমান বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয় নিয়ে আমি সবসময় লেখালেখি করি। কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, কখনো গণমাধ্যমে সে লেখা প্রকাশিত হয়। লিখে আমি আনন্দ পাই এবং লিখতে আমার কোনো ক্লান্তি নেই। আমি মোবাইলে লিখি, বাসায় লিখি, গাড়িতে লিখি, এমনকি বিমানে বসে লিখতেও অসুবিধা নেই। ভরা নিউজরুমে, তুমুল আড্ডায় বসেও আমি লিখতে পারি। আমি যা লিখি, তা গোপন কিছু নয়। লেখা শেষ হওয়ার পর তা কোথাও না কোথাও প্রকাশিত হয়। কিন্তু কেউ আমার ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলে বা আড়চোখে কেউ দেখলেও আমি লিখতে পারি না। যদি বুঝি কেউ আমার ওপর নজর রাখছে, আমার খুব অস্বস্তি হয়। নিজেকে কেমন বন্দী বন্দী লাগে। 

বাংলাদেশের সংবিধানে শর্তসাপেক্ষে মানুষের সংগঠন করার, চলাফেরার, সমবেত হওয়ার অধিকার, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানে এসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে’। তার মানে আসলে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা বলে কোথাও কিছু নেই। একটা সভ্য রাষ্ট্রে সেটা থাকার সুযোগও নেই। 

আমার কাছে মানুষের বলতে পারাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সংবিধানে যেমন বলা হয়েছে, আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। আমি চাইলেই ধর্ম নিয়ে উস্কানিমূলক কিছু বলতে বা লিখতে পারবো না, এমনকি সেটা সত্য হলেও না। সবসময় সব সত্যও প্রকাশযোগ্য নয়। রাষ্ট্রে বা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, এমন সত্য প্রকাশ করার স্বাধীনতা কারোরই নেই। বাংলাদেশের আইনে আড়ি পেতে শোনা বা আড় চোখে অন্যের লেখা দেখার কোনো আইন নেই। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মানুষের সবচেয়ে বড় অধিকার। আইনের আওতায় থেকে, অন্য কাউকে বিরক্ত না করে; যা কিছু করার, বলার স্বাধীনতা আমার আছে। কিন্তু আমরা টের পাই, কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ আমাদের ওপর নজর রাখছে। এটা খুবই অস্বস্তিকর। 

নজর যে রাখছে, সেটা টের পাই, যখন হুটহাট বিভিন্ন ব্যক্তির ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, এমনকি মন্ত্রিসভার সদস্যরাও এই নজরদারির বাইরে নয়। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের মন্ত্রিত্ব গেছে একটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পরই। ছেলেবেলায় শোনা ‘দেয়ালের কান আছে’ কথাটির সত্যতা এখন আমরা হারে হারে টের পাচ্ছি।

ফোনে বা ই-মেইলে কেউ না কেউ আড়ি পাতছে, এটা টের পেলেও এর আইনী ভিত্তি তো দূরের কথা কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও ছিল না। এরই মধ্যে উল্লেখ্য, ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ সম্প্রতি প্রতিবেদনে বলেছে, দেশটির সাবেক এক গোয়েন্দা কমান্ডার পরিচালিত কোম্পানি থেকে নজরদারির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ সরকার। গত বছরের জুনে বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি আনা হয়। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ যে সরঞ্জাম কিনেছে, তা মুঠোফোন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগের ওপর নজরদারিতে ব্যবহৃত হয়।

যেখানে আড়ি পাতার কোনো সুযোগ নেই, সেখানে নজরদারির সরঞ্জাম কেন কিনতে হচ্ছে- এই প্রশ্নটা ঘুরছিল সবার মনেই। তবে উত্তর পাবো কোথায়? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ তিনি এই প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিয়েছেন উদ্দেশ্য ও কারণসহ। গত বৃহস্পতিবার সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে আইনসম্মতভাবে আড়ি পাতার ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।‘

তিনি বলেছেন, ‘ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির (ওএসআইএনটি) মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। একই সঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইনসম্মতভাবে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগে আড়ি পাতার ব্যবস্থা) চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ 

সরকারি দলের সংসদ সদস্য শফিউল ইসলামের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জবাবটি টেবিলে উত্থাপিত হয়। তাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করে দেশের অগ্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখতে দৃঢ় অবস্থান ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।‘

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটা কারণে ধন্যবাদ পাবেন। তার বক্তব্যে ধারণা করা অমূলক হবে না, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র রুখতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, তাতে আড়ি পাতার ঘটনাও ঘটছে। আরো ধন্যবাদ পাবেন, ভবিষ্যতে যে সরকার মুঠোফোন ও ইন্টারনেটে আড়ি পাতার বিষয়টি আরো বিস্তৃত করতে যাচ্ছে এ কারণে। তবে ‘আইনসম্মতভাবে আড়ি পাতার’ দাবিটি পরিষ্কার নয়। আড়ি পাতার ধারণাটাই বেআইনী। সরকার একটি আইন প্রণয়ন করলেই সেটা আইনসম্মত হয়ে যাবে না।

এটা ঠিক, বর্তমানে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তৃতি নিরাপত্তা ইস্যুতে সরকারের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেমনটি বলছেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখতে’ সরকারকে প্রচলিত আইনী প্রক্রিয়ার বাইরেও নানা পদক্ষেপ নিতে হয়। সমস্যাটা হয় তখনই, যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্র আর সরকারের মধ্যে পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেন। আমাদের শঙ্কাটাও সেখানেই। রাষ্ট্র বিরোধিতা অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু সরকারের বিরোধিতা করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার বিরোধিতাকেই রাষ্ট্র বিরোধিতা হিসেবে বিবেচনার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই যখন সংসদে রাষ্ট্র আর সরকারি বিরোধীতাকে এক পাল্লায় মাপলেন, তখন সাধারণ মানুষের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ঘটেছে। চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়ে আছে, দই দেখলেও আমরা এখন ভয় পাই। অন্তর্জাল জগতে শৃঙ্খলা আনার কথা বলে প্রণীত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ এখন সরকার বিরোধীদের শায়েস্তা করার প্রধান হাতিয়ার। আড়ি পাতার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগও যে সরকার বিরোধীদের শায়েস্তা করার কাজেই বেশি ব্যবহৃত হবে, তা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। মোবাইল আর ইন্টারনেটে আড়ি পাতার যন্ত্র তবু আবিষ্কৃত হয়েছে, ভাগ্যিস মানুষের চিন্তায় হানা দেয়ার কোনো প্রযুক্তি এখনও বের হয়নি। ‘আইনসম্মতভাবে’ আড়ি পাতার কথা শুনে আমি নিজেকেই বলছি- সাবধান, দেয়ালেরও কান আছে।

১৭ জানুয়ারি, ২০২৩