ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা এক তিলোত্তমা নগরী। কালের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। প্রত্যক্ষভাবে এ শহর আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার মূল ভিত্তি। এছাড়া, ঢাকা শহরে দিনব্যাপী যে আর্থিক লেনদেন হয় তার একটি বড় অংশ দিনশেষে মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকার বাইরে চলে যায়। সে বিবেচনায় পরোক্ষভাবেও এ শহর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। এ শহরের বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো একসঙ্গে লিখতে গেলে কী দিয়ে শুরু করবো সেটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ট্রাফিক ব্যবস্থার কারণে আমরা সবাই অতিষ্ঠ। গবেষণা বলছে, কর্মজীবী মানুষ দৈনিক ২.৩৫ ঘণ্টা রাস্তায় থাকেন যার মধ্যে ১.২৫ ঘণ্টাই ট্রাফিক জ্যামের কারণে। যার যে বাহনই থাকুক না কেন সবাই একই গতিতে যাচ্ছেন। চার চাকার সেডানের সামনে রিকশা থাকলে সবার গতি আসলে রিকশার গতির সমান হয়ে যায়। সমাজে সমতা আনয়নের এর চেয়ে আর সুন্দর কী উদাহরণ হতে পারে? তবে এর মাঝে সবচেয়ে ব্যস্ত হলেন মোটরবাইক চালকগণ। পথচারীর ফুটপাথে লোহার ব্যরিকেড দিয়েও তাদের আটকানো যাচ্ছে না! এছাড়া, ট্রাফিক সিস্টেমে ডান-বাম বলে কিছু নেই। সোজা যাওয়া শুরু হলেই কেবল আপনি ডান বা বামে যেতে পারবেন। এর মাঝে কেউ একজন তার গাড়ির শুধু সামনের অংশ ঢুকিয়ে দিলে আর কারও যাওয়ার সাধ্য নাই। ট্রাফিক জ্যামে বসে থেকে যে সময় আর জ্বালানি নষ্ট হয় তার অর্থনৈতিক মূল্য অনেক।
জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা অনেক সামনের দিকে। এর দুটি কারণ রয়েছে; এক. প্রতি বছর নতুন শিক্ষার্থী যারা এ মায়াবী শহরে আসেন তাদের খুব কম সংখ্যকই শহরের মায়া ত্যাগ করতে পারেন। দুই. নতুন কাজ পাওয়ার তাগিদে যারা আসেন তারাও কিছু না কিছু করে স্থায়ী হয়ে যেতে চান। এছাড়া, একদল মৌসুমী লোক রয়েছেন যারা বিভিন্ন সময়ে এসে থাকেন আবার চলেও যান। এদের একাংশ ভিক্ষুক, যারা দুই ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকায় আসেন। নিয়মিত ভিক্ষুকদের একটা বড় অংশকে মূলত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের আশেপাশে বেশি দেখা যায়। হয়তো প্রিয়জনের অসুস্থতাকে পুঁজি করে মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেরা বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে নেন।
ভাংতি টাকা নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার বাহাস নতুন কিছু নয়। বিক্রেতাগণ তার বিগত অভিজ্ঞতার আলোকে নিশ্চয়ই জানেন তার প্রতিদিন কত টাকার ভাংতি লাগবে। কিন্তু কখনই ভাংতি সমস্যার সমাধান হয় না! পৃথিবীজুড়ে ব্রান্ডিং এর গুরুত্ব অনেক। ঢাকা শহরে দুটি চমৎকার উদাহরণ আছে। মিরপুর ১০ নম্বর অনেক দিক থেকেই প্রসিদ্ধ। একে কেন্দ্র করেই অরিজিনাল ১০ নম্বর, ১১ নম্বর বা সাড়ে ১১ নম্বর গড়ে উঠেছে। ব্রান্ডিং এর কারণেই ‘অরিজনাল ১০’ কিংবা ‘সাড়ে ১১’ নামকরণ হয়েছে। ঢাকার আরেক বিখ্যাত স্থান হলো ধানমন্ডি। তাই এর আশেপাশের এলাকার মানুষ এ নামেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেটা ভূতের গলি (ইংরেজ আমলে মিস্টার বুথ নামের প্রথম বাসিন্দার নামানুসারে নামকরণ হয়েছিল ‘বুথের গলি’), কলাবাগান কিংবা গ্রিন রোড হোক- সবাই ধানমন্ডি নামেই পরিচয় দিতে চান!
ইদানিং মোবাইলে গেইম খেলার যে প্রচলন শুরু হয়েছে তা একরকমের মহামারি। ঢাকা শহরে সান্ধ্যকালীন বেকার কিংবা কাজ শেষ করে বিশ্রাম নিতে যাওয়া লোকজন মোবাইল গেইমিং নিয়ে ব্যস্ত। আপনার মোবাইলে আপনি যা খুশি করেন আপত্তি নাই, কিন্তু অর্থনীতিতে কোনো উপযোগিতা যোগ করা ছাড়াই আপনাকে মোবাইল চার্জ দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হচ্ছে। এসব হিসাব আপাত দৃষ্টিতে খুব অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদে এর ভূমিকা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হবে আমরা একটি অলস জাতি হিসেবে গড়ে উঠলে। মোবাইলে লুডু খেলে কার্যত দেশ ও নিজের তেমন কোনো লাভ হবে না।
পরিষ্কার থাকার হিসাব আসলে আমাদের মার্কস অনেক কম হবে। এর সঙ্গে দুটি বিষয় আলাদা করে যোগ করতে চাই। প্রথমত, ছোটবেলায় অনুচ্ছেদ লিখতে গিয়ে শিখেছিলাম কাক ময়লা, বর্জ্য খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখে। আসলে ঘটনা হলো উল্টা। কাক ময়লা-আবর্জনা খেতে গিয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে দেয় যা পরিবেশ নষ্ট করে। যে শহরে কাকের সংখ্যা বেশি সে শহর তত অপরিষ্কার। দ্বিতীয়ত, যারা বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ করেন তারাও একই কাজ করে থাকেন। বর্জ্য থেকে রি-সাইকেল উপযোগী দ্রবাদি সংগ্রহ করে আশেপাশের পরিবেশ নষ্ট করেন। যদিও রি-সাইকেলের এ অর্থনীতিও বেশ বড় বলেই মনে হয়।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা যেহেতু জরুরি সেহেতু ফরমালিন ও কীটনাশক ব্যবহার নিয়ে ভোক্তার অনেক আপত্তি। আর তাই নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য অনেকে নতুন তত্ত্ব তৈরি করেছেন। যে মাছের উপর মাছি বসে থাকে সেখানে নাকি ফরমালিন কম দেওয়া হয়। কিংবা যে বেগুনে পোকা থাকে সে বেগুনে নাকি কীটনাশক কম প্রয়োগ করা হয়। এ সংক্রান্ত কোনো গবেষণা হয়েছে বলে জানা নাই, তবে বেঁচে থাকার আনন্দকে উপভোগ করতে হলে এসব তত্ত্ব কাজে দিতেও পারে!
বিক্রেতাগণ সবাই তার ক্রেতাদের খুশি করতে চান। দারুণ উদাহরণ রয়েছে। ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকা এ্যাম্বুলেন্সটি যেতে পারবে না জেনেও সাইরেন বাজাতে থাকে। উদ্দেশ্য রোগীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার পর বাড়তি বকশিশ আদায়। সিটিং সার্ভিসের উপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়ায় ‘খোদার কসম সিটিং সার্ভিসও’ দেখা যায়। উদ্দেশ্য ক্রেতার সন্তুষ্টি। অনেকে আবার একে ধোকাবাজি বলেও চিহ্নিত করেন। প্রায় সকল আয়ের মানুষের জন্য ঢাকা এক অনন্য শহর। এ শহরের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সকল আয়ের মানুষের জন্য খাবার সরবরাহ করা। আপনি কম আয়ের পেশাজীবী হলে খুব অল্প দামেও খাবার খেতে পারবেন। একবেলা খাবারের দাম যেমন ৫ হাজার টাকা হতে পারে তেমনি শুধু ৫০ টাকা খরচ করেও উদরপূর্তি করা যাবে; খাবারের মানের পার্থক্য থাকলেও।
দাম নির্ধারণে আপনি কোন জায়গা থেকে পণ্যটি কিনছেন সেটিই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। একই পণ্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। তবে এটিও সত্য, যারা কারওয়ান বাজার থেকে কিনেন আর যারা ডিপারট্মেন্টাল শপ থেকে কিনেন তাদের সামাজিক দূরত্বও আলাদা। এরকমও দেখা যায়, ঢাকা শহরে বিভিন্ন এলাকার মানুষের পোশাক-পরিচ্ছেদও আলাদা!
ফুটপাথে প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। যদিও ফুটপাথের পণ্যের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে ফুটপাথে যারা কম মানের পণ্য বিক্রি করেন তারা মূলত অন্ধকার বা ঝাপসা আলো কিংবা চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় এমন আলো ব্যবহার করেন। মজার বিষয় হচ্ছে, ফুটপাথে বিভিন্ন রোগের ডাক্তারও পাওয়া যায়! তবে কিছু কিছু পণ্যের জন্য ফুটপাথই বিখ্যাত। যেমন, ফুচকা, চটপটি বা শীতকালীন ভাপা পিঠা, ইত্যাদি। এছাড়া, চামচের বিকল্প হিসেবে ‘বিজনেস কার্ড’ কিংবা টিস্যুর বিকল্প হিসেবে ‘পত্রিকা বা পূর্বে ব্যবহৃত অন্য কাগজ’ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফুটপাথের পণ্যের অনেক রকমফের এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকলেও এসব পণ্যের কোনো পেটেন্ট নাই। ফুটপাথকে কেন্দ্র করে চাহিদা-যোগানের ভারসাম্যভিত্তিক এক দারুণ বাজার গড়ে উঠেছে।
তবে আশার বিষয় হচ্ছে, ঢাকাসহ আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি এক বিশাল বাজার যেখানে ভোক্তার মোট চাহিদার পরিমাণ যে কোনো সংকট কাটিয়ে উঠতে আশাবাদী করে। শুধু অনুমান করে বলা যায়, ঢাকা শহরে একদিনে যে টাকার বাদাম, ছোলা, পেয়ারা, আমড়া কিংবা সিঙ্গারা বিক্রি হয় তার পরিমাণ অনেক। আর চূড়ান্ত পণ্য হিসেবে সিঙ্গারার প্রস্তুতি (তেল, ময়দা, পেঁয়াজ, আলু, জ্বালানি, ইত্যাদি) ও বিক্রির নেপথ্যে অনেক বড় বাজার রয়েছে।
ধ্রুপদি ধারার অর্থনীতিবিদগণ বিখ্যাত সেইস ল (Say’s Law)-তে বিশ্বাস করতেন। Say’s Law অনুসারে, আমাকে যদি ভাত খেতে হয় তবে নিশ্চয়ই বাজারে কিছু পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে হবে। আর এভাবেই অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদা তার সমপরিমাণ যোগান তৈরি করে। ফলস্বরূপ ধ্রুপদি ধারার অর্থনীতিবিদগণ বিশ্বাস করতেন অর্থনীতিতে কোনো মন্দা সৃষ্টি হবে না। মন্দার সার্বিক অবস্থা বুঝতে হলে শুধু সামগ্রিক চাহিদার দিকে তাকালেই আন্দাজ করা যায়। ঢাকা শহরে অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদার ঘাটতি নেই বলেলেই চলে। তাই Say’s Law এর প্রতিফলনে বলা যায় এ শহরের অর্থনীতি কখনোই থেমে যাবে না। বিগত করোনার সময়ে দেশের অর্থনীতিতে এ ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে।
আশার আরও একটি বিষয় রয়েছে। সরকার ঢাকা শহরকে আরও গতিশীল করতে অনেক বিনিয়োগ করছে। ফলে ‘পাবলিক গুডস’ এর সংখ্যা ও গুণগত মান বাড়ছে; যা আগামী দিনে ঢাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক রাস্তা নির্মাণ শহরের আধুনিকায়নে ভূমিকা রাখবে। একটি উন্নত শহরের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ রাস্তা হিসেবে থাকা আবশ্যক। ঢাকা শহরে যা ৯ শতাংশের মতো। তাই মেট্রোরেল বিভিন্ন এলেভেটেড বা এক্সপ্রেস-ওয়ে নিশ্চয়ই শহরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনবে। ঢাকাকে ঘিরে আশাবাদী হতে আপত্তি কোথায়?
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক