আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে একটির পর একটি ঘটনা ঘটেই চলছে। এর যেন অন্ত নেই। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কি চলছে সেটি শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের অজানা নয়। পত্রিকার কল্যাণে দেশবাসী; বিশেষ করে অভিভাবকদের তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এর সমাধান মিলছে না।
তবে, কথার পিঠে কথা আছে, যুক্তির বিপরীতে যুক্তি আছে; কু-যুক্তিও কম নেই। সুবিধা হয়েছে শিক্ষা নিয়ে যেহেতু অনেকেরই সে রকম চিন্তার কিছু নেই, শুধু নিজে বা নিজের কেউ যখন আক্রান্ত হয় তখন একটু অনুভূতি প্রকাশিত হয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ঘটে চলেছে কেউ কিছু মনেই করছে না! বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই যেহেতু আই ওয়াশ ছাড়া কিছু হচ্ছে না ফলে প্রাথমিকেই বা হতে যাবে কেন?
২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এ ফল প্রকাশিত হয়। ফল প্রকাশের চার ঘণ্টা পর সেটি স্থগিত করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে ই-মেইল পাঠানো হয়। পিরোজপুরের এক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় উপস্থিতই হয়নি অথচ সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। আরও একজনের কথা এসেছে- যে পরীক্ষা না দিয়েই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে- এ কেমন খেলা!
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, কোডিং এর সমস্যা হওয়ার কারণে প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল স্থগিত করা হয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ বিভাগ) জানিয়েছেন যে, ফল সমস্যা হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমরা সব কিছুই দ্রুত করতে চাই। ফলে ভুলের আশঙ্কা থেকেই যায়।
তিনি আরও বলেন, বৃত্তি পরীক্ষার ফলে পরিবর্তন আসবে। পরীক্ষার ফলে কোডিং সংক্রান্ত সমস্যা হয়েছিল। সেটি সমাধানের কাজ চলছে। এটি খুব ছোট সমস্যা।
এটি কোনভাবেই ছোট সমস্যা নয়। তারা মনে করেন, এটি শিশুদের বিষয়, অতএব এটি একটি ছোট সমস্যা। একটি শিশু যখন জেনে গেছে যে, সে বৃত্তি পেয়েছে, পরবর্তী সময়ে আবার যখন জানবে সে পায়নি, তখন তার মানসিক অবস্থা কি হবে? এটি তো খেলা নয় যে, চাল দিয়েছি ভুল হয়েছে। থুক্কু বলে আবার নতুন চাল দিচ্ছি। পরীক্ষার ফল পরিবর্তনে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর যা কেউ ভেবে দেখছেন না। উল্টো বলছেন- সামান্য একটু ভুল হয়েছে!
দেশের শিক্ষাবিদগণ বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন কিন্তু পরীক্ষা ঠিকই হয়েছে, এবং তাড়াহুড়ো করে হয়েছে। একবার একটি তারিখ দিয়ে পরবর্তীতে দ্রুত তারিখ পরিবর্তন করে পরীক্ষা নেওয়া হয়। ফল প্রকাশ করা হলো অবার তা প্রত্যাহারও করা হলো, যেন বিষয়টি তেমন কিছুই না, নিছক বাচ্চাদের কুতকুত খেলা।
২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৩৮৩জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। তাদের মধ্যে মেধা কোটায় বৃত্তি পেয়েছে ৩৩ হাজার এবং সাধারণ কোটায় ৪৯ হাজার ৩৮৩জন। এতে একেকটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতিটিতে ২৫ নম্বর করে মোট ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে এই পরীক্ষা হয়। করোনার পাশাপাশি গত জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়টি মাথায় রেখে গত তিন বছর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। আগামী দিনগুলোতেও এই পরীক্ষা হবে না বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এরই মধ্যে হঠাৎ করে জানা গেল যে, ২৮ নভেম্বরের এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়। সকল শিক্ষার্থী এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। বিদ্যালয়ের বাছাই করা ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। প্রতিটি উপজেলা সদরে হবে এ পরীক্ষা এবং দশ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রতি বিদ্যালয় থেকে ধরে ৬ ডিসেম্বর ২০২২ এর মধ্যে তথ্য পাঠাতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পঞ্চম শ্রেণি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা রাখা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারা কারা সরকারি বৃত্তি পাবে তা নির্ধারণে এক সময় আলাদাভাবে এই পরীক্ষা নেওয়া হতো যা বৃত্তি পরীক্ষা নামে পরিচিত ছিল। ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর আলাদা বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর ফলের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই আবার বলা হয়- বৃত্তি পরীক্ষা হবে এবং শ্রেণিকক্ষ ও বার্ষিক মূল্যায়ন পরীক্ষার ভিত্তিতে মেধা যাচাইয়ে এগিয়ে থাকা দশ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। মূলত প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে তাদের মেধার মূল্যায়নের জন্যই বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এটি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে মেধাবৃত্তি দেওয়ার বিকল্প মেধা যাচাই পদ্ধতি। কিন্তু যারা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারল না তারা কি সেই আগের মতোই মনে করবে যে- তারা পিছিয়ে পড়া, তাদের দ্বারা কিছু হবে না?
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সব ধরনের পরীক্ষা বন্ধ করে শ্রেণি মূল্যায়নের ভিত্তিতে ফল নির্ধারণের চিন্তা করার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাবিদ মত ব্যক্ত করে আসছেন। তারই বিপরীতে দেখা যায় হঠাৎ করে বৃত্তি পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত যেটি অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। ২০২০ সালে যে শিক্ষাথী তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল, অটোপাস করে সে ২০২২ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে, তাকে যখন পরীক্ষা দিতে বলা হয়েছে তার মানসিক অবস্থা নিশ্চয়ই খুব একটা ভাল ছিল না। তাছাড়া একটি বিষয়ে ২৫ নম্বরের পরীক্ষা নিয়ে তাদেরকে মেধাবী বলে তাদের গায়ে আলাদা তকমা লাগানোর কোন প্রয়োজন ছিল কি?
কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি বোঝা না চাপিয়ে বিগত দুই বছরের শিক্ষা ঘাটতি কীভাবে ধীরে ধীরে দূর করা যায় সে নিয়ে চিন্তা করাই এখন মূল বিষয় হওয়া উচিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে উপবৃত্তি দেওয়া হয়, তার পরিমাণ বাড়ালে অনেক বেশি শিক্ষার্থী উপকৃত হতো, শিক্ষায় বিভক্তি কমে কিছুটা সমবন্টন হতো।
শিক্ষার এত সব কেলেঙ্কারি, ঘটনা ও দুর্ঘটনা আমরা জানি তো একমাত্র সংবাদপত্রে। এ ছাড়া তো আমাদের জানার কোন উপায় নেই। পত্রিকায় দেখলাম কোডিং সংক্রান্ত ভুলের কারণে নাকি এক উপজেলার সঙ্গে আরেক উপজেলার বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী বছাই বিঘ্নিত হয়েছে বলে সিস্টেম এনালিস্ট জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, অল্প কিছু ভুল হয়েছে। এখন সংশোধনের কাজ চলছে। অথচ ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল জানানে হলো, আবার তা বাতিল করা হলো। অবার বলা হলো তেমন কিছু হয়নি, সামান্য একটু কোডিং সমস্যা হয়েছে।
নতুন কারিকুলামের ওপর ভিত্তি করে যে বইগুলো ছাপা হলো সেখানেও একই কথা বলা হচ্ছিল। বর্তমানে কয়কটি বই তুলেই নেওয়া হলো। শিক্ষার্থীদের কি হবে, শিক্ষকগণ কি করবেন ঐসব বিষয়ে, বিদ্যালয়ের কি হবে, কবে বই পাওয়া যাবে তার কোনো সদুত্তর কারো কাছে নেই। সেই সমস্যা শেষ হতে না হতেই আবার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল আলোচনার জন্ম দিলো। এসব দেখে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- কি চলছে অসালে শিক্ষাক্ষেত্রে?
সর্বশেষ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হয় ২০১৯ সালে। ওই ফলাফলের ভিত্তিতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বৃত্তির জন্য নির্বাচত ৮০হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর তালিকা প্রকাশ করা হয়। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্তরা মাসে ৩০০ টাকা এবং সাধারন বৃত্তিপ্রাপ্তরা মাসে ২২৫টাকা করে পায়। প্রাথমিক সমাপনীর বৃত্তিপ্রাপ্তরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই বৃত্তি পায়। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শিক্ষার্থীর মনোজগত তৈরিতে সবচাইতে বেশি ভূমিকা রাখে। এজন্য শিশুদের চাপমুক্ত পরিবেশে শিক্ষা দান করাকে গুরুত্ব দেওয় উচিত। মানসিক বিকাশের পর্যায়ক্রমিক ধারায় প্রতিযোগিতামূলক বা মেধাভিত্তিক মূল্যায়নের বিভিন্ন অনুষঙ্গের সাথে সে পরিচিত হবে। আমাদের দেশে যেভাবে শিশু শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে বসিয়ে দেওয়া হয় তা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে কতটা কার্যকরী তার কোন প্রকৃত গবেষণা নেই।
মেধার বিকাশের সাথে অর্থনৈতিক সাম্যবস্থার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বিত্তবান পরিবারের সন্তান যে পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করে দরিদ্র পরিবারের সন্তানের জন্য তা চিন্তার বাইরে। এই উভয় শ্রেণির মেধার বিকাশ সমানভাবে হতে পারে না। এই জায়গায় আগে কাজ শুরু করা উচিত কারণ মেধা আবিষ্কারের সঠিক পদ্ধতি তো এখনও আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। আমরা শুধু দেখছি একজন শিক্ষার্থী গণিতে কত নম্বর পেল, ইংরেজিতে কত পেল সেটি দেখে আমরা তাকে মেধাবী বলছি। অথচ সে আলাদা কোচিং করে, কিছু বিষয় মুখস্থ করে, বারবার শিক্ষকের কাছে অর্থের বিনিময়ে প্রাকটিস করে পরীক্ষার খাতায় লিখে এসেছে, ভালো নম্বর পেয়েছে, তাকে আমরা মেধাবী শিক্ষার্থী বলছি। আর বাকী যারা অর্থের অভাবে, পরিবেশের অভাবে এগুলো দেখাতে পারেনি তারা কি মেধাহীন? এ জায়গায় অনেক কাজ করার আছে। শুধু কম্পিটেন্সি বেজড কারিকুলাম চালু করে বলা যাবে না যে সব সমস্যার সমাধান এখানেই রয়েছে। গোটা শিক্ষা প্রশাসনেই চলছে সমস্যা। যার আরেকটি খারাপ উদাহরণ এবারের বৃত্তির ফলে গোলমাল। এর আসলে প্রকৃত সমাধান প্রয়োজন।