কয়েকদিন আগে থাইল্যান্ড বেড়াতে গিয়ে ইমিগ্রেশনে বিপত্তিতে পড়েছিলাম। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের একটিই প্রশ্ন কেন আমার নাম শুধু ‘জেবউননেছা’? আমি বার বার বলছি যে আমার নাম একটাই। তারা মানতে নারাজ। এরপর অনেক অনুরোধ করে ইমিগ্রেশন পার হই।
হোটেলে ফিরে ভাবছিলাম। এই প্রশ্নের সম্মুখীন শুধু এবারই প্রথম নয়। মাঝে মাঝেই আমাকে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তখন বলতে হয় যে, আমার দাদি আমার নাম রেখেছিলেন। তিনি নামের আগে পরে কিছু দেননি। কেন আমার দাদি আমার নামের সাথে খাতুন, বেগম অথবা আমার বাবার নাম যুক্ত করলেন না। তারও একটি কারণ আছে । কারণ আমার দাদির নামের সাথেও কোনো নাম যুক্ত ছিলো না। দাদির বাবা ছিলেন নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী একজন মানুষ এবং শিক্ষানুরাগী। তিনি ছিলেন ঢাকার বেগমবাজারের মেয়ে। লেখাপড়া করেছেন আনোয়ারা বেগম মুসলিম গার্লস কলেজে।
জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কন্যা ছিলেন দাদির সহপাঠী। আমার জন্মের পরের দিন আমার বাবা দাদিকে বলেছিলেন আদ্যক্ষর ‘জ’ দিয়ে আমার নাম রাখতে। কারণ আমার বাবার নামের আদ্যক্ষর ‘জ’ দিয়ে। দাদি আমার বাবার দিনলিপিতে নিজ হাতে লিখেছিলেন ‘জেবউননেছা’। এখনো সেই দিনলিপিটি সংরক্ষিত আছে। তবে এর আর একটি কারণ ও ছিলো, কারণ আমার বাবা কবি ও নাট্যকার মু. জালাল উদ্দিন নলুয়া ছিলেন নারীর নিজ পরিচয়ে বিশ্বাসী একজন মানুষ।
৭০ দশকে আমার জন্মের আগে তিনি ‘এফিডেবিট’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন। নাটকের গল্পটি ছিলো এমন। একজন নবপরিণীতাকে তার স্বামী কোর্টে নিয়ে যাবেন, স্ত্রীর নামের সাথে স্বামীর নাম যুক্ত করতে। কিন্তু সেই নবপরিণীতা বেকে বসেন এবং একপর্যায়ে বলেন, ‘হ্যাঁ কোর্টে আমি যাবো। তবে তোমার নাম যুক্ত করার জন্য নয়। নিজেকে মুক্ত করার জন্য। তখন তার স্বামী জানতে চান, মানে? স্ত্রী বলেন গোড়াতেই যে গলদ হয়েছে তা প্রথমে শোধরে নেব। ভাবছি পিতার বাড়িতে আমার নামের সাথে যে নামযুক্ত হয়েছে, তা এফিডেবিট করে পাল্টে নেব।’
এমন একটি নারী স্বাধীনতাকেন্দ্রিক নাটক যার বাবা লিখেন, নিশ্চয়ই সে বাবার কন্যা সন্তানের নামের সাথে অন্য কারো নাম যুক্ত হবার কথা নয়। এই নাটকে আর ও একটি সংলাপ ছিলো, যেখানে স্বামী স্ত্রীর কথোপকথনে স্ত্রী এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘আামি ভেবে দেখেছি বিদেশে তৈরিকৃত কোন বৃহদাকার জাহাজ যখন নিজ দেশে হাত বদল হয়ে তৃতীয় কোন দেশে আসে ক্রমান্বয়ে এটা ক্রয়কৃত নাম ধারণ করে। কিন্তু ক্রীতদাসের জন্য এটা কৃতিত্বের ব্যাপার নয়।’ এই সংলাপটিতে স্পষ্টতই বুঝা যায়, একটি নাম শুধু একার। সেই নামে কাউকে যুক্ত করা কোন কৃতিত্ব নয়।
কয়দিন আগে ‘রিন নামকরা নারী’ সম্মাননা ভূষিত হয়েছিলাম। সেখানে সম্মাননা পাওয়ার একটি শর্ত ছিলো এরকম, নারীকে নিজ পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। তারা আমার নাম দেখে খুশি হয়েছিলেন। আমার নাম শুধু একটি নামেই তাই।
দেখা যায়, আমাদের সমাজে বহু প্রথিতযশা নারী আছেন যাদের নামের সঙ্গে স্বামীর নাম যুক্ত করেছেন। এও দেখা যায়, অনেক প্রথিতযশা নারীও নিজের নামের পাশে বাবার নাম,স্বামীর নাম যুক্ত করেননি। তবে বংশীয় পদবি সংযুক্ত করার বিষয়টি আলাদা। এটা থাকতেই পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন কোন নারীর নামটিই থাকে না। তিনি হয়ে যান মিসেস অমুক নামে, মিসেস তমুক নামে। এভাবেই হারিয়ে যায় বাবা মায়ের রাখা নামটি। যাই হোক সমাজে আকারে ইঙ্গিতে নারীর উপর আধিপত্য করার প্রচেষ্টা সেই আদিকাল থেকে। নারীদের নামের সাথে বাবার নাম অথবা স্বামীর নাম যুক্ত করা রীতিটিও এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতা।
বিভিন্ন ফোরামে যখন জেন্ডার বিষয়ক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে যাই, তখন বেশীরভাগ প্রশিক্ষণার্থীর কাছে যদি জানতে চাই, জেন্ডার কি? উত্তরে অধিকাংশই বলে থাকেন, জেন্ডার মানে নারীর কোনো উন্নয়নের ব্যাপার। আসলে তা নয়। জেন্ডার মানে হচ্ছে নারী ও পুরুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংজ্ঞা। এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও মূল্যবোধে নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক যা সংস্কৃতি ও সমাজ কর্তৃক আরোপিত। নারী ও পুরুষের সামাজিক লিঙ্গগত পার্থক্যসমূহ সময় ও স্থান কাল ভেদে হতে পারে।
কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশে নারীদের পেশা বলতে বোঝাতো গতানুগতিক দুটি পেশা, শিক্ষকতা ও নার্সিং- যা সমাজ প্রদত্ত চিরাচরিত নারীর সেবামূলক ভূমিকার একটি বর্ধিতাংশ রূপ। আজকাল নারীরা বিভিন্ন পেশায় আছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে নারীদের দুর্নিবার অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। কোন কোন ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদেরও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো করছে। আর এই ছাড়িয়ে যাওয়া কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থার প্রথাগত ভূমিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব উদাহরণ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, দীর্ঘদিন ধরে নারীরা যে পেশায় নিযুক্ত ছিলো গত কয়েক দশকে বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে।
প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তজাতিক নারী দিবস পালন ছাড়া ও পালিত হয় কন্যা শিশু দিবস, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। এসব দিবস পালনের মূল কথাই হলো নারীর প্রতি সমানাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে দেখা। কিন্তু তাই বলে কি নারীর প্রতি নির্যাতন, সহিংসতা কমেছে? উত্তরে বলব, ‘না’ কমেনি। কিন্তু কেন কমছে না? কারণ একটাই, হাজার বছরে গড়ে উঠা পুরুষ সত্তা নারীকে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দেয় না। যে কারণে শৈশবেই কন্যার হাতে তুলে দেওয়া হয় পুতুল এবং পুত্রের হাতে গাড়ি। যদিও আমার জীবনে এমনটি ঘটেনি। আমার বাবা আমাকে কাঠের ঘোড়ায় চড়াতেন। আর আমার ছেলের হাতে দিয়েছিলাম পুতুল। এভাবেই ভাঙতে হবে অচলায়তন।
সমাজে জেন্ডার সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারী ও পুরুষের জন্য পরিবার থেকেই সমান সুযোগের ব্যবস্থা করা। যেখানে নারী ও পুরুষ নিজেদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেন। জেন্ডার সমতার মানে হচ্ছে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানাধিকার নিশ্চিত করা। নারী এবং পুরুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনসংক্রান্ত অধিকার, সম্পদের অধিকার এবং কথা বলার অধিকার প্রদান করাই জেন্ডার সমতা। আবার অনেকেই ক্ষমতায়ন বলতে মনে করেন, নারীর ক্ষমতায়ন। আসলে তা নয়। ক্ষমতায়ন শব্দটি নারী এবং পুরুষের উভয়ের জন্য দরকার। নারী পুরুষ নির্বিশেষে কোন মানুষ যখন নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয় এবং সেই নিয়ন্ত্রণ থেকে যখন তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়, সে যখন কোন সমস্যা সমাধান করতে শিখে এবং স্বণির্ভরতা অর্জন করে তখন বলা যায় সেই নারী এবং পুরুষ ক্ষমতায়িত হয়েছে। তবে আমাদের সমাজে নারীর উপার্জনের স্বাধীনতা থাকলেও তার অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে।
এছাড়া নারীর মানসিক ক্ষমতায়ন নিয়ে কেউ ভাবতেই চায় না। নারীদের ও নিজস্ব চিন্তার জন্য, নিজের সাথে নিজের সময় কাটানোর জন্য তাকে সুযোগ করে দিতে হয়। সে সম্পর্কে আমাদের সমাজ অসচেতন। একজন কর্মজীবী নারী যার সকাল, শুরু হয় কাক ডাকা ভোরে, সে নারী সংসারের সকল কাজ করে কর্মক্ষেত্রে যান এবং বাসায় ফিরে পুনরায় সংসারের কাজে লেগে যান। এরপর দেখা যায়, মাস শেষে উপার্জনের একটি বড় অংশ সংসারের পিছনে ব্যয় করেন। কিন্তু তার পরিবার কখনই জানতে চায় না, তার নিজের জন্য কোন ব্যয় করা দরকার কিনা। নিঃশ্বাস নেবার জন্য কোথাও বেড়াতে যাওয়ার দরকার কিনা। এমতাবস্থায় সে নারী ঘরে বাইরে সমানতালে কাজ করে যান। কর্মজীবী নারীর দুইটি কর্মক্ষেত্র একটি সংসার আর একটি অফিস। এই উভয় ক্ষেত্র সামলানোর পর একজন নারীরও যে নির্দিষ্ট একটি সময় নিজের সাথে কাটানো প্রয়োজন আছে, এ বিষয়টি নিয়ে তার পরিবারের কেউ মাথা ঘামাতে চায় না। বিষয়টি এমন যে, ঘরের স্ত্রীকে কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এটাই অনেক। কিসের আবার মানসিক ক্ষমতায়ন। আসলে একদিন নারী দিবস পালন করেই নারীকে প্রকৃত মর্যাদা দেওয়া হয় না। বিশেষ করে আমি একদিনেই নারী দিবস পালনে বিশ্বাসী নই।
আমরা যদি সত্যিই চাই তাহলে এমন একটি সমাজ গড়তে পারি কোন নিয়ম-কানুন,দায়িত্ব, গুণাবলী এবং আচরণের ধরণ সামাজিক লিঙ্গ বর্ণপ্রথা, শ্রেণি বা গায়ের রং দ্বারা নির্ধারিত ও আরোপিত হবে না। এটি হবে এমন একটি সমাজ যে সমাজে সবারই অধিকার ও স্বাধীনতা থাকবে নিজস্ব ইচ্ছানুযায়ী ভূমিকা পালনের মেধা বিকাশের এবং নিজস্ব পছন্দানুযায়ী জীবনযাপনের। সুতরাং নারী দিবস পালন করতে গিয়ে নারীকে ‘মানুষ’ থেকে আলাদা না করে, নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে গণ্য করে তাকে তার প্রাপ্য সম্মান প্রদান করলেই নারীদের প্রতি সম্মান অক্ষুন্ন থাকবে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম, আমার নামের আগে এবং পরে কোন নাম নেই। হ্যাঁ, আমার একটিই নাম। আমি স্বনামেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। আর এই ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে পরিবারের পরম্পরা থেকে। আমার দাদির নামের সাথে কোন নাম ছিলো না। ফুপিদের নামের সাথে ও কোনো নাম নেই। আমার নামের সাথে বাবার নাম নেই এবং আমার সন্তানের নামের সাথে ও তার বাবার নাম নেই। সন্তানের নামটি রেখেছেন তার দাদা। সন্তানের ফুফুদের নামের সাথেও তাদের বাবা এবং স্বামীর নাম নেই এবং তারা ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আসলে নিজ পরিচয়ে গুণান্বিত হওয়ার ব্যক্তিত্বটাই অন্যরকম। শেষ করব, শুরুতেই যে নাটকের কথা উল্লেখ করে শুরু করেছিলাম, তার একটি সংলাপ দিয়ে, ‘স্বামী বা পিতার নামে কোন মেয়ের পরিচয়ের প্রয়োজন নয়। একজন নারী স্বয়ংসম্পূর্ণা। নিজের পরিচয়ের জন্য কর্মই যথেষ্ঠ। ’ আসুন, নারীকে মানুষ ভাবি এবং মানুষের মতো তাকে সম্মান প্রদান করি। আর সেই সম্মান প্রদানের রীতিটি পরিবার থেকেই শুরু করি।
লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়