দেশ যখন ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে, ঠিক সে সময়ে একটি জাতীয় দৈনিক জনৈক দিনমজুরের ‘মাছ-মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা’ নিয়ে তাদের অনলাইনে একটি ফটো স্টোরি প্রকাশ করে। এটি প্রকাশ হওয়ার পর ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনুসন্ধানে নামে একাধিক গণমাধ্যম। ফলশ্রুতিতে ফটো স্টোরিটি প্রত্যাহার করে নেয় পত্রিকাটি।
তবে প্রত্যাহার করা হলেও এর পেছনে ‘গভীর ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ পাচ্ছেন অনেকেই। বাসন্তীর প্রসঙ্গও তুলেছেন সচেতন পাঠক। তারা বলছেন, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় কুড়িগ্রামের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারী বাসন্তীর গায়ে জাল পরিয়ে ছবি তোলার ঘটনাটি যেমন অপসাংবাদিকতার উদাহরণ, তেমনই ২০২৩ সালের স্বাধীনতা দিবসে ৬-৭ বছরের শিশুর মুখ দিয়ে ‘মাছ-মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা’র দাবি তুলে ফটো স্টোরি বানিয়ে প্রকান্তরে দেশের উন্নয়ন, অর্জন ও স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে, যা অপসাংবাদিকতার নামান্তর।
প্রতিবাদ আসে সাংবাদিক নেতাদের পক্ষ থেকেও। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাবেক সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ফেসবুকে এ প্রসঙ্গে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি ওই পত্রিকাটির নাম উল্লেখ করে লিখেছেন ‘কোনও পত্রিকাই ধর্মগ্রন্থ নয়, সত্য। ভুলভ্রান্তি থাকে। কিন্তু ‘স্বাধীনতা দিবস’কে উপহাস? তাও আবার অসত্য তথ্য ও ছবিযুক্ত করে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠার পরপরই নিজেদের অবস্থান থেকে পিছু হটে পত্রিকাটিও। সার্বিক দিক বিবেচনায় দৈনিকটি ভুল স্বীকার করে প্রথমে সংবাদটি প্রত্যাহার এবং পরে সংশোধনী ও ব্যাখ্যাসহ আবার প্রকাশ করে।’
ভুল স্বীকার করে নিউজটি প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে সব শেষ হতে পারতো। সেটি হয়নি। কারণ সংবাদটির উদ্দেশ্য। স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে দরিদ্র মানুষের অনুভূতি খোঁজা কোনো সরল সিদ্ধান্ত নয়। ফলে এই ছবির সঙ্গে অনেকে ‘বাসন্তী কানেকশন’ খুঁজে পাচ্ছেন। ৭৪ সালে বাসন্তীর ছবি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সরকারকে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত করে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথিত ‘যুক্তি’ হিসেবেও ঘাতকগোষ্ঠী বাসন্তীর ছবি ব্যবহার করেছিল।
২.
এই যে স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস, এর সঙ্গে তো স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কর্মকাণ্ডের মিল পাওয়া যায়। যারা সর্বজন-স্বীকৃত ইতিহাস, দেশের আইন ও সংবিধান কর্তৃক গৃহীত এবং মীমাংসিত বিষয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য নানারকম কুতর্ক উসকে দিয়ে ফায়দা নিতে চায় তাদের ভূমিকাই এখানে আবার প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। যদিও তারা প্রকাশ্যে নিজেদের ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’ শব্দগুলো বলার সাহস দেখায় না।
তবে শুধু এই পত্রিকাটি নয়, দেশের অনেক গণমাধ্যম এর আগেও বহুবার দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, শ্রমিকের দুঃখ দুর্দশা বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে অনেক রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু তখন সেগুলো নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কোনো হুল্লোড় বাঁধেনি। তাহলে এবার বাঁধল কেনো? এবার বাঁধার একটি কারণ হলো ওই সংবাদ প্রকাশের তারিখ। দিনটি ছিল আমাদের স্বাধীনতা দিবস। আর এই দিবসে একটি শিশুর মুখ দিয়ে যে কথাটি বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক।
এ ছাড়া যদি আমি ধরেও নেই যে, স্টোরিতে প্রকাশ হওয়া কথাগুলো সবুজ মিয়ার জায়গায় জাকির হোসেন বলেছে; তাহলেও স্বাধীনতা দিবসে কি এভাবে তা প্রকাশ করাটা ঠিক হয়েছে? উত্তর অবশ্যই না। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা ইচ্ছা তা লেখা গেলেও গণমাধ্যমে যায় না।
তদুপরি, রিপোর্টার যাই লিখুক, ফটো সাংবাদিক যে ছবিই তুলুক না কেনো, কোনটা প্রকাশ হবে, কোনটা হবে না; সেটা তো তারা ঠিক করেন না, এটা সম্পাদকীয় পর্ষদ ঠিক করে। কারণ, গণমাধ্যমের মালিক পক্ষ তাদের পছন্দমতো কিছু নীতি ঠিক করেন। এই স্বতন্ত্র নীতি থাকার পরও প্রতিটা গণমাধ্যমকেই একটা নৈতিকতার জায়গা অবলম্বন করতে হয়। ইংরেজিতে যাকে বলে এথিকস। গণমাধ্যমের নীতি যাই হোক না কেন, এথিকস তাকে মেনে চলতেই হবে। এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
এর আগেও গণমাধ্যমটি ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’, ইসলামি মূল্যবোধে আঘাত করে কার্টুন প্রকাশসহ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ পরিবেশন যেমন করেছে, তেমনই সেগুলো নিয়ে প্রতিবাদ ওঠার পর তারা ভুল স্বীকার করেছে। আমি মনে করি এগুলো হঠাৎ করে হওয়ার বিষয় নয়। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, এবার তারা ফটো স্টোরি শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন করলেও দিনমজুরের ভাষ্যে স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা বিবৃতিটি কিন্তু রেখে দিয়েছে।
৩.
করোনা মহামারির পর বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন একটু একটু উঠে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ঢেউ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে চরম ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপ-আমেরিকার মতো শক্তিশালী অনেক দেশের অর্থনীতিই নাজুক অবস্থায় পড়ে। পাশাপাশি দেউলিয়া হয়ে যায় অনেক ব্যাংকসহ বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যেহেতু বিশ্ব এখন বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। কাজেই করোনাভাইরাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক সংকটের আঁচ আমাদের এখানে লাগাও স্বাভাবিক, লেগেছেও। যে কারণে এ সময় আমাদের আরো সচেতন হওয়ার কথা ছিল। স্বাধীনতা দিবসে নিজেদের সম্ভাবনা, সাফল্যগুলো সামনে না এনে উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ পরিবেশন সত্যিই বেদনার। বিশ্ব অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনও অন্যদের তুলনায় যথেষ্ট ভালো। সরকার পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে এটাও তো সত্য। তাহলে কি বাংলাদেশের সাফল্য, এই প্রশংসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল?
সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ যোজন যোজন এগিয়ে থাকার পরও বেশ কিছু দিন ধরেই একটি মহল বলার চেষ্টা করছে- আমাদের স্বাধীনতাটাই ভুল ছিল, পাকিস্তান আমলই বরং ভালো ছিল। এই ফটো স্টোরির মাধ্যমে পত্রিকাটি কৌশলে সেই বিতর্ককেই আরও একবার উসকে দিয়েছে।
৪.
সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির মানদণ্ডের বিবেক। তবে তারা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। সমালোচনা হবেই এবং এ জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে নৈতিক স্খলন কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সংবাদমাধ্যমের কাজই হচ্ছে সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা নির্ভরযোগ্যতা, সততা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রেখে। একেবারে সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের বিভিন্ন ঘটনাবলী যেখানে নিরপেক্ষ থেকে সংগ্রহ করতে হয়, সেখানে প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি শিশুকে নিজেদের ফায়দা হাসিল করার জন্য সংবাদের শিরোনামে যেভাবে পরিণত করা হয়েছে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, ন্যাক্কারজনক এই কাজটি যারা করেছে তাদের পক্ষেই দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংগঠনসহ বেশ কিছু দেশ।
অতীতেও দেখেছি, এখনও দেখছি- বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি এ সংগঠনগুলোর অতি আগ্রহ সবসময়ই শঙ্কার। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা প্রশ্ন আছে আমার। যেসব দেশ ও সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে তাদের দেশে কোনো শিশুকে স্বার্থ হাসিলের জন্য এভাবে ব্যবহার করা হলে কি অবস্থান হতো তাদের? একটা উদাহরণ দেই। মাত্র এক দশক আগে ফোন ‘হ্যাকিং’ নিয়ে কেলেঙ্কারির মুখে ব্রিটেন তাদের প্রাচীন ও সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বন্ধ করে দিয়ে পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদক ও প্রধান প্রতিবেদকসহ তিন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় এনেছিল। এটাকে ওই সময়ে কেউ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ বলেননি। কিন্তু বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে কি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে একবার ভেবে দেখুন। আজকালকার পাঠক-দর্শক কিন্তু অনেক সচেতন। তারা বোকা নন কোনোমতেই।
সমাজ বিনির্মাণে সাংবাদিকের ভূমিকা অপরিসীম। তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা শুধু ব্যবসায়িক কাজ নয়, সামাজিক দায়িত্বও বটে। তাই লেখা শেষ করার আগে একটা দাবি রেখে যাবো। কারো বিরুদ্ধে যদি গুরুতর কোন অসদাচরণের অভিযোগ থাকে, কেউ যদি সংবাদমাধ্যমকে ইচ্ছেকৃতভাবে শান্তি ও স্থিতি বিনষ্ট করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তাহলে সেটা স্পষ্ট করে সবাইকে জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। দেশের বেশিরভাগ মানুষই এটা চায়। তবে অন্যায়ভাবে কাউকে যেন হয়রানি করা না হয় এটাও নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক