১০ এপ্রিল ১৯৭১। কুষ্টিয়া সীমান্তের ওপারে উপস্থিত প্রায় ১৯২ জন এমএনএ এবং এমপিএদের অধিবেশন আহ্বান করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ। এই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতার সনদ বা ঘোষণাপত্র অনুমোদন করা হয়। দেশের নামকরণ করা হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ও আরো তিনজনকে মন্ত্রী করে বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম সরকারের মন্ত্রীপরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী গণপরিষদ সদস্যরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, দেশের নাম এবং গঠিত সরকারকে অনুমোদন দেন।
সীমান্তের ওপারে যখন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো, তখন সীমান্তের এপারে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে একই দিনে গঠিত হলো বাঙালি জাতি রাষ্ট্র ও স্বাধীনতা ধ্বংস শুধু নয়, মুক্তিকামী বাঙালিকে নিধনে পাকবাহিনীর ‘শান্তি কমিটি’। শান্তিপ্রিয় বাঙালি ওই প্রথম ‘শান্তি’ শব্দটিকে ঘৃণা করতে শেখে। কারণ শান্তির নামে তারা যুদ্ধরত বাঙালির জীবনে অশান্তি তৈরি করে। এই শান্তি কমিটি গঠনের তিন সপ্তাহের মধ্যে গঠিত হয় শান্তি কমিটির সশস্ত্র ঘাতক বাহিনী, তরুণ যুবক সমন্বিত রাজাকার বাহিনী। রাজাকার শব্দের অর্থ বন্ধু বা দোস্ত। এই রাজাকার বাহিনী পাক সেনাদের খাঁটি দোস্তের ভূমিকাই পালন করেছিল বায়ান্ন বছর আগে একাত্তরে।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লী যান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দুদফা বৈঠক করেন। তখন তিনি পূর্ব বাংলার নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে ১০ এপ্রিল গণপরিষদের সদস্যদের নিয়ে অধিবেশন করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। বাঙালির রাষ্ট্র গঠন কাজ শুরু হয় তখন থেকেই। আর এই ঘোষণার পর এই সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকে।
দখলদার ঢাকার চিত্র তখন অন্যরকম। ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া গণহত্যা কার্যক্রম যখন পাক হানাদাররা অব্যাহত রাখে এবং মুক্তিকামী বাঙালিকে পর্যুদস্ত করতে সশস্ত্র আগ্রাসন চালায়, তখন মুক্তিকামী বাঙালি নিধন ও পাকিস্তান রক্ষার নামে মাঠে নামে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে বিপুল ভোটে হেরে যাওয়া পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় লেবাসধারী দলের নেতারা। এরা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় দলের পূর্বাঞ্চল শাখার নেতা। একাত্তরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই অধ্যাপক গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান এবং এ কে এম ইউসুফ প্রমুখ জামাতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান শাখার নেতারা ঘন ঘন টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করতে থাকেন। তারা মুক্তিযোদ্ধা নিধনে তাদের নেতৃত্বে জেলা, থানা, গ্রাম পর্যায়ে সশস্ত্র কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। হানাদারদের নেতা টিক্কা খান তাদের ‘সাচ্চা মুসলমান’ হিসেবে সাদরে বুকে টেনে নিয়ে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিকামী বাঙালি নিধনের ‘লাইসেন্স’ দিয়ে দেয়।
অথচ একাত্তরের ২৬ মার্চ বাংলার জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে নরঘাতক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সকল বাঙালিকে আহ্বান জানান। ২৫ মার্চ রাতেই বাঙালি সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু পাকিস্তানবাদী বাঙালি নামধারীরা দখলদার পাক হানাদার বাহিনীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বাঙালির বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। টিক্কা খান-গোলাম আযমের বাঙালি নিধন বৈঠকের পরিণতিতে গঠিত হয় ‘শান্তি কমিটি’।
গোলাম আযম সহযোগীদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। জামাতে ইসলামী কমিটিতে মুখ্য নেতৃত্বের আসনে থাকে। খাজা খয়েরের কাউন্সিল মুসলীম লীগ, মৌলবী ফরিদের নেজামে ইসলামী ও নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন পিডিপি সহযোগী দল হিসেবে শান্তি কমিটির সদস্য নামে আবির্ভূত হয়। ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে বেসামরিক সশস্ত্র সংগঠন শান্তি কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য হিসেবে গোলাম আযম ঘোষণা দেন: ‘এই কমিটির উদ্দেশ্য হলো ভারতীয় অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও ধংসোন্মুখ ইসলামকে রক্ষা করা এবং সেইসঙ্গে বিপথগামী জনসাধারণকে সৎপথে ফিরিয়ে আনা।’ এই উদ্দেশ্য হাসিল তথা বাস্তবায়নের জন্য গোলাম আযম পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের পূর্ণ সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেন এবং নয়মাস ধরে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ঘোষিত স্বাধীনতার সনদপত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জন ও আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠন এবং সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় তুলে ধরা হয়। স্বাধীনতার এই সনদে প্রজাতন্ত্রের মূলনীতি- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়-বিচার প্রণয়ন উল্লিখিত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিয়মতান্ত্রিক সরকারের রূপকাঠামো ও ক্ষমতা নির্দেশ এবং জাতিসংঘের প্রণীত মানবাধিকারের সর্বজনীন সনদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা। জনগণের অভিপ্রায়ই ঘোষণাপত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং জাতিগত নিপীড়ন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরকার গঠন এবং যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। ঘোষণাপত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার উল্লেখ করা হয়েছে। যে ঘোষণার ভিত্তিতে বাঙালি যুদ্ধে নেমেছে। এই ঘোষণা সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম কেবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম উল্লেখ করেছেন ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ শীর্ষক দালিলিক গ্রন্থে। তিনি বলেছেন, ‘ধীনতার ঘোষণাপত্র হলো আমাদের ম্যাগনাকার্টা; স্বাধীনতার সনদ। এই ঘোষণায় সুষ্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে কেন, কোন্ ক্ষমতার বলে এবং পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো, যে রাষ্ট্রের নাম হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দপ্তর স্থাপন করেছিল তাই এর ব্যাপক পরিচিত হলো মুজিবনগর সরকারর রূপে। স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয় প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘœ নেতৃত্ব দেয়ার প্রয়োজনে।’
১০ এপ্রিলের স্বাধীনতা সনদে বাঙালির জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা রক্ষা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিক মর্যাদাবোধ সমুন্নত রাখতে আহ্বান জানানো হয়েছিল। সে আহ্বানে সমর্থন জানিয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল পাকিস্তানভিত্তিক রাজনৈতিক দল ওয়ালী খানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ভাসানী ন্যাপের ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শাখা এবং বাংলা কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি। এদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি ও ভাসানী ন্যাপ ছাড়া বাকীরা সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। কেবল প্রাদেশিক পরিষদে ওয়ালী ন্যাপের ১ জন সদস্য নির্বাচিত হয়।
কিন্তু জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমর্থনে গঠিত সরকারের আহ্বানে সাড়া দেয়নি পাকিস্তানভিত্তিক দল জামাতে ইসলামী, কাউন্সিল মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলামী ও পিডিপি ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শাখা এবং চীনাপন্থী গলাকাটা রাজনীতিকরা। যারা নির্বাচিত আওয়ামী এমপিদের সত্তরে হত্যা শুরু করে। বরং এরা জনগণের সরকার এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্খাকে হত্যা করার জন্য রাজনীতিক থেকে কসাইয়ে পরিণত হয়। তারা অস্ত্র তুলে নেয় হাতে।
সত্তরের নির্বাচনে জামাতে ইসলামী পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে ছিল। মওলানা ভাসানী ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ বলে রহস্যজনক কারণে নির্বাচন বর্জন করায় জামাত এই অবস্থানে চলে আসে। পুরো পাকিস্তানে জামাত মনোনীত ২শ প্রার্থীর মধ্যে কেবল পাকিস্তানের সিন্ধুতে ৪ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। পূর্ব বাংলায় অধিকাংশ আসনে জামাতের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। ২টি আসনে প্রার্থী প্রাদেশিক আমীর গোলাম আযম একটি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জহির উদ্দিনের ১ লাখ ১৬ হাজার ২০৪ ভোটের বিপরীতে মাত্র ৩৫ হাজার ৫২৭ টি ভোট পেয়েছিল। পূর্ব বাংলায় জামাতকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাই গোলাম আযম ক্ষুব্ধ ছিলেন বাংলার জনগণের উপর।
২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর পরপরই জামাত ঘাতক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গোলাম আযম আর নুরুল আমিন মিলে ৪ এপ্রিল টিক্কা খানকে আশ্বাস দেয়, দ্রুত পুরো পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা করার। আবার ৬ এপ্রিল গোলাম আযম টিক্কা খানের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে। গোলাম আযম বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। বৈঠক শেষে গোলাম আযম বলে, ‘ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্য প্রদেশের দেশপ্রেমীক জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে গোড়াতেই ধ্বংস করার জন্য জামাত জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। পাশবিক প্রক্রিয়ায় পাক হানাদারদের সহযোগিতার জন্য ‘শান্তি কমিটি’ গঠনের পর গোলাম আযম রাজনীতিক থেকে ‘ঘাতক সর্দারে’ রূপান্তর হন। তার ক্ষোভ ছিল মুক্তিকামী বাঙালির বিরুদ্ধে। একাত্তরের ১০ এপ্রিলের পর ১৫ এপ্রিল গঠিত হয় শান্তি কমিটির প্রাদেশিক শাখা। কাউন্সিল মুসলীম লীগের সভাপতি ঢাকার নবাববাড়ীর খাজা খয়েরউদ্দিন, যে নির্বাচনে বিপুল ভোটে হেরেছিল, হয়ে যায় প্রাদেশিক কমিটির আহ্বায়ক। গোলাম আযম তৃতীয় নম্বরের সদস্য।
একাত্তরের ১০ এপ্রিল যখন তাজউদ্দিনের সভাপতিত্বে স্বাধীনতার সনদসহ সরকার কাঠামো অনুমোদন চলছিল। তখন ঢাকায় টিক্কা খানের খুনে বাহিনী শান্তি কমিটি প্রথম বৈঠকে বসে। গোলাম আযমের নেতৃত্বে এই বৈঠকে ‘ভারতীয় ও অন্যান্য ইসলাম বিরোধীদের’ বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সময়োচিত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ায় গভীর সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকে নেয়া প্রস্তাব, যা দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন সংবাদপত্রে ছাপা হয়, তাতে বলা হয়, ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক, আইনজীবি, মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার মোদাররেসদের প্রতি জনসাধারণকে কোরআন ও সুন্নাহর আদর্শে অনুপ্রাণিত করে তোলার নির্দেশ দেয়া হলো। যাতে জনসাধারণ ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমনদের মোকাবেলা করতে পারেন এবং প্রয়োজন হলে জেহাদে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন।’
গোলাম আযমের প্রথম গেস্টাপো বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা এপ্রিলেই শুরু হয়। বাংলাদেশের সর্বত্র এমনকি গ্রাম পর্যায়ে শান্তি কমিটির শাখা গঠন করা হয় পাক হানাদার বাহিনীর সহায়তায়। শান্তি কমিটি ২২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে সকল ‘দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানির’ প্রতি রাষ্ট্রবিরোধী লোকদের হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ প্রতিরোধ এবং উদ্যম ও উৎসাহের সঙ্গে সব রকমভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করার আহ্বান জানায়। শান্তি কমিটির সবকটি জেলা ও মহকুমা এমনকি থানা পর্যায়ের কমিটির নেতৃত্ব দখল করে স্থানীয় জামাতের লোকজন। যারা পুরোপুরি ঘাতকে পরিণত হয়, পাকিস্তানী হানাদারদের বক্ষলগ্ন হয়ে এক পথে এক পায়ে চলার অঙ্গীকারে।
এই শান্তি কমিটি মুসলীম লীগের সঙ্গে একযোগে পাক হানাদারদের গ্রাম বাংলার পথঘাট দেখিয়ে নিয়ে যেতো। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শুধু নয়, সাধারণ মানুষ যারা নির্বাচনে তাদের ভোট দেয়নি, তাদের ঘরবাড়ি চিনিয়ে দেয়া শুরু করে ১১ এপ্রিল থেকে। হানাদাররা বাড়ি-ঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ শুধু নয়, বাড়ির লোকজনকে হত্যা ও নারীদের অপহরণ করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ায় সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয় শান্তি কমিটি। গ্রাম পর্যায়ে গরু-খাসিসহ মুরগি, অর্থ-সম্পদ লুটপাট করার কাজে পাক বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করে নিয়ে যেতো শান্তি কমিটির ঘাতক চরিত্রগুলো। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি-ঘর পোড়ানোর কাজটি গুরুত্বসহকারে করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নারী নির্যাতনের পথটি এই শান্তি কমিটি দেখায়। কোথাও এমন হয়েছে, শান্তি কমিটি ব্যক্তিগত রেষারেষি থেকে অনেক পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে। সম্পত্তি গ্রাস করার কাজে মত্ত হয়ে ধর্ম রক্ষার কাজ চালাচ্ছিল। পাকিস্তান রক্ষায় গোলাম আযমের শান্তি কমিটির ভূমিকায় টিক্কা খান এতোই সন্তুষ্ট হয়েছিল যে, শহরাঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায় ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত সম্পত্তি লুটে নিতে তারা উন্মাদ বনে যায়। একাজে জামাত উর্দূভাষী বিহারীদের সহায়তা পেয়েছিল। টিক্কা খান শান্তি কমিটির ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিল, ‘তারা প্রদেশে সর্বত্র শান্তি বজায় রাখা এবং জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।’
গোলাম আযম তার গেস্টাপো সংগঠনের মূল্যায়ণ করে বলেছিল, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য শান্তি কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শান্তি কমিটি যদি দুনিয়াকে জানিয়ে না দিতো যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দেশকে অখণ্ড রাখতে চায়, তবে পরিস্থিতি হয়তো অন্যদিকে মোড় নিতো।’
গোলাম আযম এই একটি সত্য স্বীকার করেছেন যে, তার শান্তি কমিটি না থাকলে পাক বাহিনী বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে পারতো না। ৩০ লাখ মানুষ এবং ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানী হতো না। বাঙালি খুব সহজেই পাক বাহিনীকে পরাস্ত করতো। কারণ বঙ্গবন্ধু তো বলেছিলেন তাদের পানিতে এবং ভাতে মারার জন্য। অর্থাৎ গেরিলা লড়াই চালিয়ে পর্যুদস্ত করা। কিন্তু পাক হানাদারদের সহযোগিতায় গোলাম আযমসহ অন্যরা ঘাতকরূপে অবতীর্ণ হয়ে পাক বাহিনীর শক্তিকে তিনগুণ বাড়ায়। নদী-নালা, জলাশয় এবং হাট-মাঠ ঘাটের যে বাংলাদেশ, সেই গ্রামে হানাদাররা সহজে যেতে পারতো না। এতো রক্ত, এতো ধ্বংসযজ্ঞ বাঙালিকে সইতে হতো না।
বঙ্গবন্ধুসহ তার সহকর্মীদের আগেই উপলব্ধি ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হবে, হয়েছেও তা। কিন্তু জামাতসহ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলো বাঙালি নিধনে পাক হানাদারদের সহায়ক শক্তি হয়ে যুদ্ধকে আরো দীর্ঘ করে লাখো লাখো মানুষের প্রাণহানির নৃশংস কাজগুলো করেছে। অবরুদ্ধ দেশে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিরা শান্তিকমিটির খুনী আচরণে আতঙ্কিত থাকতো। যে কোনো সময় যে কোনো স্থান থেকে যে কাউকে উঠিয়ে নিয়ে গুম করে ফেলা কিংবা খুন করে রাস্তায় ফেলে রাখার কাজে শান্তি কমিটি প্রাগ্রসর ভূমিকা ছিল।
গোলাম আযম ‘ঘরে ঘরে যেসব দুশমন’ রয়েছে তাদের খুঁজে বের করার জন্য শান্তি কমিটির সদস্যদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিল, ‘পাকিস্তান টিকে থাকলে আজ হোক কাল হোক বাঙালি মুসলমানদের হক আদায় হবে। কিন্তু আজাদী ধ্বংস হলে মুসলমানদেরকে শৃগাল কুকুরের মতো মরতে হবে।’ কিন্তু গোলাম আযমই বাঙালি মুসলমানদের শৃগাল কুকুরের খাদ্য করে তুলেছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে প্রাণীখাদ্য করেছিলেন সেই একাত্তরে। বাঙালি নিধনে শান্তি কমিটির সাফল্যের দাবি করে গোলাম আযম একাত্তরের মে মাসে গঠন করে রাজাকার বাহিনী। শান্তি কমিটির সদস্যদের মতোই, রাজাকার বাহিনীর সদস্যরাও নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকভাবে জ্ঞাতি-কুটুম্ব প্রতিবেশীদের ওপর অত্যাচার করে পাক সেনাদের সুনজরে আসার প্রচেষ্টা চালায় শুরু থেকেই। পরিণামে লাখ লাখ বাঙালি পরিবার নিগৃহীত হয় তাদের হাতে। নিহত হয় অগণিত বাঙালি, ধর্ষিত হয় অসংখ্য মা-বোন-কন্যা। ক্রমশ অস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই রাজাকার বাহিনীকে একটি মিলিশিয়া বাহিনীতে পরিণত করা হয়। এই বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ছিল, পাকহানাদারদের পরিকল্পনানুযায়ী ঢাকাসহ বাংলাদেশের মুখ্য শহরগুলোতে সৃষ্ট ত্রাসের ব্যাপ্তি ঘটানো ও সেই পরিস্থিতি দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়ে যাওয়া। যাতে বাঙালি জনগণের বিদ্রোহী মানসিকতা চিরতরে নিঃশেষ করে দেওয়া যায়।
রাজাকারদের দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল, বাঙালি যুবগোষ্ঠী, সামরিক, আধা সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া, যাতে মুক্তিবাহিনীর হামলার ধাক্কা সরাসরি পাক বাহিনীর উপর না আসে। এরপর আল বদর ও আল শামস বাহিনী গঠন করে গোলাম আযমসহ সমমনারা। যাদের হাত শুধু বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল সেদিন। এবং আজো।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাঙালি জাতির জীবনের এক ঐতিহাসিক দিবস। এই দিনে বাঙালির রাষ্ট্র ও সরকার ও স্বাধীনতা সনদ গঠন ও ঘোষিত হয়। যা তাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিরত রাখে। আর একই দিনে দখলদার বাহিনীর সহায়তায় বাঙালি নিধনে গোলাম আযমরা ঘাতকের ভূমিকায় নেমে শান্তি কমিটি নামক ঘাতক বাহিনী গঠন করে। যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিলম্বিত শুধু নয়, লাখো মানুষ হত্যার সহায়ক। কিন্তু বীরের জাতি বাঙালি পাকহানাদার ও তার সহযোগী শান্তিকমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিল একাত্তরেই। জয়তু বাঙালি।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)