মতামত

সাধারণে ‘অসাধারণ’ বেবী মওদুদ 

আজ সাংবাদিক বেবী মওদুদের প্রয়াণ দিবস। ২০১৪ সালের এই দিনে মারা যান তিনি। এর আগে তিনি কর্কট রোগে আক্রান্ত হন। পেশায় সাংবাদিক হলেও  সাহিত্যিক, নারী নেত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সচেতন রাজনৈতিক কর্মী নানা অভিধায় তাকে মূল্যায়ন করা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বেবী মওদুদ। নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। 

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ‘বাংলা বিভাগ’ তারই হাতে গড়া। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। জীবনের শেষ দিকে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের স্যোসাল এফেয়ার সম্পাদক ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য হিসেবেও জনপ্রতিধিত্ব করেছেন বেবী মওদুদ।

সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করতে গিয়ে বেবী মওদুদের লেখালেখি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় আমার। আমি তাকে ‘আপা’ ডাকতাম। বেবী আপা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর প্রথম দিককার কাজগুলোতে তার শ্রম খুব কাছ থেকে দেখেছি। বিচিত্রার শেষ পাতায় প্রতি সপ্তাহে বেবী আপার একটি নিয়মিত কলাম বের হতো। ‘অন্তরে বাহিরে’ নামে এই লেখাগুলো সঙ্কলিত হয়ে পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। যাতে বেবী আপার ব্যক্তি জীবনের ছায়া ছিল। 

বেবী মওদুদ লেখালেখির জগতে সক্রিয় ছিলেন। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই তার খ্যাতি ব্যাপক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- মনে মনে (ছোট গল্প), শেখ মুজিবের ছেলেবেলা, দীপ্তর জন্য ভালোবাসা, পবিত্র রোকেয়া পাঠ, টুনুর হারিয়ে যাওয়া, দুঃখ-কষ্ট ভালোবাসা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা, মুক্তিযোদ্ধা মানিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবার, আমার  রোকেয়া ও কিশোর সাহিত্য সমগ্র, নিবন্ধ সমগ্র ‘অন্তরে বাহিরে’।

আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন স্নেহময়ী মা, বড় বোনের প্রতীক। তার স্নেহধন্য হওয়ায় অনেক স্মৃতিময় ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাকে ঘিরে অনেক কথা মনে পড়ছে। বিশেষ করে মনে পড়ছে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাইর কথা। এ দিন ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে। সকাল ৯.৪৫ মিনিটে আমি অফিসে পৌঁছি। তখন বেবী আপা বিচিত্রার টিভি রুমে। একটি টিভি চ্যানেলে সরাসরি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার, আদালতে নেয়াসহ নানা দৃশ্য সম্প্রচার করছে। আদালত এলাকায় গাড়ি থেকে নামানোর সময় টানাহেঁচড়ার দৃশ্য টিভিতে দেখে বেবী আপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। প্রিয় বন্ধুর জন্য এমন ভালবাসা ক’জনের থাকে জানি না? তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য তাঁর দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরেছে- সেদিনের সেই দৃশ্য আজও বিস্মৃত।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কাছে এক বড় আবেগের নাম। সুধাসদনকে তিনি মনে করতেন সেকেন্ড হোম। প্রতিদিন সুধাসদনে যাওয়া যেন বেবী আপার রুটিন ছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার গ্রেফতারে তিনি প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েন। নিঃসঙ্গ মনে হতো তাকে। অসহায়ের মতো বিচিত্রা অফিসে আসতেন। কারও সঙ্গে খুব একটা কথা বলতেন না। সময়টা এতটাই বৈরি ছিলো যে- তখন আমাদের সবার মনেই এক অজানা আতঙ্ক। বিচিত্রা অফিসের চারদিকে সব সময়ই গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন ঘুরঘুর করত। অফিসে আসা-যাওয়ার মাঝেই বিষয়টা আমরা বুঝতে পারতাম। ইতোমধ্যে অনেক লেখক রহস্যজনক কারণে বিচিত্রায় লেখা বন্ধ করে দেন। এমনকি আয়ের উৎস যে বিজ্ঞাপন তাও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল তখন। একদিন বেবী আপা বললেন, আর পারছি না। পত্রিকাটি বুঝি আর চালানো যাবে না। কোথায় পাব এত টাকা? সে বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বিচিত্রা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে শেখ রেহানার সম্পাদনায় নতুনভাবে, নতুন ব্যবস্থাপনায় পথচলা শুরু হয় বিচিত্রার। একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে বেবী আপার প্রত্যক্ষ নির্দেশে বিচিত্রায় আমারও পথচলা। ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিচিত্রায় সহ-সম্পাদক ছিলাম আমি। 

প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যুক্ত না হয়েও রাজনীতির মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মীর মতোই কাজ করতেন বেবী আপা। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের দেশব্যাপী তাণ্ডব, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর এবং সর্বোপরি ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সময় শেখ হাসিনার গ্রেফতার আন্দোলনে তার নিরলস সংগ্রাম নানাভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তখন রাজনৈতিক কর্মী নয়, সংবাদকর্মী হিসেবে তার পাশে আমাদের কাজ করার সুযোগ হয়েছিল।

সীমিত আয় দিয়েও যে কিভাবে স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন করা যায়; এই বিষয়টি আমরা বিচিত্রার অনেকেই তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম। সাদামাটা জীবন যে কতটা আনন্দের হতে পারে বেবী আপাকে দেখে সেটা উপলব্ধি করেছি। জীবনে যত বেশি চাহিদা থাকবে জীবন তত জটিল হবে। সুতরাং চাহিদাকে কমিয়ে এনে জীবন আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার কথা আমার বেবী আপার কাছ থেকেই শিখেছি। 

কর্মময় জীবনই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সাংবাদিক-সাহিত্যিক বেবী মওদুদ তার স্বীয় কর্মের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। তবে সাংবাদিক মহলে বেবী আপাকে নিয়ে উপলব্ধি ভালো-মন্দ মিলিয়েই। মনের দিক থেকে সহজ-সরল হলেও প্রচণ্ড অভিমানী ছিলেন তিনি। অনেক ক্ষেত্রে তা ক্ষণস্থায়ী হলেও অন্যায় বা অনিয়মের সাথে আপোষ করতেন না কখনও। সে কারণে অনেকের বিরাগভাজনও ছিলেন। তবে আমি কাছ থেকে যে বেবী আপাকে দেখেছি তিনি সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বেবী আপা, আমাদের যা শিখিয়েছেন তা আমরা নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা কখনই ভুলব না। অন্যায়কে অন্যায়, অসত্যকে অসত্য বলার দৃঢ় সাহস আমরা তার কাছে শিখেছিলাম। 

লেখক : সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)