মতামত

বঙ্গবন্ধু কেন রাজনীতি করতেন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এখানে তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন: ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা’। শুধু কথায় নয়, কাজেও তিনি এ অঙ্গীকারের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থার অক্ষয় প্রমাণ রেখে গেছেন। সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বাংলার ‘দুঃখী’ মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য। 

বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এটা ছিল তাঁর প্রথম বিপ্লব। ঐতিহাসিক এ অর্জনের পথ ধরেই তিনি বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হয়েছেন। তিনি যদি আর কিছু নাও করতেন, একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্মদাতা  হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতেন। কিন্তু তিনি থামলেন না। এবার পা বাড়ালেন তাঁর দ্বিতীয় অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কঠিনতম পথে। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে শত শত বছর ধরে শোষিত বঞ্চিত স্বদেশবাসীর ‘মুক্তি’র লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন, তখনই রাতের অন্ধকারে তাঁকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু কেন? সমীকরণটি সহজ। কারণ এতে কারো কারো স্বার্থে আঘাত লেগেছিল। 

বঙ্গবন্ধু বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৫ বছর। এমনকি বাংলাদেশের গড় আয়ুর বিচারেও স্বল্পায়ু এ জীবনের প্রায় ১৪ বছরই কেটেছে কারাগারে। ছেলেবেলায় নানা ধরনের অসুস্থতা কেড়ে নিয়েছে মূল্যবান আরও কয়েকটি বছর। তারপর যে কটি বছর বেঁচেছিলেন তার প্রতিটি মুহূর্ত তিনি সংগ্রাম করেছেন দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য। নিজের জীবনের পরোয়া করেননি। ভাবেননি পরিবার-পরিজনের কথা। যখন এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে কাটছে বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবন, তখন পাঁচটি সন্তান নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে তিনি সব কষ্ট কেবল হাসিমুখে সহ্যই করেননি, সব সময় পাশেও দাঁড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধুর। জুগিয়েছেন সাহস ও অনুপ্রেরণা। 

আমাদের মনে আছে যে ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। একাত্তরের ২৫শে মার্চ রাতে গণহত্যাযজ্ঞ শুরুর পরপরই বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই রাতেই পাকিস্তানি হানাদাররা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। নির্বিচারে হত্যা করে এ দেশের নিরীহ শান্তিপ্রিয় ৩০ লাখ মানুষকে। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় আরও দুই লাখ মা-বোন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয় গোটা দেশকে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে ওরা দাবিয়ে রাখতে পারেনি।

বাংলার দামাল ছেলে-মেয়েরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। যারা নিজেদের ‘পৃথিবীর সেরা সেনাবাহিনী’ বলে বড়াই করতো সেই পাকিস্তানি বর্বরদের চিরতরে বিতাড়িত করেছে বাংলার মাটি থেকে। প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সৈন্যকে বাধ্য করেছে আত্মসমর্পণে। এক সাগর রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে প্রথমবারের মতো সগর্বে স্থান করে নিয়েছে নতুন একটি দেশ- যার নাম বাংলাদেশ। 

প্রশ্ন হলো, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যা সম্ভব হয়নি, একাত্তরে কীভাবে তা সম্ভব হলো? সহজ ও একমাত্র উত্তরটি হলো, এটি সম্ভব হয়েছে একটি মানুষের জাদুকরী নেতৃত্বের গুণে। তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান- বাংলার মানুষ ভালোবেসে যাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে ডাকেন। একাত্তরের ৭ই মার্চ তিনি বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ।’ তিনি সেদিন তাঁর প্রিয় দেশবাসীকে ঘরে ঘরে দুর্গ ঘরে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি’, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। কিন্তু বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় নেতার নির্দেশমতো ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। 

বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার সন্তান। এই গোপালগঞ্জেরই কোটালিপাড়ার সন্তান চির কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য লিখেছেন: ‘বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ম করো চিত্ত/ বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’

শত শত মাইল দূর থেকে আসা পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদারদের বাংলার মানুষ সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল একাত্তরে। আর বাংলার মাটিকে দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত করার এ অসাধ্যটি সাধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কীভাবে? বাংলার সর্বস্তরের মানুষকে তিনি যেভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত ও একতাবদ্ধ করেছিলেন, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে তার তুলনা বিরল।

একাত্তরের মার্চে সেই যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- তাঁর জাদুকরী নেতৃত্বে সেটাই বাস্তব রূপ পেয়েছে মাত্র নয় মাসে। শত শত বছর ধরে এ জনপদের মানুষ যে-স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখারও সাহস পায়নি, সেই স্বাধীনতা এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। কারো বাড়ির ছাদে, কারো গাড়িতে কিংবা কোনো ক্রিকেট ম্যাচের গ্যালারিতে লালসবুজ পতাকা হয়ে তা পতপত করে উড়ছে। আবার কেউ-বা বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে উড়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। জন্মলগ্নে বাংলাদেশকে যারা আঁতুড়ঘরেই হত্যা করতে চেয়েছিল এবং জন্মের পর যারা এ দেশটিকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল তারাই এখন স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ এখন একটি মডেল। সেই মডেলটি হলো সাহস ও সক্ষমতার। সেই মডেলটি হলো সব বাধাকে পায়ে দলে এগিয়ে যাবার। কে দিয়েছিলেন আমাদের এই মন্ত্র? নিশ্চিতভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তবে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এ স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হাঁটতে হয়েছে দীর্ঘপথ। স্বীকার করতে হয়েছে বিপুল আত্মত্যাগ। সহ্য করতে হয়েছে অনেক অত্যাচার ও নির্যাতন। মৃত্যুর মুখোমুখিও দাঁড়াতে হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু কখনোই বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে তিনি আপস করেননি। মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৪৯ সালেই তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। আর দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখনো তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। চোখের সামনে ছিল ফাঁসির মঞ্চ-  যেটা তাঁর জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। 

 

বলা আবশ্যক যে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রর জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। আর বঙ্গবন্ধুকেও সেই তখন থেকেই এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নামতে হয়েছিল। কখনো মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার, কখনো বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিচর্চার অধিকার এবং কখনো-বা বাঙালির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার। কেননা অবাস্তব ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ বা ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে পূর্ববাংলাকে জোর করে পাকিস্তানের অংশ করা হলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা যে এ দেশের মানুষকে ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে দেখে রাজনৈতিক জীবনের অজস্র তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই এটা তিনি জানতেন। 

কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু মহামূল্যবান তিনটি বই লিখে রেখে গেছেন আমাদের জন্য। বই তিনটি হলো: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন। আমি সবাইকে বইগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে বলবো। সেখানেই আমরা সত্যিকারের বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাবো। পাবো তাঁর স্বপ্নের আসল ছবিটি। তার চেয়েও মূল্যবান হলো, বাংলার একটি অখ্যাত গ্রামের খোকা নামের একটি ছেলে কীভাবে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা ও বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হলেন তার একটি নিখুঁত ছবি রয়েছে এসব গ্রন্থে- যা যুগ যুগ ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। 

বঙ্গবন্ধু কেন রাজনীতি করতেন? এ কথা দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা তাঁকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছেন। প্রতিবারই তিনি একটাই উত্তর দিয়েছেন। সেটি হলো, দেশের মানুষের প্রতি অন্যরকম এক ভালোবাসাই তাঁকে টেনে এনেছে রাজনীতির মাঠে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন: ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।

এটি কোনো সাধারণ বা লোকদেখানো ভালোবাসা নয়। শৈশবেই গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট দেখে তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠেছিল। লক্ষণীয় বিষয় হলো, তখনো তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি। কিন্তু বারবার তিনি দুর্দশাপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বাড়িয়ে দিয়েছেন মমতার হাত। কখনো নিজের গায়ের চাদর খুলে জড়িয়ে দিয়েছেন বস্ত্রহীন বন্ধুর গায়ে। কখনো-বা নিজেদের গোলাঘর খুলে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মাঝে বিলিয়েছেন ধান-চাল। সর্বোপরি, শিরোধার্য করেছেন কবিগুরুর সেই মন্ত্র: ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’ 

বস্তুত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়েই তিনি নজর কেড়েছিলেন অবিভক্ত বাংলার শীর্ষ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। এ মহান নেতার হাত ধরেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির হাতেখড়ি। তাঁকেই তিনি রাজনীতির গুরু হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে গুরুর সঙ্গেও আপস করেননি। নিজের জীবন বিপন্ন করে কলকাতার দাঙ্গাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অন্ন তুলে দিয়েছেন দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষের মুখে। সবই করেছেন বাংলার চির দুঃখী মানুষের প্রতি অদম্য ভালোবাসা থেকে। কোনো কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশা থেকে অবশ্যই নয়। তাঁর জীবনের ব্রত ছিল একটাই; আর সেটি হলো বাংলার ভূখানাঙ্গা মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বারবার বলেছেন সে-কথা।

বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে বহু আরাধ্য সেই স্বাধীনতা এলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য রাতদিন পরিশ্রম করলেন বঙ্গবন্ধু। নয়মাসের যুদ্ধে সর্বস্ব হারানো মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য হাতও পাতলেন বিশ্ববাসীর কাছে। আমেরিকাসহ কোনো কোনো দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও অনেক সাহায্যও এলো। ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াল বাংলাদেশ। সবই হলো কিন্তু দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটলো না। বন্ধ হলো না হাহাকার। বন্ধ হলো না শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়ন। 

বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছর দেখলেন। বিস্তর আবেদন-নিবেদন করলেন। কিন্তু ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’! কিছুতেই শোষক-নিপীড়ক ও লুটেরাদের হৃদয় গললো না। বঙ্গবন্ধু বুঝলেন, শুধু কথায় কাজ হবে না। এ ‘ঘুণে ধরা’ সিস্টেম বা সমাজ বদলাতে হবে। এবার তিনি ঘোষণা করলেন তাঁর যুগান্তকারী দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি। উদ্দেশ্য ‘মুক্তি’। যুগ-যুগান্তরের শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে মুক্তি। তিনি প্রচণ্ড আঘাত হানতে চাইলেন বহিরাগত ইংরেজ শাসকদের তৈরি করা নিপীড়নমূক প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর। বললেন, যাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি সারাজীবন সীমাহীন দুঃখকষ্ট ভোগ করেছেন, সেই গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারলে তিনি মরেও শান্তি পাবেন না। 

শোষক-নিপীড়ক ও লুটেরার দল খুব ক্ষেপে গেল। গোপনে গোপনে জোট বাঁধলো। ষড়যন্ত্র করলো। ভয়ানক ষড়যন্ত্র। তাতে হাত মেলালো দেশি-বিদেশি অনেক মীরজাফর। তারপর রাতের অন্ধকারে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল জাতির পিতার বুক। হিংস্র দানবের মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ঘুমন্ত সদস্যদের ওপর। তাদের বর্বরতা থেকে রক্ষা পেল না দশ বছরের নিষ্পাপ শিশু রাসেলও। সেই ভয়াল রাতে স্বদেশি বিশ্বাসঘাতকদের হাতে শাহাদত বরণ করলেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর দুই নিকটাত্মীয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মনিসহ মোট ১৮ জন। মুক্তির মন্দির সোপানতলে সেদিন যাঁরা আত্মবলিদান করেছেন, সেই রক্তরেখা ধরেই আমাদের পথ চলা। অনিবার্যভাবে পঁচাত্তরের দুঃসহ সেই শোক আজ পরিণত হয়েছে অপ্রতিরোধ্য এক শক্তিতে। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। সপরিবারে জীবন দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর সারাজীবনের যে স্বপ্ন- এ দেশের ভুখানাঙ্গা মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সেই স্বপ্ন থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। তিনি আমাদের শুধু স্বাধীনতাই এনে দেননি, একইসঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির বীজও বপন করে দিয়ে গেছেন। জাতির পিতার রক্তস্নাত সেই পতাকা এখন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যয়দীপ্ত হাতে। সে কারণেই জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা এখন আর দূরের কোনো স্বপ্ন নয়। পদ্মা সেতু সাক্ষী, দেশি-বিদেশি ঘাতক এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা যতই চোখ রাঙাক বাংলাদেশ ভয় পায় না। সব বাধা অগ্রাহ্য করে দৃপ্ত পায়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক। পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ঢাকা: ১১ আগস্ট ২০২৩