তেইশ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী ‘দেশীকোত্তম’ গ্রহণকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে দেশে কালে কালে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির ভাব গড়ে তোলার জন্য নিবেদিত হওয়ার কথা বলেছিলেন। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পূর্ণ হয়ে যাতে ওঠে, রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে সেই প্রার্থনা করেছিলেন। রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে নিজেকে সমাসীন করার জন্য প্রস্তুতি পর্ব সমাপন করে সম্মুখে শান্তি পারাবার নিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিজেকে প্রসারিত করেছেন বিশ্ব ভাবনায়।
বিশ্বজুড়ে দ্বন্দ্ব, হানাহানি, সংঘাত, সংঘর্ষের বিপরীতে শান্তির বার্তা তিনি ছড়িয়ে দিতে চান। তাই দেখা যায়, স্বদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্র তিনি যেমন সম্প্রসারণ করেছেন, তেমনি ফিলিস্তিনে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও তিনি সচেষ্ট। বিভিন্ন সময়ে মতামত তুলে ধরে তিনি দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। দেখতে পাই, বিশ শতকের শেষে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিক জান্তাদের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর সংহতির কথা তিনি তুলে ধরেছেন। বিশ্বের সামরিক জান্তা শাসকরা যেমন পাকিস্তানে তখন ক্ষমতা দখলকারি জান্তা শাসক পারভেজ মোশাররফ তাঁর এ বক্তব্য ভালভাবে নেননি। কিন্তু শেখ হাসিনা এসবে তোয়াক্কা করেননি মোটেও। নিজ দেশের সামরিক জান্তাদের দুঃশাসনে জনজীবন কিভাবে পদপিষ্ট হয়েছে, তা শেখ হাসিনার জানা। তাই নিজ দেশের সংবিধানেও সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বলবত করেছেন।
মূলত শান্তি ও সম্প্রীতিকামী শেখ হাসিনা সব সময় হিংসা পরিহার করে এসেছেন। প্রতিশোধের মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে নিজেকে নির্মমতার প্রতীক করে তোলেননি। হিংসাকে জয় করতে সব সময় তিনি সচেষ্ট। মানুষকে ভালোবাসার মধ্যেই রয়েছে হিংসার মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘বাংলা অভিধান ছাড়া আর কোন ভাষার অভিধানে পরশ্রীকাতর শব্দটি নেই।’ শেখ হাসিনা চাইছেন বাংলা অভিধান থেকেও যেন মুছে যায় এই শব্দটি। কিন্তু যে সমাজ বিদ্যমান, সেখান থেকে এসব ঝেঁটিয়ে বিদায় করা সহজ নয়। রবীন্দ্রানুরাগী শেখ হাসিনা কবিগুরুর মতো বিশ্বাস করেন, পৃথিবীজুড়ে একটি দেশ, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ মিলে একটি জাতি- এটি মেনে নিলে পৃথিবীর সকল মানুষই এক দেশের, এক জাতির মানুষ হবে। দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে বৈরিতা থাকবে না। অবশ্য শেখ হাসিনা এটাও জানেন, এ কথা শুনতে যত সহজ, কাজে তত নয়। খুব উঁচু দরের শিক্ষা সংস্কৃতি থাকলে তবেই লোকে এ কথার মর্ম বুঝবে। প্রতিটি মানুষকে তার নিত্যদিনের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সম্পর্কে নিশ্চিত করতে হবে। এসবের ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত হলে মানুষ হিংসা ও হানাহানি থেকে বেরিয়ে এসে শান্তি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধে আপ্লুত হবে।
নিজ দেশে শিক্ষার প্রসারে শেখ হাসিনা যুগান্তকারী নানা পদক্ষেপও নিয়েছেন। বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা যেমন করেছেন, তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকায়নও করেছেন। মানুষ ক্রমশ শিক্ষিত হয়ে উঠলে সে বিশ্বনাগরিকে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা যে সামনে এসে দাঁড়ায় না, তা নয়। এমনিতেই বিকারগ্রস্ত সমাজ সব কিছুকেই বিকৃত করে ফেলে। যার মাশুল বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক জান্তা শাসকরা ইতিহাসকে শুধু বিকৃত করেনি, সমাজকেও করেছে। ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র মানুষ অমিত শক্তির সম্ভার করে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির আর নেই। পাকিস্তানী হানাদারদের অস্ত্রবল হার মেনেছিল বাঙালীদের সংঘবদ্ধ শক্তিবলে। সেই দেশের জাতির পিতাকে হত্যা করে জান্তারা বিকৃত এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতা পরাধীনতার পথে নিয়ে গিয়েছিল। ৎ
শেখ হাসিনা সেই অবস্থা থেকে দেশকে স্বাভাবিক পথে শুধু নয়, স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে ক্রমান্বয়ে ফিরিয়ে এনেছেন। একাত্তরের পরাজিত শক্তির দেশকে হিংসায় উন্মত্ত করে তোলার বিষদাঁত ভেঙ্গে দিয়ে তাদের বিচারের আওতায় শুধু আনা নয়, সাজাও প্রদান করেছেন। অস্ত্র সম্ভারে সজ্জিত জঙ্গীদের নির্মূলে সাফল্য তাঁকে সাহসী করে তুলেছে। তাই এদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়ার জন্য তিনি বিশ্ববাসীর প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন। জঙ্গীবাদ যে মানুষের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে, বেঁচে থাকা ও স্বাধীনতার বিপরীতে মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল, শেখ হাসিনাই তা বিশ্ববাসীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। মৌলবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার অবস্থানও খুব দৃঢ়। জানেন তিনি, মৌলবাদ মানুষকে পশ্চাদপদ করে তোলে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যুগ তার এই উপলব্ধিকে দৃঢ় করেছে। সম্যক উপলব্ধিও রয়েছে যে, পৃথিবীব্যাপী বিরাট মুসলিম সমাজ শিক্ষায়-দীক্ষায় এমনিতেই পিছিয়ে আছে। এমনকি জ্ঞানে-বিজ্ঞানেও। সেখানে মৌলবাদীদের অপতৎপরতা তাকে আরও পেছনে ঠেলে দিতে সচেষ্ট।
শিক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়ের যে উচিত সর্বপ্রকারে এর প্রতিরোধ করা, সে মনোভাব তিনিও প্রকাশ করেছেন। এদের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলার জন্য ডাকও দিয়েছেন। এর মাধ্যমেই সুফল আনা সম্ভব- শেখ হাসিনা সেই বোধ থেকেই জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বাধিক সচেষ্ট। কারণ এসবের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এর সঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের প্রসঙ্গ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। কিন্তু মতলবীদের কুমতলব এবং ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটতে পারে, তা দেশবাসী ’৭১ এবং ’৭৫ পরবর্তীকালে দেখেছে।মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে এরা রাজনৈতিক কূটকৌশল হাসিলের জন্য ধর্মকে বর্ম করে রেখেছে। শেখ হাসিনা চান না বাংলাদেশ ধর্মীয় উগ্রবাদীদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হোক। এ দেশে সব ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিবেশে বসবাস করুক এটাই প্রত্যাশা। শেখ হাসিনা জানেন, ধর্ম হচ্ছে তাই, যা সকলকে ধারণ করবে। কিন্তু একালে ধর্মের কোপ পড়লে আর রক্ষা নেই। তার অনেক নজির এ সময়কালে এদেশেই মেলে। ধর্মান্ধ, জঙ্গী, ব্লগার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ শুধু নয়, এসবের নির্মূলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র বারবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে। এটা সত্য। অবৈধ দখলদাররা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে। সেই অবস্থান থেকে দেশকে উদ্ধার করার কাজটি শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির নেতৃত্বেই কেবল দেশ উন্নত হতে পারে দেশবাসী তা জানে। আর জানে বলেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে সাদরে বরণ করেছে। তাই দেখি, বঙ্গবন্ধু এবং পরবর্তীকালের শেখ হাসিনা রাজনীতিতে এমনভাবে বিরাজিত যে, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ক্রমশ চুপসে গেছে। অনেকে হারিয়ে গেছে, নিশ্চিহ্নও। ইতিহাসের কোথাও তাদের নাম চিহ্ন ঠিকুজি পাওয়া যায় না।
শেখ হাসিনা দেশনায়ক থেকে আজ বিশ্বনায়কে পরিণত হতে যাচ্ছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি বিশ্বের গাড়িতে নিজেকে সমাসীন করে তুলেছেন। এছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছে দেশ। বাংলাদেশ এখন অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বে দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
কাল ২৮ সেপ্টেম্বর, জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। জন্মদিনে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানাই। তিনি শতায়ু হোন, এই কামনা সবার। এমনিতেই শেখ হাসিনার মধ্যে একটা সহজ-সরল মহত্ত্ব রয়েছে, যা সকলের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা আকর্ষণ করে। তিনি সকলের কাছে নানা ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে জাগ্রত। বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, রুচিতে, চরিত্র মাধুর্যে, চিত্তের ঔদার্যে পিতৃ-মাতৃ শিক্ষার এমন শোভন এবং প্রসন্ন রূপ সচরাচর দেখা যায় না। শেখ হাসিনা তা ধারণ করেন। সর্বতোভাবে একটি বিদগ্ধ মন, একটি অত্যুজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সৌরভ চতুর্দিকে বিকীর্ণ হয়। নানা গুণে গুণান্বিত তিনি। সাহিত্যের শিক্ষার্থী যেমন তেমনি নিজেও ভালো লেখেন। শিল্পরসিক এবং বোদ্ধা, নিজে কখনও কখনও ছবিও আঁকেন। সঙ্গীতানুরাগী বলেই বাদ্যযন্ত্র চর্চা করেছেন কিছুকাল। গানের কণ্ঠও সুরেলা। অনেক বিষয়ে আগ্রহী হলেও রাজনীতি তাঁকে এসব বিষয়ে শ্রমসাধ্য অনুশীলনের সুযোগ দেয় না। শেখ হাসিনা সমগ্র জাতিকে নিষ্ক্রিয়তা, নির্জীবতা, বিমূঢ়তা থেকে মুক্ত করার জন্য দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। সংগঠক হিসেবে নিজ দলকে করে তুলেছেন গতিশীল।
শুধু বাংলাদেশ এবং বাঙালির মধ্যে শেখ হাসিনাকে দেখতে গেলে ছোট করে দেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বাঙালি পথিক এবং পুরো দেশের প্রতিনিধি। বহির্বিশ্বে বাঙালির অগ্রগতিকে তিনি যতখানি সামনে তুলে এনেছেন তা অতুলনীয়। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ দেশ এবং বাঙালিকে সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যাশী শেখ হাসিনা। রবীন্দ্রনাথের মতো শেখ হাসিনাও জানেন যে গাছে সুগন্ধ ফুল ফোটে, সে গাছে আহার্য ফল না ফললেও চলে। তাই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অগ্রগতির নায়ক শেখ হাসিনা বিশ্বনায়ক অভিধার দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন। যা জাতি হিসেবে বাঙালির জন্য গৌরবের।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটউট বাংলাদেশ (পিআইবি)