মতামত

বিশ্বশান্তির প্রধান প্রতিপক্ষ কে?

একটা অণুগল্পের মধ্য দিয়ে লেখাটার সূচনা করা যায়। গল্পটা এমন, এক গ্রামে এক ধূর্ত সিঁধেল চোর বসবাস করত। প্রতি রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকত তখন সে গায়ে-পায়ে তেল আর মুখে কয়লার কালি লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ত চুরির উদ্দেশ্যে। গ্রামের মানুষ সেই চোরের উপদ্রবে খুব অতিষ্ঠ থাকত। একদিন মধ্যরাতে সে যখন বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই পাশের বাড়ির একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে বের হলো। চোরটি প্রতিবেশীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিতে বুদ্ধি আটল। সে ফিসফিস করে প্রতিবেশীকে বলল, তোমার বাড়ির বাগানে চোর ঢুকেছে, তুমি তোমার দরজায় শক্ত হয়ে দাঁড়াও; আমি তাড়া করে ধরে আনছি। চোরের ভয়ে লোকটি নিজের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। আর সে চোর ধরার ভান করে প্রতিবেশীকে বোকা বানিয়ে নিজের চৌর্যকর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল এবং যথারীতি পাশের গ্রামের এক বাড়ি থেকে চুরি করে তবেই ঘরে ফিরল; এবং ফিরে এসে প্রতিবেশীকে বলল অনেক দৌড়ালাম রে ভাই, তবে ব্যাটা চোরকে ধরতে পারলাম না। ধরতে পারলে বুঝাতাম মজা—ব্যাটা চোর তোমার সাতদিন আমার একদিন। এই লেখার শেষাংশ মোরাল অব দ্য স্টোরির জন্য রইল।

বর্তমানে খুব অশান্ত পরিবেশ ও অশান্তিপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আমাদের বিশ্বজীবন। মোটাদাগে কয়েকটি ঘটনা এই পৃথিবীকে অভিশপ্ত করে তুলছে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট তন্মধ্যে একটি। যুদ্ধবিষয়ক সব আন্তর্জাতিক কনভেনশানকে পদপিষ্ট করে ইসরাইল নির্বিচারে গাজার নারী, শিশুসহ বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে তাদের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল কিংবা হাসপাতাল। এ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই কূটনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা নিয়ে ইসরাইলের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। সেসবের একটি হচ্ছে বাইডেন প্রশাসন মার্কিন নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরাইলপ্রীতির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, মার্কিন মুল্লুকে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দুই রাজনৈতিক দলের মাঝেই ইসরাইলের সঙ্গে সখ্য ও সান্নিধ্য বজায় রাখার একটা ধারাবাহিক প্রতিযোগিতা চলে যা তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পেরোনোর একটি কৌশল ও হাতিয়ার হিসেবে সর্বজ্ঞাত। আর এই কারণেই মানবাধিকারের মুখোশধারী দেশটির প্রশাসন এখন ইসরাইলের এই নগ্ন-হত্যাযজ্ঞে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। যদিও পশ্চিমা বিশ্বে মানবাধিকার শুধুই একটা রাজনৈতিক হিপোক্রেসি। তাছাড়া, যে দেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক ভিত্তি হয় অস্ত্র বিক্রি, সেদেশের মানবতাবাদ নাটক ছাড়া অন্যকিছু নয়।

তবে আজ যুক্তরাষ্ট্র একাই শুধু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী মানুষদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে না, জোটবদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক সংঘ ও সংস্থা এবং মিত্র দেশসমূহকেও জাতিরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে একটা কোমরভাঙা দেশ হচ্ছে কানাডা। বিত্ত-বৈভবের অভাব নেই তবুও এমনভাবে মার্কিন লেজুড়বৃত্তি করে যা কোনো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাইতো আমেরিকার নির্দেশে জাস্টিন ট্রুডো ইসরায়েলের পক্ষে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়েছে। ফলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন মুখ ও মুখোশের রাজনীতিতে আজ শান্তিকামী বিশ্ববাসী অতলান্তিক অনিশ্চয়তায় পর্যবসিত, যেখানে জীবনের চেয়ে মৃত্যুর নিশ্চয়তা প্রগাঢ়, যেখানে অর্থ ও আধিপত্যের বিনিময়মূল্য হচ্ছে জীবন।

গণমাধ্যম সূত্রে আরেকটি বিষয় জানা গেল—ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও শান্তিকামী মানুষের পক্ষে কথা বলায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে নানারকম নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বৃত্তি-তালিকা থেকে তাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তারা যাতে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানসমূহে চাকরি না পায় সে লক্ষ্যে তাদেরকে চিহ্নিত করে রাখা হচ্ছে। তালিকা পাঠানো হচ্ছে ওয়ালস্ট্রিট, সিলিকনভ্যালির মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানসমূহে। এটাই হচ্ছে ফ্রিডম অব স্পীচ-এর ওয়েস্টার্ন মডেল।

এ পর্যায়ে বিশ্ব থেকে একটু বাংলাদেশে দৃষ্টি দেওয়া যাক। অতিসম্প্রতি মার্কিন নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে ২ মাত্রার বাড়তি সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি দেখে হাসব নাকি কাঁদব বুঝে উঠতে পারিনি। সভ্যদেশের তকমাধারীদের এমন সভ্যতাবিবর্জিত কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসকে কিছুটা হাস্যরসের জোগান দিবে বলে বিশ্বাস করি। কারণ, একটি পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যেতে পারে যে, প্রতি বছর বাংলাদেশে কতজন বিদেশি নাগরিক অপঘাতে আহত কিংবা নিহত হন বা অন্য কোনোরকম অনিরাপদ পরিস্থিতির শিকার হন। আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছরে ঠিক কতজন বিদেশি নাগরিক সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলা বা গুলিতে আহত, নিহত হন। অবস্থাদৃষ্টে যে চিত্র পাওয়া যাবে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে যাবে না সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। প্রসঙ্গত, আমার পরিচিত কিংবা প্রিয় কেউ যুক্তরাষ্ট্রে গেলে আমি তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় থাকি। কারণ দেশটি পাকিস্তানের মতো করেই দিনদিন ঘরে-বাইরে অনিরাপদ হয়ে উঠছে। সে দেশের স্কুলে কিংবা পাবলিক প্লেসে যেভাবে অতর্কিত গণহত্যাযজ্ঞ চলে তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।

সে দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে নিরস্ত্র মানুষের প্রাণহরণের বিকৃত উল্লাসে মেতে ওঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ফলে যেখানে অন্যান্য দেশের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের ক্ষেত্রে স্ব-স্ব দেশের নাগরিকদেরকে সতর্ক করা সেখানে যুক্তরাষ্ট্রই উলটো সতর্কতা জারি করছে। তবে এক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের অপরিপরিপক্বতা ও বেশ দায়ী। বিভিন্ন দেশে পররাষ্ট্রনৈতিক বিষয়গুলো তারা যেভাবে এড্রেস করছে তা একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম সত্তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। ফলে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে মার্কিন বৈশ্বিকনীতি। তাছাড়া, বাইডেন প্রশাসন মোটাদাগে কূটনৈতিক গাম্ভীর্যতার সংকটে ভুগছে বলে মনে হয়। সে কারণে তাদের বালখিল্য আচরণ দেশে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে রসদ হিসেবে কাজ করছে।

প্রসঙ্গত মার্কিন পররাষ্ট্রনৈতিক দ্বিচারিতা বিষয়ে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। আমরা জানি যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৈশ্বিক ঘোষণা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গিবাদকে ভয় পায়—এমন একটি আচরণ তারা সব সময় প্রকাশ করে থাকে। যেমন—হলি আর্টিজানের ঘটনার পরে বাংলাদেশে অবস্থানরত দেশটির দূতাবাস বাড়তি নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করে; এবং বাংলাদেশ সরকারও চাহিদামাফিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। যদিও বাংলাদেশ জঙ্গিবাদকে ভয় পায় না, ঘৃণা করে এবং শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয় আঞ্চলিক জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বে সফলতম একটি রাষ্ট্র। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডগুলো দিনের শেষে জঙ্গিবাদীদের জন্য সুখকর হয়ে যাচ্ছে; সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো উসকানি পাচ্ছে। দেশটির এমন মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার সত্যিই উদ্বেগজনক। এটি সামগ্রিকভাবে টেকসই শান্তি ও শৃঙ্খলাকে বিপন্ন করে তোলে।

বিশ্ব আজ কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে। আজ মানবাধিকার পরিণত হয়েছে জরাজীর্ণ এক রাজনৈতিক পোস্টারে। মানুষের মানবিক অধিকার, জীবনাধিকার তথা রাষ্ট্রাধিকার হয়ে যাচ্ছে চুরি। শান্তির অধিকারে সোচ্চার হবার সাহসটুকুও নেই কারো কারো। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গল্পের সেই সিঁধেল চোরের মতো করেই সবকিছু করায়ত্ত করার নৈশযজ্ঞে লিপ্ত। তাইতো সব সময় নিজের মানবতাবিরোধী চরিত্র আড়াল করতে অন্য দেশের মানবাধিকার নিয়ে ভ্রকুঞ্চিত চিন্তার মুখোশ পরে থাকে দেশটি। সবক দেয় মানবতার। অথচ বিশ্বশান্তির প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে নানা সময়ে, নানা রূপে এবং নানা চরিত্রে দেশটির আবির্ভাব ঘটেছে এবং ঘটছে। মোদ্দাকথা, দেশটির নানামাত্রিক নেতিবাচক কর্মফলে বিশ্বশান্তি আজ বিপন্নপ্রায়। এমন পরিস্থিতিতে সম্মিলিত প্রত্যাখ্যানই হতে পারে এই সংকট উত্তরণের সরলতম সমীকরণ। উল্লেখ্য, অধ্যাপক স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের ভবিষ্যদ্বাণী যদি সত্যি হয়, তাঁর ‘ক্লাশ অব সিভিলাইজেশান’ তত্ত্বানুসারে যদি মুসলিম সভ্যতার সঙ্গে চৈনিক সভ্যতার রাজনৈতিক সমীকরণ মিলে যায় তাহলে মার্কিন আধিপত্যবাদের পতনধ্বনি বাজতে মনে হয় খুব বেশি সময় নিবে না।

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক