জেল হত্যাকাণ্ডকে অনিবার্য করে তুলেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারীরা। তারা এই ধারণা করেছিল যে, কারাগারে আটক জাতীয় নেতাদের বেশিদিন আটক রাখা যাবে না। জনগণ তাদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠবে। খুনিদের নেতা খন্দকার মোশতাক তার অবস্থান সংহত করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী নেতা, যারা একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও দেশকে হানাদার মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করছেন, তারা তাদের জন্য শঙ্কার কারণ হয়ে উঠবে। জেল হত্যার পরিকল্পনাকারীরা দ্রুত সিদ্ধান্ত যে নিয়েছে তা তাদের কার্যক্রমে স্পষ্ট হয়েছে। খুনিরা হত্যার পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। তাদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। জেল হত্যার বিচার হয়েছে কিন্তু হত্যার ষড়যন্ত্র নিরুপণ হয়নি। যা এখনও অপরিহার্য।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ দেখেছে সপরিবারে জাতির পিতা এবং জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা। দেখেছে ক্ষমতার পালাবদল, সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা, হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিনাশী প্রক্রিয়া। কলঙ্কময় নানা ঘটনায় প্লাবিত পঁচাত্তর বাঙালি জাতির জীবনেও এনে দিয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অধিকাংশ বিদেশি সাংবাদিককে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। হত্যাকাণ্ডের ৫ দিন পর ২০ আগস্ট কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ব্যাংকক থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে সক্ষম হন। ২২ আগস্ট তাদের ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ৪৮ ঘণ্টা ঢাকা অবস্থানকালে তারা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের বাইরে যেতে পারেননি। তারা সামরিক বাহিনীর কথিত অভ্যুত্থানের খবর পেতেন স্থানীয় সাংবাদিক আতিকুল আলমের মারফতে।
একই অবস্থা তৈরি হয় ৩ নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনার পূর্বাপর সময়ে। বিদেশি সাংবাদিকদের নির্ভর করতে হয় এই আতিকুল আলমের ওপর। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ওপর গুলি নিক্ষেপের দশ মিনিট আগে আতিকুল আলম রয়টার্সে সংবাদ পাঠায়, ‘বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন।’ সেই সময় আতিকুল আলম ছিলেন রয়টার্স ও বিবিসির স্থানীয় সংবাদদাতা।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর একদিকে জেলহত্যা, অপরদিকে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। অভ্যুত্থানকারীরা তাদের সপক্ষে কোনো প্রচার-প্রচারণা চালায়নি। বেতার কেন্দ্রেও ঘোষণা দেয়নি। ফলে গুজব আর গুজবে সয়লাব হয়ে পড়ে দেশ। খন্দকার মোশতাক তখনো ক্ষমতায়। খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। আপস-আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করছিলেন খন্দকার মোশতাক চক্র। খালেদ মোশাররফবিরোধী অন্যান্য শক্তিও দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে দ্রুত যোগাযোগ করে পাল্টা অভ্যুত্থানের জন্য চেষ্টা করতে থাকে। সে সময় জেনারেল ওসমানী সেনাবাহিনীতে কর্মরত মুক্তিবাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের, জনৈক ‘বাচ্চু করিম’ পাকিস্তান প্রত্যাগত পাকিস্তানপন্থি সিপাহিদের এবং কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীতে জাসদপন্থি সিপাহিদের অভ্যুত্থানের ব্যাপারে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালাতে থাকেন। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন ও পাকিস্তানপন্থি শক্তিগুলো সর্বাত্মক অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিল। জাসদও এই প্রচারাভিযানে শামিল হয়। ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য শহর ও বন্দরে জাসদ একটার পর একটা প্রচারপত্র বিতরণ করতে থাকে যে, ভারতের প্ররোচনা ও অর্থায়নে খালেদ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে।
আতিকুল আলম বিদেশি সংবাদমাধ্যমে যেসব সংবাদ দিতেন তাতে সত্যতার লেশ ছিল নামমাত্র। তার তথ্যসূত্রে ঢাকা থেকে পাঠানো খবরের বরাত দিয়ে পঁচাত্তরের নভেম্বরে মার্কিন ও ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা প্রচার করতে থাকে যে, ‘নিহত হওয়ার আগে জেলখানায় আটক নেতারা খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান ঘটানোর পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ডেকে এনে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিলেন।’
লন্ডনের ‘অবজারভার’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ মুজিব হত্যার পেছনে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ ছিল না। কিন্তু ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাকবিরোধী অভ্যুত্থানের সমর্থনে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের চার মাইল ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল।’
বিভিন্ন বিদেশি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এসব খবরাখবর বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। বাস্তবতায় দেখা যায়, দেশি-বিদেশি সুপরিকল্পিত এসব প্রচারাভিযানের মোকাবিলায় রাজনৈতিক লক্ষ্য ও সম্পর্কহীন খালেদ মোশাররফ এবং তার সমর্থকদের কার্যকর কোনো প্রচার তৎপরতাই ছিল না। ফলে জনগণ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে একতরফা প্রচারণায় স্বভাবতই সৃষ্টি হয় মারাত্মক বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তির সুযোগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়ে মঞ্চে ও নেপথ্যে সর্বাত্মক তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে জাসদের গণবাহিনী। বাহিনীপ্রধান কর্নেল তাহেরের সহায়তায় তারা সেনাবাহিনীতে ‘শ্রেণি সংগ্রাম ও বিপ্লব’-এর মন্ত্র ছড়িয়ে দেয়। প্রচারপত্র বিলি করে। যাতে উল্লেখ ছিল, ‘অফিসাররা ক্ষমতা ও পদের লোভে অভ্যুত্থান ঘটাচ্ছে। আর প্রাণ দিচ্ছে সাধারণ সিপাহিরা। নিগৃহীত, অধিকারবঞ্চিত সিপাহিরা আর কামানের খোরাক হবে না। সিপাহি-জনতার ভাগ্য এক। তাই সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমেই ক্ষমতা দখল করতে হবে। সুতরাং বিপ্লবের জন্য, শ্রেণি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হউন।’
আতিকুল আলম ওই সময়ে গণবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েও প্রচার চালান। ৭ নভেম্বর জাসদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের পর আতিকুল আলম পালিয়ে লন্ডন যান। জাসদের অভ্যুত্থানকারীদের পরাজয় হওয়ার পর আতিকুল আলম ঢাকায় ফিরে আসেন। তখন থেকে তিনি জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনকে খোলাখুলিভাবে সমর্থন করতে শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে আতিকুল আলমকে ১৯৭২ সালের গোড়ায় গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালাতেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি দাবি করেন, ‘পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করতে তাকে বাধ্য করা হয়’। বিনাবিচারে কয়েক মাস কারাবাসের পর সাংবাদিক এবিএম মূসা ও ফয়েজ আহমদ মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে তদবির করেন। ফলে তিনি মুক্তি পান। মুক্ত হওয়ার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধপন্থি সাংবাদিক- শিল্পপতি আবিদুর রহমানের দৈনিক ‘দি পিপল’ পত্রিকায় যোগ দেন। বিবিসি ও রয়টার্সের সঙ্গে তার সম্পর্ক তখনো বজায় থাকে।
১৯৭৫ সালে জেলহত্যার ইন্ধনদাতা ছিলেন আতিকুল আলম। প্রচার করেন যে, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ দখল করে তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী করবে’। বিদেশি সাংবাদিকদেরও এই তথ্য দেন। ৪ ও ৫ নভেম্বর আতিকুল বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনৈতিকমহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি তথাকথিত গোপনীয় চিঠি প্রদর্শন করেন। চিঠিটি ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন’ বলে তিনি দাবি করেন। ঢাকায় নিয়োজিত ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনের কাছে লেখা চিঠিতে নাকি অভ্যুত্থান পরিচালনের পরিকল্পনা এবং এ সম্পর্কিত আয়োজনের কথা উল্লেখ করা হয়। জার্মান দূতাবাসের কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের চিঠিখানা দেখিয়ে আতিকুল অবিচলিতভাবে দাবি করেন, ‘তাজউদ্দীনের স্বহস্তে লিখিত এই চিঠি’। যা খালেদ মোশাররফ কর্তৃক সম্পন্ন অভ্যুত্থানের সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জড়িত বলে প্রমাণ করে। বিদেশি কূটনীতিকদের আতিকুল জানান, ভারত সমর্থক তাজউদ্দীন আহমদকে জেল থেকে বের করে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত করাই এই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য। আতিকুলের এই চিঠি প্রদর্শনের ফলে অভ্যুত্থানের সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ জড়িত বলে দূতাবাস এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে। আতিকুল আলমের ছড়ানো গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে মোশতাক এবং তার সহচর ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা জেলখানায় তাজউদ্দীনসহ চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেন।
এই ঘটনার তিন বছর পর লন্ডনে সাংবাদিক লরেন্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আতিকুল জানান, তাজউদ্দীনের চিঠি যেখান থেকে তিনি পেয়েছিলেন, সেখানে ফেরত দেয়া হয়েছে। এবং চিঠির সত্যতা প্রমাণ করার জন্য তিনি কোনো কপি রাখেননি। তা সত্ত্বেও চিঠিটি একান্তই খাঁটি বলে তিনি দাবি করেন। আতিকুলের কর্মকাণ্ডের সমালোচক সাংবাদিক সহকর্মীরা দাবি করেন, পুরো ব্যাপারটি বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা ছাড়া আর কিছু নয়।
আতিকুল আলম বানোয়াট কাহিনি প্রচার করে এই হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন জুগিয়েছেন, এমন অভিযোগ আসে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। জেলহত্যা মামলা শুরু হলে তাতে তার নামও উঠে আসে। তখন আতিকুল আলম লন্ডনে পালিয়ে যান। ২০০১ সালে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবারও দেশ ত্যাগ করেন। ২০১৪ সালে তিনি ঢাকায় ফিরে ‘অর্থনীতি প্রতিদিন’ নামে একটি দৈনিকের ডিক্লারেশন নেন। তিনি প্রথমে এর সম্পাদক, পরে প্রধান সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
লেখক: মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক