মতামত

জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশে সম্মেলনের সফলতা নিয়ে সংশয়

আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসছে ২৮তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। যা ইউনাইটেড ন্যাশনস্ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) কনফারেন্স অব পার্টিস বা কপ নামে পরিচিত। এবারের কপ-২৮ সম্মেলনটি দুবাইয়ের দক্ষিণ অংশের শহর এক্সপো সিটিতে অনুষ্ঠিত হবে। ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড ফেয়ার এক্সপো’র জন্য এই শহরটি তৈরি করা হয়েছিল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিরোধে সারা পৃথিবী যখন জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্পের উপর জোর দিচ্ছে, সে সময়ে জীবাশ্ম জ্বালানী উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সংযুক্ত আরব আমিরাতে এমন একটি সম্মেলনের আয়োজন নিয়ে বিতর্ক যেমন রয়েছে, তেমনি এর সফলতা নিয়েও সংশয় রয়েছে। 

বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ সেন্টিগ্রেডের বেশি বৃদ্ধি রোধ করতে প্যারিস চুক্তির যে লক্ষ্য রয়েছে তা ‘ছিনতাই’ হয়ে যেতে পারে।

একটি বৃহত্তম জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশে কপ-২৮ সম্মেলনের আয়োজনের বিরোধিতা করে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের এই প্রতিবাদের মধ্যেই সংযুক্ত আরব আমিরাত এমন একজন ব্যক্তিকে কপ-২৮-এর চেয়ারপার্সন মনোনীত করেছেন, যিনি নিজেই একটি তেল কোম্পানির সিইও। ওপেক সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাদের কাছে মজুত আছে ১১১ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ১০০ কোটি ব্যারেল তেল। দিনে তারা উৎপাদন করে ২৭ লাখ ব্যারেল তেল। যার বেশিরভাগই (২৩ লাখ ব্যারেল) বিদেশে রপ্তানি করে।

আসন্ন কপ-২৮ সম্মেলনের সভাপতি সুলতান আল জাবের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি বা অ্যাডনকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। একই সঙ্গে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড অ্যাডভান্স টেকনোলজির মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ইউএই’র জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক বিশেষ দূত। ইতিপূর্বে তিনি সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন ছাড়াও একাধিক জ্বালানি কোম্পানিতে কাজ করেছেন। তার এই নিয়োগের সমালোচনা করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, গ্রিন পিস, ক্রিশ্চিয়ান এইডসহ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা বড় সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থাগুলো। 

পঞ্চাশ বছর বয়সী আল জাবের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি বৃত্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি, কভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসা ও অর্থনীতিতে পিএইচডি এবং লস অ্যাঞ্জেলসের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেছেন। লেখাপড়া শেষে দুবাইয়ে ফিরে এসে তিনি অয়েল কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। আল জাবের ২০০৬ সালে শুরু হওয়া মাসদারের প্রতিষ্ঠাতা সিইও ছিলেন এবং ২০১৪ সালের মার্চে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে মাসদার তেলের উপর দেশের নির্ভরতাকে বহুমুখী করতে এবং কূটনৈতিক প্রভাব অর্জনের জন্য নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের প্রসার ঘটান। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ মাসদার ৪০টিরও বেশি দেশে বিনিয়োগ করে। তার নেতৃত্বে মাসদার একটি বৃহত্তর কোম্পানিতে পরিণত হয় এবং অ্যাডনক, টাকো এবং মুবাদালাকে এর শেয়ারহোল্ডার হিসাবে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।

পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে কাজ করা সুলতান আল জাবেরের নিয়োগ সম্পর্কে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ‘বৃহত্তর জীবাশ্ম জ্বালানি স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করবেন তিনি এবং এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্যকে ছিনতাই করবেন। কারণ, তিনি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল কোম্পানির সিইও এবং যে কোম্পানি জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করে চলেছেন।’ 

ক্রিশ্চিয়ান এইড বলেছে, ‘তার এই নিয়োগে স্বার্থের সংঘাত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’ গ্রিনপিস বলেছে, ‘এই নিয়োগে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু আলোচনায় জীবাশ্ম জ্বালানী শিল্পের জন্য কোনও স্থান নেই।’ ইউএস সিনেটর এড মার্কি সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন আয়োজন করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে প্রতিশ্রুতির প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘আন্তরিকতা’ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ১৩০ জন মার্কিন আইন প্রণেতা এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা সুলতান আল জাবেরকে কপ-২৮ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারণের আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ, নিন্দা কিংবা দাবীর প্রতি কর্ণপাত না করেই সংযুক্ত আরব আমিরাত আল জাবেরকেই যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে সম্মেলনের সভাপতি মনোনয়ন দিয়েছেন। ২০০৯ সালে আল জাবেরকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন তার শক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের উপদেষ্টা গ্রুপে (এজিইসিসি) নিযুক্ত করেছিলেন। একই বছরে, মাসদারের সিইও হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থার (আইআরইএনএ) সদর দপ্তরকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আনতে সাহায্য করেন। আল জাবের ২০২২ মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য একটি বৈশ্বিক পদ্ধতির পক্ষে ওকালতি করেছেন। তিনি জাতীয় হাইড্রোকার্বন উৎপাদকদের শক্তির পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন, যুক্তি দিয়েছেন যে অদূর ভবিষ্যতের জন্য সর্বনিম্ন কার্বন-নিঃসরণ করে এমন জ্বালানি উৎপাদনের প্রয়োজন হবে।

আল জাবের নিজেকে এমন একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরছেন যিনি জীবাশ্ম জ্বালানি সংস্থাগুলোকে তেল এবং গ্যাসের ব্যবহারে ‘ফেজ ডাউন’ নিয়ে আলোচনার টেবিলে রাখতে পারেন বলে দাবি করছেন। অথচ তার এই অবস্থান বিতর্কিত। অনেক দেশই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে সময়সীমা আরও সংক্ষিপ্ত করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া, প্রতিবাদ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ঘিরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিধিনিষেধমূলক আইন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বজুড়ে সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। সাধারণত জলবায়ু সম্মেলনের সময় স্বাগতিক দেশে বড় বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। অক্টোবরের শুরুতে, যুক্তরাজ্য জাতিসংঘে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে আশ্বাস চেয়েছিল যে, কীভাবে শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে সংযুক্ত আর আমিরাত মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং জমায়েত নিশ্চিত করবে।

এতসব বিতর্কের মধ্যেই কপ-২৮ সম্মেলনে বরাবরের মতো এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করা ১৯৮টি দেশের শীর্ষ নেতারা দুবাইয়ে একত্রিত হয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়নরোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নিয়ে কথা বলবেন। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা হবে। এ ছাড়া, প্রথমবারের মতো গ্লোবাল স্টকটেক নিয়ে মূল আলোচনার হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ রাষ্ট্রগুলো কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা এবং পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের অন্তরায়গুলোও চিহ্নিত করা হবে। প্যারিস চুক্তির সামগ্রিক বাস্তবায়নের বিষয়ে একটি রেজুলেশন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তার একটি প্রতিশ্রুতি নেওয়া হবে। এ ছাড়া, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করা, জলবায়ু অর্থ ব্যবস্থার রূপান্তর, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জনগণ এবং প্রকৃতির ভূমিকা এবং নারী, আদিবাসী, স্থানীয় সম্প্রদায়, তরুণদের শীর্ষ সম্মেলনে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার বিষয়েও সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হবে। 

গত বছর মিশরের শার্ম আল শেখে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ সম্মেলনে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত হওয়া ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ চুক্তির কার্যকারিতা বিষয়েও আলোচনা হবে। উন্নয়নশীল ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে এ তহবিলে অর্থায়নের বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করা হবে। প্রতিবছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত, উন্নয়নশীল ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ২০২৩ সালে এসেও আদায় করা সম্ভব হয়নি। আর এ নিয়ে প্রতিবছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। এবারও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না। কপ-২৮ সম্মেলনের আয়োজক দেশ ও প্রেসিডেন্সি নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কের মধ্য দিয়ে এই সম্মেলন কতোটা সফলতা লাভ করবে তা এখনই বলা না গেলেও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত কঠিন হবে- তা বলাই যায়।

লেখক: সেক্রেটারি জেনারেল, সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট‘স ফোরাম (সাকজেএফ)