নিজে কী, নিজের পরিচয় কী হওয়া উচিত— এমন চিন্তা বাঙালি সব সময় কমই করেছে। এ মাটিতে জন্মগ্রহণ করেও এ মাটিকে আপন করে নিতে বা নিজের মনে করতে বাঙালি সবসময় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ও হীনমন্যতায় ভোগে। আত্মপরিচিতির এই সঙ্কট নতুন কিছু নয়। এক সময় হিন্দু সমাজব্যবস্থায় এমনটা লক্ষণীয় ছিল, যারা উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ অর্থাৎ যারা কনৌজ-মিথিলা বা উত্তর ভারত থেকে এসেছে, তারাই সমাজে বেশি সম্মানিত। যে কারণে উত্তর ভারত থেকে আসা প্রমাণিত করার প্রতিযোগিতা বাংলায় লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজ আমলে এই বংশ পরিচয় চরম আকার ধারণ করে। বর্তমানের ফটোকপির দোকানের মত কলকাতায় গড়ে ওঠে অনেক বংশতালিকা লিখে দেওয়ার দোকান। ঐসব দোকানে গিয়ে ৩/৪ পুরুষের নাম বলতে হত। তারপর তারা বংশ তালিকা তৈরি করে দিত। বেশি টাকা দিলে উত্তর ভারতের সাথে মিলিয়ে বড় বংশ আর কম দিলে অপেক্ষাকৃত ছোট বংশ।
তবে, আধুনিক নানা ধরনের নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় এই ধরনের প্রচলিত ধারণার বিতর্ক অনেকটা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলার ব্রাহ্মণদের খুবই কম উত্তর ভারতীয় জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল রয়েছে, তাদের বেশির ভাগ বৈশিষ্ট্য বাংলার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিল দেখা যায়। খোদ ব্রাহ্মণদের যখন এই অবস্থা তখন অন্যান্য জনগোষ্ঠীর অবস্থা কেমন তা একটা চিন্তার বিষয়।
আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থাও বেশ খারাপ। সেই অনেক পূর্ব অনেকের ভাবখানা এমন ঐ যে গানে আছে ‘ইরান-তুরান (মধ্য এশিয়া) পার হয়ে এসেছি’। বাজারে প্রচলিত গৎবাঁধা ব্যাখ্যাগুলোর একটি পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হয়েছে অভিবাসনের কারণে। অর্থাৎ ইরান, তুরান (মধ্য এশিয়া) ও আরব থেকে এসে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে। তবে, সম্প্রতিকালে হাড়গোড় ও অন্যান্য আধুনিক নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি বাঙালি মুসলিমদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য তাদের প্রতিবেশী হিন্দু ও বাংলার স্থানীয় অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে সিংহভাগ মিল। ইরান, তুরান (মধ্য এশিয়া) ও আরবের জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের খুব কমই মিল রয়েছে। বাজারে প্রচলিত গৎবাঁধা ব্যাখ্যাগুলোকে আরও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটন। যিনি রিচার্ড এম ইটন নামে পরিচিত। দীর্ঘ গবেষণার পর ১৯৯৩ সালে ‘রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার-১২০৪-১৭৬০’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কীভাবে মুসলমান হয়েছিল তিনি তার গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন।
এ উপমহাদেশের বিভিন্ন লাইব্রেরি, তথ্যশালা, ট্রেজারির পুরাতন দলিল-দস্তাবেজ পর্যালোচনা করে এবং যুক্তিতর্ক ও তথ্যের মাধ্যমে তিনি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মোঘল আমলেই বাংলাতে মুসলিম জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে, যখন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লোকেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন ইসলাম ধর্মের শুরুতেই (৬১০ সাল) বাংলায় ধর্মটি এসে পৌঁছায়। বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলার অংশবিশেষ অধিকার করার পর এদেশে মুসলমানদের আগমন এবং তাদের বসতি স্থাপন করা আরও বেড়ে যায়। পরবর্তীতে মুসলিম শাসকরা প্রায় ৫০০ বছর বাংলা শাসন করলেও প্রথম ৪০০ বছরে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল খুবই অল্প, তা কোনভাবেই ১০ শতাংশের বেশি ছিল না। মোঘলদের বাংলা জয়ের পর বিশেষ করে সম্রাট আকবরের (১৫৭৫ সালের পর) সময় থেকে মুসলিম জনসংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। ভারতের সীমান্তে থাকায় বাংলায় মোঘলদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য মোঘলদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্রেণির লোক এখানে বসতি স্থাপন করে বা একটা শ্রেণি তৈরি করা হয়, যাদের আমরা পীর, সূফী, দরবেশ, ধর্মপ্রচারক বলে থাকি। মোঘলদের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে এই ধর্মান্তর ঘটেছে, আর এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে প্রকৃতি। এই সময়ই স্থানীয় অন্ত্যজ শ্রেণির লোকেরা সংগঠিত কৃষি কাজের সাথে সংযুক্ত হতে যেয়ে ঘটনাক্রমে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুসলমান হয়েছে বলে তিনি যুক্তি দেখান।
মার্কিন গবেষক ইটনের মতে, বহিরাগত বা তাদের বংশধরদের মাধ্যমে বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠী বেড়েছে ঠিকই; তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। পূর্বে যেসব বহিরাগত মুসলিমরা এসেছিল তারা ছিল মূলত নগরকেন্দ্রিক। পুরনো রাজধানীগুলোর চারদিকে জড়ো হয়ে বা অন্যান্য নগর ও তার আশপাশে তারা বসবাস করত। তারা প্রত্যন্ত গ্রামে যেত না এবং পেশা হিসাবে কৃষি ছিল তাদের অপছন্দের। মুসলিম জনসংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে যখন বদ্বীপের পাললিক সমতলের, নিভৃত পল্লির সুবিপুল অন্ত্যজ শ্রেণির বাঙালি দরিদ্র লোকেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা শুরু করে।
তিনি এটাও দেখানোর চেষ্টা করেছেন, বহিরাগত যেসব মুসলিমরা বাংলায় এসেছিলেন, তাদের বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি করে উপার্জন করে ফিরে যেতেন। কেননা দুর্গম বাংলা বসবাসের অনুপযোগী ছিল।
তবে দুর্ভাগ্য যে, আমাদের অনেকে এক সময় নিজেদের ইরান-তুরান–আরব-বাগদাদের পীর-ফকির, রাজাবর্গ ও তাদের অনুচর ও সিপাহীদের বংশধর প্রমাণে মহাব্যস্ত ছিল। এমনকি, নিজেদের পূর্বপুরুষ, ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েছিল।
বাংলা ভাষার অবস্থা যখন প্রকট ও শোচনীয় তখন এক সময় কবি আবদুল হাকিমকে লিখতে হয়েছিল ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’।
আত্মপরিচয়ের সংকট ও দৃঢ়তার ব্যাপারে হীনমন্যতা থাকলেও বাঙালিরা পূর্বপুরুষের ভাষা ত্যাগ করতে পারেনি। বহুবার চেষ্টা হয়েছে বাংলার পরিবর্তে ফার্সি অথবা উর্দু প্রচলনের; শেষমেশ না হয় আরবি হরফে বাংলা লেখার। কোনটা-ই সফল হয়নি, কেননা বাংলা কোন সময় রাজা-বাদশা, উজির-নাজির বা উচ্চ শ্রেণির ভাষা ছিল না। বাংলা ছিল পথে, মাঠের, আমজনতার ভাষা। যে কারণে উপরের দিকে পরিবর্তন হলেও নিচের দিকে তেমন প্রভাব পড়েনি। ইংরেজ আমলে মুসলিম সমাজের নেতাদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে একটি বড় ত্রুটি লক্ষণীয় ছিল।
শিক্ষা-ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৮২ সালে হান্টার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনে একটা সুপারিশ জমা পড়েছিল যার অর্থটা ছিল এমন ‘বঙ্গের মুসলমানেরা উর্দু ভাষায় কথা বলে আর পূর্ব বঙ্গের চাষা ও নিম্নশ্রেণির লোকেরা বাংলা নামের একটি ভাষায় কথা বলে’। এবং পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের উর্দু ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব এমনিতেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেয়নি, এর পেছনে ছিল অনেক বঙ্গীয় সন্তান। খাজা নাজিমুদ্দিন ও নুরুল আমিন সাহেবরাই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। আমাদের অনেক বড় বড় নেতাদের বাঙালি চেতনা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে বাইরে বাংলা ভাষা ব্যবহার করলেও বাড়ির ভেতরে উর্দু চর্চা ধরে রেখেছিল।
আশা করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের পর বাঙালি ছাড়া অন্য কিছু ভাবার প্রবণতা শেষ হবে, কিন্তু সেটা হয়নি। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের চরিত্রে পরিবর্তন আসেনি। আদালত, আমলা থেকে বড় ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবীর লোক, এমনকি, সরকারের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের বাংলা ভাষা চর্চা ও জ্ঞান নিয়ে বিতর্ক আছে। আত্মপরিচয় ও রুচিবোধের ক্ষেত্রে ধর্ম এক সময় বেশি প্রভাব বিস্তার করলেও স্বাধীনতার পর এর প্রভাব কমতে শুরু করে। নতুন করে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। তাদের মধ্যে এখন ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’ দেখা দিয়েছে। পাঁচ বছরের শিশুর মুখ থেকে ২/১ লাইন ভুলভাল ইংরেজি শোনাকে বিশাল কাজ মনে করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশে বা অন্য কোনও দেশে বসবাস করা বা আসা-যাওয়া অনেক সম্মানের ও আভিজাত্যের ব্যাপার। যাদের ঐসব দেশের নাগরিকত্ব, সার্টিফিকেট ও ব্যবসা আছে, তারা সমাজে অনেক সম্মানিত। তাদের কাছে বরফাচ্ছন্ন পরিবেশ, ম্যাপল গাছ, ম্যাকেঞ্জি আর অটোয়া নদী অনেক গৌরবের। তাদের কাছে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনালু আর কদম কোন ফুলের মধ্যে পড়ে না। পদ্মা, মেঘনা, রূপসা, কোনও নদীর মধ্যে পড়ে না!
শুধু পরিচয়ের ক্ষেত্রে সংকট তা নয়, এ দেশের সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। নিদিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে ঐসব দেশের নাগরিকত্ব লাভ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় গড়ে উঠেছে বেগমপাড়ার মত অভিজাত এলাকা। এসব এলাকায় বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইংরেজরা এক সময় জাহাজ ভর্তি করে এদেশ থেকে ধনসম্পদ নিয়ে যেত। আর এখন আমরা নিজেরাই বহন করে তাদের দিয়ে আসছি, যাকে বলা হয় ‘Self colonization’ অর্থাৎ নিজেরাই দাসে পরিণত হওয়া।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ইউরোপ-আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুই শ্রেণির বাঙালি জনগোষ্ঠীর লোক দেখা যায়। অনেকে কর্মসংস্থান ও শিক্ষালাভের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে এবং তারাই তাদের উপার্জিত অর্থের একটা অংশ নিজেদের জীবনধারণের জন্য রেখে বাকিটা দেশে পাঠিয়ে দেয়। তারা অনেক কষ্ট করে ঐসব দেশে টিকে থাকে। তারা মূলত দেশের কৃতি সন্তান। তবে অন্য অংশ দেশের জন্য অনেক ক্ষতিকর। তাদের আয়ের উৎস বাংলাদেশ। তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা পাচার করে ঐসব দেশে নিয়ে যায়। তাদের স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের ঐসব দেশে পাঠিয়ে দেয়, মাঝেমধ্যে নিজেরা গিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করে। অভিযোগ রয়েছে, বিনিয়োগ ভিসায় কানাডায় সবচেয়ে বেশি নাগরিকত্ব পেয়েছে বাংলাদেশিরা।
এই সংস্কৃতিকে বেগবান করতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে অনেক ইংরেজি বিদ্যালয় বা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমানে এর প্রভাব অনেক বেশি। অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের সাহেব বানানোর বাসনায় গুচ্ছের টাকা খরচ করছেন, খেয়ে না খেয়ে সেসব বিদ্যালয়ের খাতায় তাদের সন্তানদের নাম লেখাচ্ছেন। এই দলে কে-না নেই?
এখন শুধু রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বড় শহরে নয়; ছোট শহর, মফস্বল ও গ্রামগুলোতে গড়ে উঠছে এ ধরনের বিদ্যালয়। এর ফল যা হবার, তা-ই হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে, যারা না পারে বাংলায় কথা বলতে, পড়তে ও লিখতে, না পারে ইংরেজি। বাঙালির অনেক চিরন্তন ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও আচারপ্রথার প্রতিও নেই তাদের বিন্দুমাত্র অনুরাগ কিংবা শ্রদ্ধাবোধ। উল্টো রয়েছে এক ধরনের অবজ্ঞা ও উপেক্ষার মনোভাব।
ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং এই ভাষার প্রয়োজন অপরিহার্য। তবে এই নয়, শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিতে হবে। মাতৃভাষা ছাড়া কোনও কিছু আয়ত্ত করা খুবই কঠিন। ফলে শিশুরা ভালভাবে ইংরেজি-বাংলা কোনটাই শিখতে পারছে না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান টবের গাছ অথবা শিকড়বিহীন (trees without roots) তৈরির কারখানায় পরিণত হচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। মাতৃভাষা আয়ত্ত করার পর অন্য ভাষার শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এর উদাহরণ হতে পারে, আমাদের মত ইংরেজি নিয়ে মাতামাতি হয় না। তাছাড়া ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ায় সময় আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে তা যেন বাংলাবিদ্বেষী ও বাংলাবিনাশী না হয়ে ওঠে।
একটা কথা প্রচলিত আছে, যে জাতি কবি সৃষ্টি করতে পারে না, সে জাতি কোন দিন উন্নতি করতে পারে না। আমরা সেটা পারছি কিনা এখন দেখার বিষয়। এদেশে ফার্সি, উর্দু, সংস্কৃতি, আরবি, ইংরেজি কম চর্চা হয়নি। ফার্সি প্রায় ৫০০/৬০০ বছর রাজভাষা ছিল। তবে শোনা যায়নি ঐসব ভাষায় এ দেশের কেউ সেই অর্থে লেখক বা পণ্ডিত হয়েছে। মাইকেল মধুসুধন দত্ত ইংরেজিতে লিখতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছিলেন। আমরা অনেকে ইংরেজিতে লিখি, তবে দুখের বিষয়, ইংরেজদের কাছে সেটা গার্বেজ মনে হয়। আমরা অর্থ না বুঝে আরবি মুখস্থ করি বা শিখি, এক্ষেত্রে আমাদের বড় ব্যর্থতা আরবি না বোঝার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল শ্রমবাজারে আমরা সুবিধা নিতে পারছি না।
বাংলা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা। যেভাবে চলছে তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে এই ‘মহামারি’ থেকে বাংলা নিজেকে রক্ষা করতে পারবে কি না বা পৃথিবীর বিপন্ন ভাষাগুলোর তালিকায় চলে যাবে কি না— সে কথা কেউ জোর করে বলতে পারে না। যে ভাষার অধিকারের জন্য প্রাণ ঝরে গেল, যে ভাষাকে মূলমন্ত্র করে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে এই স্বাধীন দেশটির জন্ম হলো ‘মোদের গরব মোদের আশা’— সেই বাংলা ভাষাটি যেন মর্যাদাশীল থাকে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী