মানুষ স্বতঃসিদ্ধভাবে অন্যের ডাকে সাড়া দেয়। মানসিকভাবে জেগে ওঠে। আত্মিক ও মানসিকভাবে এই জাগিয়ে তোলা আর প্রচলিত অর্থে ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলা এক না। যুগে যুগে, দেশে দেশে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোর ভেতর থেকে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে, পথ দেখাতে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ জেগে উঠেছে। মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নিয়ে-নবজাগরণের সূচনা করেছে। তাদের সেই ডাকে সাড়া দিয়ে কারো আচারে পরিবর্তন হয়েছে, কারো মানসিকতায় পরিবর্তন হয়েছে। আবার কোথাওবা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে।
বাঙালিকে বলা হয় ‘বীরের জাতি’। বাঙালির রয়েছে স্বাধীন সত্তা। তারপরও যুগে যুগে নানা জাতি এসে বাঙালিকে শাসন করেছে, শোষণ করেছে। প্রতিবার বাঙালি লড়াই করেছে, ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। ইতিহাসের সেই সব পর্বের পর্যালোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য না। বিশ্বের বুকে বাঙালিকে পথ দেখিয়ে নতুন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যিনি পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন, যার হাত ধরে বাঙালি অর্জন করেছে তার মহত্ম অর্জন- স্বাধীনতা, আজকে সেই মহামানবের অমর একটি কবিতার প্রসঙ্গে বলতে চাই।
অন্ধকার থেকে, শেকলবন্দি জীবন থেকে বাঙালিকে মুক্তির পথ দেখিয়ে ত্রাতার ভূমিকায় যিনি অবর্তীণ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা। ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যের দিকে তিনি এগিয়ে দিয়েছেন। বাঙালিকে পৌঁছে দিয়েছেন তার অভিষ্ট লক্ষ্যে। অতীতের সকল ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে বাঙালিকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম মানচিত্র এনে দিতে জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন জেলখানায়। বাঙালির মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গকারী এই মহান নেতা বাঙালি জাতিকে তার অসাধারণ নেতৃত্বগুণে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। ব্রিটিশদের তাড়িয়ে আমরা যে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, ১৯৪৭ সালে যে স্বাধীনতা আমরা মেনে নিয়েছিলাম, সেখানে আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল ছিল না। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত ভাগের পর থেকেই আমাদের পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। প্রথম আঘাত হানা হয় ভাষার ওপর। এরপর শোষণ ও শাসনের যে স্টিমরোলারে বাঙালিকে ক্রমাগত পিষ্ট করা হয়, তার বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির একতাবদ্ধতায় ভীত হয়ে নানাভাবে বিভ্রান্তি ও বিভেদের জাল বিস্তার করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু সকল ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে বাঙালিকে তার পথের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আমাদের ওপর যে প্রতিনিয়ত অন্যায় করা হচ্ছে, আমাদের নানাভাবে শোষণ করা হচ্ছে যুক্তির মাধ্যমে মানুষকে তা বোঝাতে সক্ষম হন বঙ্গবন্ধু। বাংলার মানুষ ভালোবেসে- তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। বাংলার মানুষের ভালোবাসাকে হৃদয়ে ধারণ করেই তিনি বাঙালিকে দিয়েছিলেন মুক্তির সনদ- ছয়দফা। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল এই প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেদিন বাংলার মানুষের মুক্তির পথ যেমন তিনি নির্দেশ করেছিলেন, তেমনিভাবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। সময়ের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে আাসে ১৯৭০-এর নির্বাচন। রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। পাকিস্তানের জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদে উভয় কক্ষে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার মানুষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের সে ষড়যন্ত্র সফল হয়। বাঙালি জাতির ওপর অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার পথ খুঁজে পায় পাকিস্তানিরা। অপারেশন সার্চলাইট নামের আড়ালে গণহত্যার পরিকল্পনা সফল করে পাকিস্তানিরা। কিন্তু এর আগেই নানাভাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির জাগরণকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য গ্রহণ করে নানা পরিকল্পনা।
অনেকেই অযৌক্তিকভাবে এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য প্রচার করেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অস্ত্রের মুখে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাধারণ মানুষকে প্রস্তুত করে তোলা তো দূরের, সামান্য আভাসও সেসময় দিতে পারেনি। রাজনীতির অসৎ পাশাখেলার সঙ্গে জড়িতদের এ ধরনের বক্তব্য যে কতোটা মিথ্যে, কতোটা বিকারগ্রস্ত তা স্পষ্ট হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি না হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে, তখন সকল কোলাহলকে সরিয়ে রেখে বাঙালিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করছে, তখন আশা-নিরাশার সেই দোলাচলের মধ্যে দৃঢ় কণ্ঠে বাঙালিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেন বঙ্গবন্ধু।
তিনি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। জীবনের নানা পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসংখ্য ভাষণ দিয়েছেন। সেসব ভাষণে তিনি বাঙালিকে নানাভাবে উদ্দীপিত করেছেন। কিন্তু তার সকল উদ্দীপনামূলক ভাষণের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তিসংগ্রামের উদ্বুদ্ধ করেন। বাঙালির ভেতরে যে স্বাধীতার স্পৃহা, তা জাগিয়ে তোলেন। তিনি যখন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন, তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার পরিবেশ তৈরি হয়নি। কিন্তু বাঙালি বুঝে গিয়েছিল, পাকিস্তানের সঙ্গে আর নয়। বাঙালির যে নিজস্ব ভূখণ্ড প্রয়োজন, তার যে স্বাধীনতার স্পৃহা তা আর তখন অস্পষ্ট নয়। এই স্পষ্ট সময়ে খোলাখুলিভাবে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা জানানোর তাগিদ অনুভব করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মানসিকভাবে জেগে ওঠা বাঙালিকে আগামীতে কোথায় দাঁড় করাবে, তা তখনও অনিশ্চিত। তাই দূরদর্শী নেতা হিসেবে, বাঙালীর মনের তীব্র আবেগকে অনুধাবন করেই সেদিন আগামীর দিকনির্দেশনা দেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার অধিকার আদায়ের জন্য আমাদের কি করতে হবে, কোন পথে এগুতে হবে তা প্রকাশ্য সভায় প্রশ্নাতীতভাবে সেদিন তিনি উন্মুক্ত করেছিলেন। মাত্র আঠারো মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের ভাবনা বাস্তবায়নের পথরেখা ঘোষণা করেছিলেন।
পুরো ভাষণের প্রতিটি শব্দ যে সচেতনভাবে, দৃঢ়তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, তা আপন মর্যাদায় উদ্ভাসিত। এখানে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণের তিনটি লাইন সম্পর্কে বলছি। আমাদের সামনে যে যুদ্ধ অপেক্ষা করছে, সেই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আমাদেরকে গেরিলা যুদ্ধের পথ বেছে নিতে হবে, তা বঙ্গবন্ধু অনুধাবণ করেছিলেন। পাকিস্তানিরা দীর্ঘদিন আমাদের শাসন করেছে। তারা আমাদেরকে দমনকে করতে যে কৌশলের আশ্রয় নেবে, তা মোকাবেলা করে জয়ী হতে চাইলে গেরিলা যুদ্ধের বিকল্প ছিল না। কারণ পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড আমাদের থেকে হাজার মাইল দূরে। পাকিস্তানিরা আমাদের দেশে এসে, আমাদের ওপর নির্যাতন ও শোষণ চালাচ্ছে, তাদেরকে এদেশের মাটি থেকে তাড়াতে গেরিলা যুদ্ধই সিদ্ধ পথ। গেরিলা যুদ্ধের পথ ব্যাখ্যা করে ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল: প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে’।
তৎকালীন সময়ে ও পরিবেশে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে লাখ লাখ মানুষের সামনে দিকনির্দেশনামূলক পথের সন্ধান এর চেয়ে স্পষ্ট হতে পারে না। এরপর আরেকটি বাক্যে তিনি বলছেন, ‘আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব’। পাকিস্তানিদের মোকাবেলা আমাদেরকে দেশের ভেতরে থেকেই করতে হবে। নিজগৃহেই আমরা সেদিন অসহায় ছিলাম। সেই অসহায়ত্বের ভেতর থেকে জেগে উঠে শত্রুকে মোকাবেলায় আমাদের হাতে যথেষ্ট অস্ত্র ছিল না। তাদের আধুনিক অস্ত্রের বিপরীতে আমাদের অসহায়ত্ব যেন ফুটে না ওঠে, বরং আমরা কি কৌশলে শত্রুকে বধ করতে সক্ষম হবো, তাও এই বাক্যের মাধ্যমে স্পষ্ট করেন বঙ্গবন্ধু। শত্রুর রসদ সরবরাহ হতো আমাদের ভেতর থেকেই। শত্রুর রসদ বাইরে থেকে আসতো না, তারা আমাদের দেশেই অবস্থান করছিল, সেক্ষেত্রে তাদের রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলেই তাদের ঘায়েল করা সম্ভব। তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া সহজ হবে। সে পথই দেখিয়ে দিয়েছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে দিনের ভাষণ যা ঐতিহাসিক হয়ে উঠেছে, তা শেষ করার আগ মুহূর্তে তিনি আবারও বাঙালিকে গেরিলা যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে, বাঙালির চিন্তাকে সেই উত্তাল সময়ে বাস্তবমুখী করে তুলতে ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংঘগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’
একটি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে, তাকে তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দেওয়ার একরম দৃষ্টান্ত বিরল বলেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। স্বাধীনতার প্রশ্নে এমন দিক নির্দেশনামূলক প্রভাববিস্তারী ভাষণের স্থায়িত্ব, আজ স্বাধীনতার তেপ্পান্ন বছর পরেও সমান ব্যঞ্জনা বহন করছে। বঙ্গবন্ধু সেদিন বাঙালির আবেগকে ভাষা দিয়েছিলেন, সেইসঙ্গে পরিস্থিতি বর্ণনা করে তা মোকাবেলা করার পথ নির্দেশ করেছিলেন। যা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা, আমাদের স্বপ্নকে মূর্তিমান করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক