১৯৭১ এবং ১৯৭২ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন দুটির মাঝে মাত্রাগত পার্থক্য রয়েছে। ১৯৭১ সালের জন্মদিনের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের একটি প্রদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু ১৯৭২ সালের জন্মদিনের সময় বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি নতুন রাষ্ট্রের জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুর এই দুই জন্মদিনের ঘটনাবলী থেকে আমরা মাত্রাগত পার্থক্যটি খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারি। একইসঙ্গে প্রাদেশিকতা থেকে আন্তর্জাতিকতায় উত্তরণের ব্যাপারটির মাঝে ঘটে গেছে বিশাল এক ঘটনা। তা ছিল বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সফলভাবে প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রথম বিশ্ব-দৃষ্টান্ত।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাত ৮টায় তৎকালীন বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভূক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের বাইগার নদী তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ তারিখে তিনি ৫১ বছর বয়সে পদার্পণ করেন। মাঝখানে কেটে গেছে ৫০টি বছর। এই সময়ে শেখ মুজিব রাজনৈতিক নেতা হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর (জাতীয়) ও ১৭ই ডিসেম্বর (প্রাদেশিক) ‘এক ব্যক্তির এক ভোটের ভিত্তিতে’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ জাতীয় এবং প্রাদেশিক আইন সভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সামরিক শাসকগোষ্ঠী দলটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। এ ধরনের প্রাদেশিক রাজনৈতিক মেরুকরণ মূলত বাঙালিকে বঞ্চিত করেই ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্রের সূচনা করে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতেই মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ইয়াহিয়া খান-জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রাদেশিক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দেবে না; বরং বাঙালির ন্যায্য দাবি অগ্রাহ্য করতে ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটবে। তাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে প্রাদেশিক পূর্ব পাকিস্তান। ছাত্র-জনতা বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি তোলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার। এরই অগ্নিময় পথ ধরে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।
পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার কথা বলে ঢাকায় আসেন। একাত্তরের ১৫ মার্চে ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী, প্রতিবাদের নগরী। সরকারি-বেসরকারি ভবনে এবং যানবাহনে উড়েছিল কালো পতাকা। পরদিন ১৬ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেন। এ বৈঠক প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলে। কিন্তু দেশজুড়ে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরপর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৫১তম জন্মদিন। কিন্তু উৎসব আনন্দ করার অবকাশ কোথায়? চারদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। চট্টগ্রামের ইপিআর সদর দফতরের অ্যাডজুটেন্ড মেজর রফিকুল ইসলামের গ্রন্থে (লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মুক্তধারা, চতুর্থ প্রকাশ, ১৯৯১, পৃ.৫৩-৫৪) এ সময়ের কিছু খণ্ডচিত্র পাওয়া যায়। তার বর্ণনা থেকে ১৭ মার্চের একটি চিত্র এখানে উদ্ধৃত করছি :
‘ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়ার তখন কার্যত বন্দিদশা। বিরাট সশস্ত্র রক্ষীদল ছাড়া তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। পূর্ব পাকিস্তানে তখন শেখ মুজিবের কিংবা তার দলের নির্দেশ ছাড়া কিছুই চলছিল না, কোনো কাজই হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলিই ছিল তখন দেশের সর্বোচ্চ আইন। ইয়াহিয়ার কর্তৃত্ব প্রহসনে পরিণত হয়েছিল।’
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫১তম জন্মদিন। কিন্তু তিনি ব্যস্ত সময় কাটালেন বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায় নিয়ে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে। একইসঙ্গে ঘন ঘন সভা করতে হয়েছিল দলের নেতা কর্মীদের সঙ্গে। কী হবে? কী হতে যাচ্ছে? কী করা উচিত? এদিকে ঐ দিন প্রাদেশিক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অসহযোগ আন্দোলনের ১৬তম দিন চলছিল।
১৯৭১ সালের ১৭ মার্চের ১ ঘণ্টাব্যাপী চলা দ্বিতীয় বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানালেন, ‘আলোচনা চলবে, লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আলোচনা চলবে।’ এতে অনেকে অনুমান করেন, আলোচনায় তেমন একটা অগ্রগতি হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া খানের প্রতি মানুষের তেমন একটা আস্থা ছিল না। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতেই ইয়াহিয়া-মুজিব পরবর্তী বৈঠকের তারিখ ঘোষণা করা হয়। বলা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করবেন।
১৯৭১ সালের ১৭ মার্চের ১ ঘণ্টাব্যাপী চলা দ্বিতীয় বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির বাসায় ফেরার পর এক বিদেশি সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন- কেন বৈঠকটি সংক্ষিপ্ত ছিল? জবাবে বঙ্গবন্ধু কিছু বললেন না, একটু হাসলেন। সাংবাদিক জানতে চাইলেন, এই হাসি থেকে আমরা কী বুঝে নেব? তখন বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, আপনার মুখেও মৃদু হাসি আছে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমিও নরকে অবস্থান করে হাসতে পারি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি যেমন বলেছি, আমি নরকের ভিতরে বসে হাসতে পারি। এখন আমার মতো খুশি আর কেউ নেই কারণ সাড়ে সাত কোটি মানুষ আমাকে সমর্থন করছে। মানুষ আমাকে এমন কিছু দিয়েছে যা অতুলনীয়।’
এই যে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫১তম জন্মদিনে ভাবছেন, পাকিস্তানকে নরক-সমতুল্য জায়গা বলছেন বা স্বপ্ন-আনন্দ-অনুভূতিতে ভাসছেন, এর মাঝে যে একটা প্রাদেশিকতা রয়েছে সেটা বোঝা আসলে খুব সহজ। সেদিন তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের কথা বলেছিলেন। তিনি প্রাদেশিক পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।
১৭ মার্চ ১৯৭২, বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। কিন্তু এর মাঝে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পালটে গেছে। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ তার গর্বিত জায়গা করে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বের মোট ৪৫টি রাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিনটি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পালিত হচ্ছে। এর চেয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনে আনন্দের আর কীই বা হতে পারে?
কেমন ছিল দিনটি? ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চের জন্মদিন বঙ্গবন্ধুর জীবনেই নয়, আমাদের জাতির জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে নানা কারণে। সেদিন সকাল সাড়ে দশটা; ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে আসে ভারতীয় বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ‘রাজহংস’। বিমানটির গায়ে ভারতের পতাকার পাশে শোভা পেয়েছিল নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাটিও। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম আন্তর্জাতিক অতিথির আনুষ্ঠানিক আগমন।
রাজহংসে ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি বিগত বছর বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারত এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী শরণার্থীকে আশ্রয়-আহার-চিকিৎসা দেবার ব্যবস্থা করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দিয়ে গেরিলা যোদ্ধাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। স্বীকৃতির জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক প্রচারণা চালিয়েছেন। এক পর্যায়ে নিজের দেশকে সরাসরি সেই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছেন। তিনি ভারতের সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার স্বরণ সিং, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক এস চক্রবর্তী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জনাব পি. এন. হাকসার, পররাষ্ট্র সচিব জনাব টি. এন. কওল, প্রধানমন্ত্রীর সচিব জনাব পি.এন. ধরসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফরের জন্য দারুণ একটি দিন বেছে নিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিনের দিন– ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ।
বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হয়েছেন সস্ত্রীক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। এই সফরকালে ইন্দিরা গান্ধী ১৭ থেকে ১৯ মার্চ বাংলাদেশে অবস্থান করেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ছিল উপলক্ষ্য মাত্র। প্রকৃতপক্ষে ইন্দিরা গান্ধীর এই সফর সূচনা করেছিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টির নতুন দিগন্ত।
ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, সমস্ত নিপীড়িত মানবতার। তিনি শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, ‘আজ তাঁর (শেখ মুজিবের) জন্মদিন এবং আমরা কামনা করি যে চেতনা তাঁকে মুক্তির সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল তা বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী, সুখী, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার কাজেও অনুপ্রাণিত করবে।’
তখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তরুণ কর্মকর্তা ছিলেন দেব মুখার্জি। তিনি পরবর্তীতে ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেব মুখার্জির স্মৃতিচারণে জানা যায় যে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৫২তম জন্মদিনে ইন্দিরা গান্ধী একটি তামাকের পাইপ এবং একটি হাতে তৈরি কাঠের ফুলদানি উপহার দেন। তামাকের পাইপটি আখরোট কাঠের তৈরি ছিল। আর ফুলদানিটি ছিল সুগন্ধী চন্দন কাঠের তৈরি। তামাকের পাইপ এবং কাঠের ফুলদানি দুটোই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের উপহার হিসেবে বিশেষভাবে কাশ্মীরি কারিগরদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল।
ভারতের ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার তৎকালীন বিশেষ প্রতিনিধি সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত এই সফরে সঙ্গী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর সঙ্গে আগত অতিথিদের। একজন সাংবাদিক হিসেবে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের ঘটনাবলী। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে ইন্দিরা গান্ধী উপহার এনেছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সকল সদস্যদের জন্য। আর তা ছিল প্রাচীন ভারতীয় শহর বেনারসে তৈরি বিখ্যাত বেনারসি শাড়ি। বেনারসি শাড়ি ভারতের সেরা শাড়িগুলোর মধ্যে অন্যতম যা সোনা এবং রূপার জরি, সূক্ষ্ম রেশম এবং আকর্ষণীয় সূচিকর্মের জন্য বিশ্ববিখ্যাত।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার সদস্যদের স্ত্রীদের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর বেনারসি শাড়ি উপহারের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতি শুধু দুটি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র প্রধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না। বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হলো। পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ডালপালা পরিবারের গভীরে বিস্তৃতি লাভ করলো।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী দুজন সেদিন ভীষণ আনন্দমুখর ছিলেন। নাম ডেকে ডেকে মন্ত্রীসভার সদস্যদের যখন বেনারসী শাড়ি উপহার দেয়া হচ্ছিল, তখন এক পর্যায়ে খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদারের নাম ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু বলে ওঠেন, আরে ফণী তো বিবাহই করেনি। ও শাড়ি নিয়ে কি করবে? তাঁর চাইতে বরং একটা অতিরিক্ত শাড়ি শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীকে দেয়া হোক কারণ তাঁর দুটি স্ত্রী রয়েছে। এ কথায় হাসির রোল পড়ে যায় উপস্থিত সকলের মাঝে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেয়া হয় রূপার তৈরি নৌকা। কারণ নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতীক নৌকা। আর সেদিন মঞ্চ সজ্জায় ব্যবহার করা হয় কাপড়ের তৈরি তিনটি শাপলা ফুল। শাপলা ফুলের সজ্জা দেখে ইন্দিরা গান্ধী বিমোহিত হন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন এই বলে যে- এই শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় ফুল।
কী আশ্চর্য ব্যাবধান বঙ্গবন্ধুর দুটি জন্মদিনের মাঝে। ১৯৭১ সালে প্রাদেশিকতার বেড়াজালে বন্দী বঙ্গবন্ধু মুক্তির পথ খুঁজছেন। পাকিস্তানের নেতৃত্বের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায্য দাবির জন্য। আর ঠিক তার এক বছর পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু একজন অতি জনপ্রিয় বিশ্ব নেতা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক বুনন করে চলেছেন। তিনি ১৯৭২ সালের মধ্যেই প্রমাণ করে ফেলেছেন, তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, বরং বিশ্বের সমস্ত নিপীড়িত মানবতার। এই যে উত্তরণ, তা বাংলাদেশের অর্জন বটে।