কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের অত্যুজ্জ্বল নাম। কবি হিসেবে অধিক পরিচিতি লাভ করলেও তিনি বহু গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদসাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর অসংখ্য গান বাংলা গানের ভুবন সমৃদ্ধ করেছে। শোষণ, অবিচার, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার কণ্ঠ লেখার মধ্য দিয়ে একদিকে নিপীড়িত মানুষকে উজ্জীবিত করেছে, অন্যদিকে শোষকের জন্য দুঃস্বপ্ন রচনা করেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ভারতে ব্রিটিশ অপশাসন এবং পৃথিবীব্যাপী ইঙ্গ-ফরাসি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার দৃশ্যপট কবির মানসলোককে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে। তিনি বিপ্লব ঘোষণা করেন অপশাসন, উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নানা অসংগতির বিরুদ্ধেও কবি সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ফলে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য হয়ে ওঠে বিপ্লবের শক্তিঘর। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’য় তিনি তাঁর স্বরূপকে পরিচয় করিয়ে দেন: ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন! আসছে নবীন-জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন! তাই সে এমন কেশে-বেশে প্রলয় বয়েও আসছে হেসে- ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’
নতুন চিন্তা, রূপান্তরিত সমাজের প্রত্যাশা, বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানুষের মুক্তি, হয়ে ওঠে তার রচনার উপজীব্য- কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন বিপ্লবের কণ্ঠস্বর।
মানুষের ধর্মভিত্তিক শ্রেণিকরণ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মকে পুঁজি করে সমাজে প্রচলিত অনাচার তাঁকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। তিনি লক্ষ করেন, একই ভূখণ্ড, সমাজ ও সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো কেবল ধর্মের দ্বারা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। কবি উদাত্ত চিত্তে এই বিভক্তি মোচনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন: ‘গাহি সাম্যের গান- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান। গাহি সাম্যের গান!’
বিশ্বব্যাপী মানবের অভিন্ন মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই যেন তাঁর কাব্যের অন্বিষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষের একমাত্র পরিচয়, সে মানুষ। সেই মানুষকেই তিনি সবার উপরে স্থান দিয়েছেন- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।’ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও উপনিবেশপুষ্ট রাষ্ট্রনীতির যাঁতাকলে মানুষ সবচেয়ে তুচ্ছ হয়ে পড়েছে। গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ ও তার মালিক হওয়ার প্রতিযোগিতা দেশে দেশে। নতুন নতুন অস্ত্রের প্রয়োগ-পরীক্ষা হয় দুর্বল দেশের মানুষের ওপর। মানবতার এই চরম অবক্ষয়ের যুগে নজরুলের সাম্য ও সৌহার্দের বাণী অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
নারী ও পুরুষকে তিনি সমাজের দুটি অভিন্ন অঙ্গ হিসেবে দেখেছেন। নারীর প্রতি অবমূল্যায়ন যে সমাজ ও রাষ্ট্রের পিছিয়ে পড়ার কারণ, কবি তার অমোঘ বাণীতেই তা প্রচার করেছেন- ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ এই সরল অথচ তাৎপর্যময় উক্তিটি যে দেশের কবি রচনা করেছেন, সে দেশ ও সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য লজ্জার উদ্রেক করে। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাঁর অবস্থানের কথা বহু নিবন্ধে জানিয়েছেন। তিনি সবসময় প্রত্যাশা করেছেন, এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা হবে এ-দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিভিত্তিক। এর মধ্য দিয়ে আত্মসচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি হবে বলে তিনি বিশশ্বাস করতেন।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক এবং মানবিক বাংলাদেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল, তার সঙ্গে কবির আদর্শ সাযুজ্যপূর্ণ। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে উদ্যোগ ও প্রয়াস নিয়েছেন, তার দার্শনিক ভিত্তিও কাজী নজরুল ইসলামের স্বপ্ন, আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে কবিকে জানাই অনিঃশেষ শ্রদ্ধা।
লেখক : উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ